ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা লজ্জাজনক: মুখ্য সচিব

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:১০, ১২ এপ্রিল ২০২২

প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, বাংলাদেশ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে আমরা শ্রীলংকা-পাকিস্তানের মত দূর্বল অর্থনীতির দেশের সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শ্রীলংকা-পাকিস্তান দুই দেশের অর্থনীতির যোগফলের সমান।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা লজ্জাজনক বলে তিনি মনে করেন। মূখ্য সচিব বলেন, ‘যারা বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করেন, তারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে হেয় করেন। এটা খুবই লজ্জাজনক। বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো কারণ নেই। অর্থনীতির সব সূচকেই আমরা খুবই ভালো অবস্থায় আছি।’

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মূখ্য সচিব এসব কথা বলেন। এর আগে মূখ্য সচিবসহ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বৈদেশিক ঋণসহ দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট বলে জানান আহমেদ কায়কাউস।

প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ অনেক ভাল কেবল নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সমষ্টির চেয়েও বেশি। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী অবস্থান ছাড়াও রাজস্ব ছাড় ও আদায়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা হয় না ঋণগ্রস্থ হয়ে দেউলিয়া হতে যাওয়া শ্রীলঙ্কার। 

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা- দক্ষিণ এশিয়ার এই বড় চার দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে আহমেদ কায়কাউস বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে গত অর্থবছর ভারতে যখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তখনও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ৬ শতাংশের বেশি ছিল। 

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি শক্তিশালী স্তম্ভের চিত্র তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ১৩ বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে পোশাক রপ্তানি, রেমিটেন্স প্রবাহ ও ধান উৎপাদন বেড়েছে।সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে কোভিড পরবর্তী সময়ে এই তিন খাতের পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

অর্থসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির আকার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপির যোগফলের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণও এই দুই দেশের রপ্তানি আয়ের সমষ্টির চেয়ে বেশি ও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের সমষ্টির দ্বিগুণ।

‘আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কোন আশঙ্কা নেই’ উল্লেখ করে অর্থসচিব বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে। গত ৮ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বেসরকারিখাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ এবং রপ্তানিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে কোনভাবেই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে নেওয়া। এ ধরণের ঋণের সুদহার কম, গ্রোস পিরিয়ড ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ হয়।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের তুলনা করে তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ ঋণ বাণিজ্যিক ও সভরেন বন্ডে নেওয়া, যেগুলোর সুদহার বেশি ও পাঁচ বছরে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধকাল ৩০ বছর। বাংলাদেশের কোন বাণিজ্যিক ও সভরেন বন্ড নেই। শ্রীলঙ্কার ঋণের সুদ হার ৮ শতাংশের বেশি হলেও বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সুদহার ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং প্রতিবছর ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রতিবছর পরিশোধ করতে হয় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।  

প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বাংলাদেশ বেশি নমনীয় ঋণের অর্থ সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের ব্যয় করে। আর কম নমনীয় ঋণের অর্থ লাভজনক বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করে, যেখান থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হয়। 

তিনি বলেন, এক যুগ ধরে বাংলাদেশে ‘হায় হায় রব’ তৈরি করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ সংকট দূর করতে কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হলো, তখন থেকেই বলা শুরু হলো যে, দেশ রসাতলে যাবে, কিন্তু যায় নাই। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার সময়ও একটি শ্রেণি একই রকম করেছে, কিন্তু সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করছে। যখনই বড় কোন প্রকল্প নেওয়া হয়, তখনই একটি শ্রেণি তার বিরোধীতা করে।

স্বাধীন হলে বাংলাদেশ টিকবে না বলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই একটি পক্ষ সরব ছিল, তারা তখনও ভুল প্রমানিত হয়েছে, তারা এখনও ভুল প্রমানিত হচ্ছেন।

তিনি বলেন,‘বারবার ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা খুবই লজ্জাস্কর। আমরা শ্রীলঙ্কা থেকে অনেক দূরে আছি’।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমরা যখন বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে গর্বিত ও উল্লসিত, তখন বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় অর্জনকে এভাবে অবদমন করলে তার চেয়ে লজ্জাকর ও হাস্যকর কিছু হতে পারে না বলেও বলে মনে করেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানান, অনেকেই এনবিআরের রাজস্ব ছাড় দেওয়াকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন যে, রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণেই শ্রীলঙ্কার অবস্থা করুণ হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা শ্রীলঙ্কার মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। এনবিআর রাজস্ব সমন্বয় করছে। আমরা অন্ধের মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। যেখানে রাজস্ব ছাড় দিলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং পরবর্তীতে আরও বেশি রাজস্ব আদায় হবে-সেখানে সতর্কতার সঙ্গে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হচ্ছে।’

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, একসময় রেডিও, টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ ইলেকট্রনিক্স আইটেম আমদানি নির্ভর ছিল। রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণে এসব পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এবং দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হচ্ছে। এখাত থেকে এখন ভিন্নভাবে বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে। কর ছাড় দেওয়ার কারণে দেশে এখন ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফোর হুইলার উৎপাদনে বিনিয়োগ হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেল, গ্যাস, সার আমদানিতে ব্যয় বাড়ায় সরকার ভর্তুকির চাপে পড়লেও দেশের মূল্যস্ফীতির হার কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে না বলে জানান অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘ভর্তুকির চাপ থাকলেও এই মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার। যখন মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, তখন সরকার আস্তে আস্তে ভর্তুকি সমন্বয় করবে’।

কায়কাউস বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের উপর এমন কোন চাপ আসবে না যে, দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, দেশেও সেগুলোর দাম বেড়েছে। তবে সরকার এক কোটি দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ায় বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে।  

ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি ‘তুচ্ছ’ বিষয় উল্লেখ করে কায়কাউস বলেন, এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোটেই উদ্বিগ্ন নন। যে শক্তি আমাদের অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে, সেখানে এটি একটি তুচ্ছ বিষয়। 

তিনি বলেন, আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি বেড়েছে। কিন্তু আমাদের রিজার্ভ দিয়ে ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বেসরকারিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে রপ্তানি ও রিজার্ভ আরও বাড়বে।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি