ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

কেন মেডিটেশন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৩৭, ১৬ মে ২০২১ | আপডেট: ০৮:২৯, ১৭ মে ২০২১

Ekushey Television Ltd.

মনের সার্বজনীন ব্যায়াম হচ্ছে মেডিটেশন বা ধ্যান । মেডিটেশনের নিয়মিত অনুশীলন জাগিয়ে তোলে মানুষের ভেতরের ইতিবাচক সত্ত্বাকে, শুভ শক্তিকে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মেডিটেশন এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগ মুক্তি থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রেই এখন মেডিটেশনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। 

মেডিটেশন নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে যে শুধু সমস্যা বা রোগ থাকলেই মেডিটেশন করতে হয়। আসলে সফল মানুষরাই বরং মেডিটেশন চর্চা করেন। বিশ্বজুড়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পপতি, বিজ্ঞানী, এমনকি পেন্টাগনের জেনারেলরাও মেডিটেশন করছেন। তাদের অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা কিছুরই অভাব নেই। তারপরও মেডিটেশন করেন ব্রেনটাকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্যে, সফলতাকে ধরে রাখার জন্যে, সুখ-শান্তির জন্যে।

দেহের ব্যায়াম যে জরুরি সেটা নিয়ে এখন আর কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মনের ব্যায়ামও যে খুব জরুরি, সেটা কয়জন স্বীকার করি? অথচ মনকে নিয়মিত কিছু ভালো চর্চার ভেতর না রাখলে মন যে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার ফলে শরীরও যে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেটা এখন নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত।

যুগে যুগে মানুষ মেডিটেশন বা ধ্যানকে আত্ম উপলব্ধির জন্যে ব্যবহার করে আসছে। ধর্মীয়ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ধ্যানের চর্চা হয়ে আসছে। অন্যদিকে বর্তমান আধুনিক এই বিজ্ঞানের যুগে মেডিটেশন এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

নিয়মিত মেডিটেশন চর্চায় মনের রাগ ক্ষোভ দুঃখ হতাশা টেনশন স্ট্রেস বা মানসিক চাপ দূর হয়। নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতায় বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে মনোদৈহিক নানা রোগ যেমন : আইবিএস, অনিদ্রা, মাইগ্রেন, করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ-সহ নানা রকম ব্যথা-বেদনা ইত্যাদি থেকে নিরাময় লাভ করা যায় খুব সহজেই। 

বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে (২৩ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ, ২০১৫), যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমসারির বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণা-কার্যক্রমের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নিয়মিত মেডিটেশনের মাধ্যমে প্রশান্ত জীবনযাপন, সুস্থ জীবনাচার এবং ইতিবাচক ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বার্ধক্যগতিকে বিলম্বিত করে। অর্থাৎ আয়ু বাড়ায়।

মেডিটেশনকে এক বাক্যে বলা যায়, মাথা ঠান্ডা রাখা ও মনকে নেতিবাচক ভাবনা থেকে মুক্ত রাখার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। মাথা ঠান্ডা রেখে ব্রেনকে বেশি পরিমাণে কাজে লাগাতে সাহায্য করে মেডিটেশন। অপরদিকে মনের নেতিবাচক চিন্তার বিনাশ করে ব্যক্তিকে আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী ও ইতিবাচক করে তোলে।

ধ্যান মেডিটেশন মোরাকাবা, তাফাক্কুর- শব্দগুলো ভিন্ন হলেও মূল নির্যাস একই। বিভিন্ন ধর্ম আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এটি প্রায়োগিকভাবে ভিন্ন রূপ নিলেও পানির সার্বজনীনতার মতোই ধ্যানের নির্যাস সার্বজনীন, সকল মানুষের জন্যে।

প্রাচীন মানুষ যে ধ্যান বা মেডিটেশন চর্চা করতেন তার লিখিত প্রমাণের বয়সই কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর। ৫ হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রে ধ্যানের উল্লেখ আছে। 

মেডিটেশন যে মনোযোগ বাড়ায় তা অবশ্য আগের আরো বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকেও প্রমাণিত। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের পরীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত মেডিটেশন করে স্বেচ্ছাসেবীরা বিভিন্ন স্বরের পার্থক্যকে খুব সহজে বুঝতে পারছে। জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে এ গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তির আবেগকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এটিও প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের জার্নালে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, মেডিটেশনের ফলে সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতায়। কিছু অসুস্থতা যেমন — ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম, মাদকাসক্তি, দুরারোগ্য চর্মরোগ সোরিয়াসিস, ডিপ্রেশন এবং ক্রনিক ব্যথা সারাতে মেডিটেশনের কার্যকর ভূমিকা দেখা গেছে।

মেডিটেশন বার্ধক্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। সামাথা প্রকল্পের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশনের ফলে দেহে টেলোমেরেজ নামে একটি এনজাইমের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা কোষের বুড়িয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ-সংক্রান্ত লেখাটি এসেছে জার্নাল ‘সাইকো-নিউরো-এনডোক্রাইনোলজি’-তে।

২০০৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে খোলা হয় সেন্টার ফর কমপ্যাশন এন্ড আলট্রুয়িজম রিসার্চ এন্ড এডুকেশন। নাম শুনেই ধরে নেয়া যায় এই ইনস্টিটিউটের কাজ হলো মমতা সহানুভূতি সমমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক আবেগগুলোর নিউরোবায়োলজিকেল যোগসূত্র বোঝা, গবেষণা করা। এই ইনস্টিটিউটের সাথে নিউরোসায়েন্টিস্টরা যেমন আছেন, আছেন সিলিকন ভ্যালির বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এবং আছেন তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাইলামা। তাদের সবার একটাই উদ্দেশ্য। আর তা হলো, মেডিটেশন চর্চা করে কীভাবে একজন মানুষ অন্যের প্রতি তার নিঃস্বার্থ মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা সৃষ্টি করতে পারে। 

আসলে আধুনিক ব্যস্ত জীবনের স্ট্রেস হতাশা বিষন্নতা উদ্যমহীনতা কাটিয়ে উঠে সফল ও পরিতৃপ্ত জীবনের জন্যে মেডিটেশনের কোনো বিকল্প নেই- এই উপলব্ধি থেকে পশ্চিমা বিশ্বে এখন জোয়ার উঠেছে মেডিটেশনভিত্তিক কার্যক্রমের।

এমআইটি, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, ইয়েল, স্ট্যানফোর্ডের মত বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন নামে চালু হয়েছে মেডিটেশনভিত্তিক হ্যাপিনেস কারিকুলাম।

আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেডিটেশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতি বছর ২১ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। 

ইতিহাসে আছে বিশ্বের অনেক বিখ্যাত মহাপুরুষেরা নিয়মিত ধ্যান করতেন । ইহুদি ধর্মের প্রাণপুরুষ মোজেস বা মুসা সিনাই পাহাড়ে ৪০ দিন ধ্যানমগ্ন থেকে আল্লাহর বাণী লাভ করেন।

মহামতি বুদ্ধ ধ্যানের পথে বোধি লাভ করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বাণ লাভের পন্থা শিখিয়েছেন অনুসারীদের। 

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান এবং প্রার্থনা হয়ে গিয়েছিল একাকার। যখনই সুযোগ পেতেন তিনি ধ্যান ও প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতেন। শিষ্যদেরও উৎসাহিত করতেন ধ্যানমগ্ন হতে।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স) বছরের পর বছর হেরা গুহায় কাটিয়েছেন ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। ধ্যানের স্তরেই পবিত্র কোরআনের বাণী নাযিল হয়েছে তাঁর ওপর।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। আজ থেকে হাজার বছর আগে বাংলার এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ধ্যানের শিক্ষা দিয়ে উপমহাদেশ, তিববত ও চীনের সমাজ-জীবনের পঙ্কিলতা দূর করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন |

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি দার্শনিক হযরত মওলানা জালালুদ্দিন রুমি। তিনি মোরাকাবায় নতুন মাত্রা যোগ করেন নৃত্য সংযোজন করে। তাঁর স্রষ্টায় সমর্পণ এবং বিশ্বজনীন প্রেমের দর্শন শতাব্দী পরিক্রমায় প্রভাবিত করে এসেছে চিন্তাশীলদের। 

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। যিনি তার শিষ্যদের মধ্যে ধ্যান জনপ্রিয় করেন । বিশ্বাস, ভক্তি ও ভালবাসার সহজ সরল শিক্ষার মধ্য দিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার লক্ষ ঘরে স্মরণীয় মহামানবে।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। ইংরেজ শাসনাধীন উপমহাদেশে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আত্মিক পুনর্জাগরণের সূচনা করেন। বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতাকে সমাদৃত করে তোলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৩ সালে শিকাগোর বিশ্বধর্মসভায় তাঁর বিখ্যাত ভাষণ প্রাচ্যের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বিজয়ের সূচনা করে। পাশ্চাত্য অনুভব করতে পারে তাদের অন্তঃসারশূন্যতা। আধ্যাত্মিকতার প্রসারের জন্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

সুফিবাদের আন্তর্জাতিক ধারার প্রবর্তক হযরত এনায়েত খান। ইউরোপ এবং আমেরিকায় তিনিই ধ্যানের এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন, বাংলা জাগলে ভারত জাগবে... জগৎ জাগবে...। একেশ্বরবাদ এবং সকল ধর্ম ও মতসহিষ্ণুতা ছিল তাঁর শিক্ষার ভিত্তি। সবাইকে তিনি মিলিতভাবে ধ্যান সাধনার পথে ডাক দিয়েছেন।

মহাঋষি মহেশ যোগী ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে বেদান্ত দর্শনকেন্দ্রিক টিএম-কে পরিচিত করান। পরবর্তীতে যা পাশ্চাত্যের মিডিয়া এবং জনজীবনে ধ্যানচর্চাকে জনপ্রিয় করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

তিববতের আধ্যাত্মিক নেতা চতুর্দশ দালাই লামা। বুদ্ধের ধ্যান পদ্ধতিকে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
নতুন যুগের সূত্রপাত

১৯৬৯-১৯৭০ দশকে মেডিটেশন চর্চায় নতুন যুগের সূত্রপাত হয়। নতুন নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে টিএম, বা ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশন, সহজ যোগ, ন্যাচারাল স্ট্রেস রিলিফ, ফাইভ রিদম, থিটা হিলিং, সিলভা মেথড, ডা. হার্বার্ট বেনসনের রিলাক্সেশন রেসপন্স, ডা. কাবাত জিনের মাইন্ডফুলনেস বা মনোনিবেশায়ন উল্লেখ্যযোগ্য।

বিজ্ঞানের এ যুগে মেডিটেশনের গুরুত্বকে সামনে রেখে আগামী ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হবে। বৃটিশ নাগরিক উইল উইলিয়ামস এর উদ্যোক্তা। উইল উইলিয়ামস একসময় নিদ্রাহীনতার রোগে ভুগতেন। এর সমাধানে নানারকম চেষ্টার পর অবশেষে তিনি মেডিটেশন শিখে এর মাধ্যমে নিরাময় লাভ করেন। তিনি এক দশক ধরে মেডিটেশন চর্চা করছেন। এদিন বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ ধ্যানী একযোগে অংশ নেবেন যৌথ মেডিটেশনে। বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় লাখো মানুষ এক সঙ্গে শামিল হয় মেডিটেশনে। 

২০০৪ সালে নিউজউইক তার ২৭ সেপ্টেম্বর ইস্যুটির প্রচ্ছদ নিবন্ধ করে নিউ সায়েন্স অফ মাইন্ড এন্ড বডি নামে যার মূল উপজীব্য ছিল সুস্থতার ওপর, দেহের ওপর মনের প্রভাব নিয়ে। 

এদিকে তিন দশক আগেই ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে সূচিত হয় মেডিটেশনকেন্দ্রিক আত্মোন্নয়ন কার্যক্রম কোয়ান্টাম মেথড। মেডিটেশনের সকল প্রাচ্য ধারার উত্তরসূরি, যোগ, বিপাসন ও মোরাকাবার নির্যাসে সমৃদ্ধ কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্মের সকল মানুষের উপযোগী পূর্ণাঙ্গ মেডিটেশন পদ্ধতি। তাই এবারের বিশ্ব মেডিটেশন দিবসকে ব্যাপক আয়োজনে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে কোয়ান্টাম। এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে। ছোট পরিসরে এবং ক্ষুদ্র সংগঠনিক প্রেক্ষাপটে দিনটি কিছু জায়গায় পালিত হলেও এখন পর্যন্ত সার্বজনীনভাবে দেশজুড়ে মেডিটেশন দিবস পালনের ঘটনা পৃথিবীতে এই প্রথম বাংলাদেশে হচ্ছে।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি