ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪

বিদেশিদের চোখে পদ্মা সেতু

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১১:১০, ২৫ জুন ২০২২ | আপডেট: ১১:৪৪, ২৫ জুন ২০২২

আত্মবিশ্বাস, দূরদর্শিতা আর নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও বিশিষ্টজনেরা। তারা এ সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বে নতুন এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন বলে তাদের বক্তব্যে এবং নিবন্ধে উল্লেখ করেন।

পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক দেশটির বহুল প্রচারিত ‘ডেইলি টাইমস’ পত্রিকার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে তাকে হাঁটতে হয়েছে কিন্তু তিনি তার গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছেছেন। সেতুর নির্মাণের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি তা দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা তা অনুসরণ করে। আজ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, সেতু সম্পর্কে ভাবতে গেলেই তিনটি শব্দ আমার মনে ভেসে ওঠে। তা হলো সাহস, সংকল্প এবং সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি স্বপ্ন থেকে সেতুটি আজ দৃঢ় বাস্তবে রূপ নিয়েছে এবং এখন থেকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না যে বাংলাদেশ পারে না। আর পদ্মা সেতুকে ঘিরে বাংলাদেশের ওপর আস্থা আরও বেড়েছে চীনের।

তিনি বলেন, আপনারা জানেন, প্রকল্পটির শুরুতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। আমি একে ষড়যন্ত্র বলতে চাই না। আমি বলতে চাই, এটি আত্মবিশ্বাসের অভাব। বাংলাদেশ, সরকার ও দেশটির জনগণের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।

রাষ্ট্রদূত বলেন, পদ্মা সেতু কেবল দুই খণ্ড ভূমিকেই সংযুক্ত করবে না, বরং এটি আমাদের জনগণের হৃদয়কে সংযুক্ত করে অভিন্ন সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি যাতায়াতের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়ার পর এটি বাংলাদেশের জনগণকে উপকৃত করবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে এবং এটি চীন ও বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্বের চিরবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। 

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কে দোরাইস্বামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কঠিন’ কিন্তু ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তের ফলে দীর্ঘতম সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, পদ্মা সেতু একই সাথে ঐতিহ্যবাহী বাংলার সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। 

হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা কঠিন কাজ ছিল এবং এটি শেখ হাসিনার ‘অব্যাহত ও দৃঢ় সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। 

বিক্রম কে দোরাইস্বামী বলেন, যখন বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালের প্রথম দিকে বিদেশি ঋণ নিয়ে এই কাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল, তখন ‘‘আমরা (ভারত) ছিলাম প্রথম দেশ, আমরা যেভাবে সম্ভব এই প্রকল্পের সহায়তা দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন নিজস্ব (অভ্যন্তরীণ) অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তখন ভারত আবারও ‘তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি জোরালো সমর্থন জানায় এবং আমরা সরবে এবং প্রকাশ্যে আমাদের সমর্থন জানাই।’

হাইকমিশনার বলেন, শেখ হাসিনার এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে এবং নয়াদিল্লি এই বড় অগ্রগতির ফলস্বরূপ ‘সংযোগ, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সহজ ভ্রমণের’ সুবিধার প্রত্যক্ষ করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয়, বিশেষ করে নেপালও পদ্মা সেতুর কারণে বাংলাদেশে দ্রুত ঢুকতে পারবে এবং “আমি মনে করি এটি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।”

জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকো বলেছেন, এই পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় একটি চমৎকার মাইলফলক। আর এটি বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থায়নে নির্মাণ শেষ হয়েছে। তিনি পদ্মা সেতুকে দেশের স্বপ্ন ও গর্ব হিসেবে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য কি করতে পারে এটি তার বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধিও আকাক্সক্ষা পূরণ করবে।

ইতো নাওকো আরও বলেন, এ মাসে পদ্মা সেতু এবং এ বছরের শেষ নাগাদ মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন মান সম্মত অবকাঠামো উদ্বোধনের নজির সৃষ্টির মাধ্যমে ২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের কথা স্মরণ করে নাওকি বলেন, তিনি পদ্মা সেতু ও রূপসা সেতু দুটি সেতুতে সহযোগিতার জন্য জাপানের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি পদ্মা সেতুর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে এবং রূপসা সেতু নির্মাণ করেছে।

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন, এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ নিজে থেকে কতটা করতে সক্ষম। জাপান রূপকল্প-২০৪১ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের যাত্রায় জাপান পাশে থাকবে।

ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চালর্স হোয়াটলি বাংলাদেশের উন্নয়নে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন একটি ‘অবিস্মরণীয় মুহূর্ত’ মন্তব্য করে বলেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশে জিডিপিতে এক দশমিক দুই শতাংশ যোগ করবে। আমরা এই সেতু নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি তা বাংলাদেশের জনগণের ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। বাংলাদেশকে অভিনন্দন।
ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি এক বিবৃতিতে বলেছেন, পদ্মা সেতু হবে সত্যিকারের ‘গেম চেঞ্জার’। এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই সেতু বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সরাসরি এর সুফল পাবে। 

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লক্ষ্যের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো বড় মাইলফলক অর্জন সম্ভব হয়েছে। রাশিয়ার কোম্পানি রোসাটমের সহায়তা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় যোগ হচ্ছে। এগুলো বাংলাদেশের জনগণের উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

ঢাকায় সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান নিজ দূতাবাসে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, পদ্মা সেতু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের দরজা খুলে দিতে পারে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই।

ঢাকায় নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকো নুনজিয়াতার  পদ্মাপাড় ঘুরে দেখে বলেন, শেখ হাসিনার সাহস এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই শত প্রতিকূলতার মধ্যে এত বড় অবকাঠামো তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো উন্নয়নে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। পদ্মাসেতু যেন তৈরি না হয়, সেজন্য বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।

এনরিকো নুনজিয়াতার মতে, এদেশে যে বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, যা বিশ্ব দরবারে আস্থা তৈরি করেছে। অনেকেই ভাবছে এদেশে বড় বিনিয়োগের কথা। ইতালিয়ান অনেক বিনিয়োগকারী খুব শিগগিরই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। কারণ বড় অবকাঠামো মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। আমরা মনে করি বাংলাদেশ এখন প্রস্তুত।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশিদের এক বড় অর্জন উল্লেখ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার এক ভিডিও বার্তায় অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশিদের দ্বারা বাংলাদেশিদের জন্য একটি বড় অর্জন এবং সকল বাংলাদেশির জন্য এটা গবের্র বিষয়। তিনি সকল অস্ট্রেলিয়াবাসীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জানান। 

তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু ভ্রমণ সময় কমিয়ে সারা দেশে মানুষের সহজ চলাচল, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এবং নিজ পরিবার-পরিজনদের দেখাশুনাসহ জীবন যাত্রাকে সহজ করে জাতীয় অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।’

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি