আজ তাঁর শুভ জন্মদিন
প্রকাশিত : ১৬:০১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ১৭:২৮, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ছাত্র, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক সৈয়দ মুজতবা আলির ১১৭তম জন্ম জয়ন্তী আজ। সিলেটে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ মুজতবা আলি ছিলেন আদ্যপান্ত বাঙালি। চলনে, বলনে, ভোজনে, আড্ডায় এবং রসিকতায় তিনি বাঙালি মাত্রই চিরস্মরণীয় এক নাম। ভ্রমণ বিষয়ক তাঁর অনবদ্য রচনা যে কোনো পাঠককেই মোহমুগ্ধ করে।
যদি তাঁকে, সৈয়দ মুজতবা আলীকে বলা হতো, ‘আজ আপনার ১১৭তম জন্মদিন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ প্রশ্নকারীকে তিনি আনখমস্তক ভদ্রজন ছিলেন বলে হেসে বলতেন, ‘ধন্যবাদ, তাই তো!’ এবং নিজের অস্তিত্বকে জিজ্ঞেস করা ঐ বিস্ময়সূচক উচ্চারণের পর জানাতেন, এই মুল্লুকে জন্মদিন পালন করবার ‘কালচর’ এনেছিলেন ঠাকুর বাড়ির মানুষরা।
জ্ঞানকে প্রজ্ঞার স্তরে নির্মাণ করতে এবং যথাস্থানে তা প্রয়োগ করতে যে-ক’জন লেখকের আমরা সাক্ষাৎ পাই, তার মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলী অন্যতম। সহজ সরল ভাষ্যে, নিজের সৃষ্ট ঘরানার উইটে জ্ঞানজাত কথা ও তথ্য তিনি বলেছেন, লিখেছেন। আমি ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়ে যেসব জ্ঞানের কথা সহজে জেনেছি, ওইসব বিষয়ে (জ্ঞানকথা) পণ্ডিতদের জটিল ব্যাখ্যাজাত শব্দখোয়ারে ঢুকে কেবল কয়েদী হয়েছি।
আমি আফগানিস্তানে কাজ করেছিলাম ১৪ মাস (২০০৩-’০৪)। ফেরার পর অনেকে বলেছিল, আফগানিস্তানের জীবনধারা, রাজনীতি, সমাজ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে লিখতে। বলেছি, ‘ভাই মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে’র পর কিছু লেখা হবে বাচালতা করা।’
আফগানিস্তানের টপোগ্রাফির সঙ্গে আফগানদের জীবনচর্চার সম্পর্ক মাকড়শা জালের মতো নিবিড়। হিন্দুকুশ পর্বতমালার উঁচু মাথার স্বাধীনতা, খরস্রোতা নদীর ধাবমানতা তাঁদের ধমনিতে প্রবাহিত। সেখানে যে পোকা জাল ছিড়তে চেষ্টা করবে তার অবস্থা হবে রাশান ও আমেরিকানদের মতো।
‘মিনির চীৎকারে যেমনি কাবুলিওয়ালা হাসিয়া মুখ ফিরাইল এবং আমাদের বাড়ির দিকে আসিতে লাগিল’ রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনির মতো আমরা চীৎকার করি নাই।
বেলা এগারোটা, মাস সেপ্টেম্বর। ১৯৬৫ সন। মালিবাগের গলিতে একজন কাবুলিওয়ালা এলেন। আমার বন্ধু চুন্নু ও আমি আগে কখনো বড় দাড়িওলা, মাথায় পাগড়ি, দীর্ঘদেহী মানুষ, পরনে আফগান পোশাক, নোংরা মানুষ দেখিনি। ভয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। আর তিনি ডেকেছিলেন। স্বর ছিল আন্তরিক, কাছে যাই। আমাদের দিয়েছিলেন বড় বড় কিসমিস, কাঠবাদাম, আখরোট আর কয়েকটা রঙিন কাঁচের গুলি।
মাজারী শরিফ থেকে বদলি হয়ে দেশপ্রেমিক আবদুর রহমনের পানশিরে গেছি কাজ করতে। পৌঁছেই নিজেকে বলেছিলাম, এসেছি আবদুর রহমানের গ্রামে। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে বিদেশে’ আবদুর রহমানের বয়ানে আমাদের জানান, বরফ পড়া শুভ্র পানশিরের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে (স্মৃতি থেকে বলছি) আবদুর রহমান বুক ভরে শ্বাস নেন এবং ছাড়েন। স্বাধীন মানুষের নিঃশ্বাস। আমিও ঝরা বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাই করেছিলাম।
মনে করা যাক, ওই সময়ে (২০০৩-’০৪) আলী সাহেব জাতিসঙ্ঘের বিশেষ পরামর্শক হয়ে গেছেন আফগানিস্তানে এবং প্রতিদিন দেখছেন ‘আবদুর বহমান’, বা ‘শবনম’-কে, অথবা কাবুলে পথের উপর নিজের পাঠানবোধের স্বাধীনতাকে ধুলোর মধ্যে শুইয়ে দিয়ে তা উপভোগ করছেন কোনো ‘কাবুলিওয়ালা’-কে। তাহলে তিনি জাতিসঙ্ঘকে বলতেন, ‘এই জাতির জীবনবোধ ‘পানশিরের’ (পঞ্চশির) ওই পাঁচ পাহাড়ের উচ্চ শিরের মতোই স্বাধীন, এখানে ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’, ‘নারী অধিকার’, ‘শিক্ষা’ ইত্যাদি কাজ বাইরে থেকে এসে এদের উপর চাপিয়ে দিয়ে করা যাবে না। আমি চলে যাবো। গতকাল আবদুর রহমান প্রচুর খাবার দিয়েছিল, খেতে পারিনি। আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিনে কাউকে পরামর্শ দিতে নেই।’
লেখক: কবি ও লেখক
আরও পড়ুন