পদ্মা সেতু: মূল চ্যালেঞ্জ ছিল নদীশাসন ও পাইলিং (ভিডিও)
প্রকাশিত : ০৮:৩২, ২৫ জুন ২০২২ | আপডেট: ১০:২৬, ২৫ জুন ২০২২
পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত নানা বাধা এসেছে সরকারের সামনে। প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েন, তারপর নিজেদের উদ্যোগে সেতু নির্মাণে অর্থ সংস্থানের উপায় খোঁজা, সবশেষ মূল অবকাঠামো নিমার্ণের সময় নদীশাসন, খরস্রোতা পদ্মায় পাইলিংসহ নানা প্রতিকূলতা। তবে সব বাধা একে একে পেরিয়ে স্বপ্ন পূরণ- সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে।
দুই পাশের সংযোগ সড়ক, মূল ভৌত অবকাঠামো আর নদী শাসন- এই তিন কর্মযজ্ঞ নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প।
নদীর উপরের কাজ দেখা যায়, পানির নীচেরটা দৃশ্যমান হয় না। আবার, নদীর এপার ভাঙ্গে তো ওপার গড়ে। পদ্মার গতিপ্রকৃতিও বোঝা দায়। সেই নদীর ওপর সেতু টিকিয়ে রাখার কাজ চ্যালেঞ্জে ভরা।
পদ্মার নদী শাসন কর্মসূচির প্রধান পরামর্শক এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের ভাষ্য, পদ্মা সেতুর নদীশাসনে আরেকটু সময় লাগবে, ২০২৩ সালে শেষ হবে। নদীশাসন কতটা জটিল ও কঠিন কাজ সেতু নির্মাণের সময় পদে পদে তা বোঝা গেছে। তবে যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতা অনেকটা কাজে লেগেছে।
এ ধরনের সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত আর্ন্তজাতিক নিয়ম মানা হয়। পদ্মাতেও তাই হয়েছে।
আমাজনের পর পদ্মাই সবচেয়ে শক্তিশালী নদী। ফলে এই নদীর চরিত্র বুঝে কাজ করতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় গাইড বাঁধ দিয়ে নদীটির ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল। পদ্মার ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হয়েছে।
পদ্মার মূল প্রবাহ প্রায় আড়াই কিলোমিটার। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। ফলে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে পদ্মার দুই পাড়ে প্রচুর ভাঙন হয়। প্রাকৃতিকভাবে মাওয়া ঘাটে একটি পাতলা কাদার স্তর আছে, যার নিচের মাটি পাথরের মতো শক্ত। এই শক্ত স্তরের সুযোগ নিতে হয়েছে। ভাঙনের সম্ভাব্যতা, নদীর আচরণ ও পলি পড়ার হার- এসব হিসাব করে গাণিতিক মডেল তৈরি করে সেতুর কাজ শুরু করা হয়।
নদীর গভীরতার বিষয়টি সামলাতে ৮০০ কেজি ও ১২৫ কেজির জিও টেক্সটাইল ব্যাগ পদ্মায় ফেলতে হয়েছে। এসব ব্যাগ থেকে বালু বের হবে না। এ ধরনের ১ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার ৫২১টি ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় বালু দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জোগাড় করা হয়েছে। ভারতের বিহার থেকে এক টন ওজনের বিপুল পরিমাণ পাথর এনে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে নদীশাসনের কাজটি অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল। নদীর স্বাভাবিক চরিত্র ঠিক রেখে নদীশাসন করা হয়েছে।
মূল সেতু নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ হচ্ছে পাইলিং। পাইল বসানোর উদ্দেশ্য সেতুর ভিত্তি শক্তিশালী করা, যাতে অধিক ভারে সেতু দেবে না যায়। খরস্রোতা পদ্মায় এটি ছিল অন্যতম জটিল কাজ। ২০১৫ সালের ১ মার্চ পদ্মার পাড়ে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। ২০১৯ সালের এপ্রিলে পাইলিং শেষ হয়।
সেতুর পাইলের ওপর নির্মাণ করা হয় পিলার। এর ওপর বসানো হয় ইস্পাতের স্প্যান। পদ্মা সেতুতে স্প্যানের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে যানবাহন ও ট্রেন চলাচলের পথ। আরও ছোট-বড় কিছু কাজের শেষ পর্যায়ে পিচঢালাই দিয়ে সড়ক তৈরি করে যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয় সেতু।
মূল সেতুতে পাইল রয়েছে ২৬৪টি। নদীর ভেতরে ও দুই প্রান্তে সেতুর ৪০টি পিলারের নিচে পাইপের মতো দেখতে পাইলগুলো বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভেতরে ফাঁকা, ইস্পাতের তৈরি। প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ তিন মিটার, পুরুত্ব ৬২ মিলিমিটার। একেকটি পিলারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৪৬ মিটার (প্রায় ৪১২ ফুট) গভীরে বসানো হয়েছে।
সেতু বিভাগের তথ্য, বিশ্বে আর কোনো সেতুতে পদ্মা সেতুর মতো গভীরতায় পাইল বসানোর প্রয়োজন হয়নি। পাইলগুলোর প্রতিটি ৮ হাজার ২৫০ টন ভার বহন করতে সক্ষম। প্রতিটি পিলার প্রায় ৫০ হাজার টন ভার বহন করতে পারবে। আর ৪ হাজার ডেড ওয়েট টনেজ (ডিডব্লিউটি) সক্ষমতার জাহাজের ধাক্কা সামলাতে পারবে এই পিলার।
এত বড় ও শক্তিশালী পাইল কীভাবে মাটির এত গভীরে বসানো হয়েছে?
পাইল বসানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে পাঁচটি ‘হাইড্রোলিক হ্যামার’ যা আসলে দৈত্যাকার হাতুড়ি। পদ্মা সেতুর জন্য আনা হাতুড়ির মধ্যে তিনটি জার্মানির কোম্পানি মেংক-এর। নেদারল্যান্ডসের আরএইচসি কোম্পানির কাছ থেকে আনা হয় বাকি দুটি হাতুড়ি। এসব হাতুড়ির ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৯০০ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল।
পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে ডাঙায় আরও ৩২টি পাইল বসানো হয়েছে। তবে সেগুলো রড দিয়ে তৈরি করা হয়।
পদ্মা সেতুর পাইলিং শুরু হয়েছিল মাওয়া প্রান্তে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি পিলারের নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হবে। সেতুর ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নিচে তিনটি করে পাইল বসাতে গিয়ে নরম মাটির স্তর পাওয়া যায়। সাধারণত মাটির গভীরে যেখানে পাথর বা শক্ত মাটির স্তর পাওয়া যায়, সে পর্যন্ত গভীরতায় পাইলিং করা হয়। কিন্তু শুরুতে পরিকল্পনামতো গভীরতায় গিয়েও মাটি নরম পাওয়ায় পাইল বসানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে মাওয়া প্রান্তে কাজ বন্ধ রেখে জাজিরা প্রান্তে পাইল বসানো শুরু হয়।
মাওয়ায় নরম মাটি পাওয়ার পর অন্য পাইলের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করে কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে দেখা যায়, আরও ১২টি পিলারের নিচে যেখানে পাইল শেষ করার কথা, সেখানে নরম মাটি রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৪টি পিলারের নিচে পাইলিং নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এ সমস্যা সমাধানে যুক্তরাজ্যের কাউই নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। একটি পরামর্শ ছিল, কিছু পিলারের নিচে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়া হোক।
পাশাপাশি পিলারে গোড়ায় খাঁজ কাটা পাইল দিয়ে অতিমিহি সিমেন্টের মিশ্রণে নরম মাটি শক্ত করা হোক। প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সরকার এই বিকল্প বেছে নেয়। মূল সেতুর ২২টি পিলারের প্রতিটির নিচে ৭টি করে পাইল বসানো হয়। ১৮টি পিলারের নিচে বসানো হয় ৬টি করে। আর দুই প্রান্তের দুটি পিলারে (রডের) পাইল বসানো হয় ১৬টি করে।
জটিলতার কারণে পাইল বসাতে দেরি হওয়ায় পিলারের কাজও পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ৩১ মার্চ সেতুর সব পিলারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় সেতুর সাবস্ট্রাকচার বা নিচের অংশের কাজ।
সেতুতে সুপারস্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোর কাজ হচ্ছে ইস্পাতের স্প্যান বসানো। পাইলের জটিলতার কারণে পিলার তৈরি যেমন পিছিয়ে যায়, তেমনি স্প্যান বসানোও কিছুটা জটিলতায় পড়ে। অবশ্য সব জটিলতা কাটিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হয়েছে।
এএইচএস/ এসবি/
আরও পড়ুন