ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১১:৩৫, ২৫ জুন ২০২২ | আপডেট: ১১:৪২, ২৫ জুন ২০২২

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করে বাংলাদেশের অর্থনীতির বাঁক বদলের সূচনা হয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এই পদ্মা সেতুই হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি দারিদ্র্যপীড়িত জেলার উন্নয়নে হবে গতি সঞ্চার। পর্যটন, কৃষি, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে অর্থনীতিতে অনন্য মাত্রা যোগ করবে।

পদ্মা সেতু থেকে যে টোল আদায় হবে তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে বিনিয়োগ। এই সেতুর ফলে জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারণ করবে এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চলাচল বাড়াবে। তবে পদ্মা সেতু শুধু পরিবহন চলাচলের করিডর হিসেবে কাজ করবে না, অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে শিল্পায়নকে এগিয়ে নেবে। এই সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিনিয়োগ বাড়বে। এই অঞ্চলে কর্মসংস্থান হবে। ফলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমে আসবে।

এ সেতু ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন), পর্যটন, ইকোপার্কের পরিকল্পনা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা। পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। পদ্মা সেতুর কারণে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও সহজ হবে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বারবার জরিপ করে বলেছে, পদ্মা সেতু আঞ্চলিক ও জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বিশ্বব্যাংক তাদের  এক গবেষণায় বলেছে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। যদিও এখন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পদ্মা সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও বেশি হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু শুধু সেতুই নয়, এটি হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই সেতুর ফলে আমাদের জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে। যা নির্মিত পদ্মা সেতুর ব্যয়ের প্রায় তিনগুণের বেশি। বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা ছিল সাহসী পদক্ষেপ। এটার মাধ্যমে যে হিউম্যান ক্যাপিটাল অর্জন হয়েছে এটা এখন নতুন যেকোনো উদ্যোগে সাহস জোগাবে।’

পদ্মা সেতুকে কাজে লাগিয়ে আমরা ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে একটা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে পারব বলে মনে করেন ড. মুস্তাফিজুর রহমান। 

পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এটা একটি অর্থনৈতিক করিডোর হয়ে গেল। এর ফলে এই অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। এর যে এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে সেটা দেখে জনগণ বুঝবে সাধারণ রাস্তা কেমন আর এক্সপ্রেসওয়ে কেমন। এটার মাধ্যমে যোগাযোগ খুবই দ্রুত হবে।

নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর টোল থেকেও বিশাল আয় হবে। তবে আগে এ আয়ের মাধ্যমে লগ্নি করা (অর্থ মন্ত্রণালয়) টাকা পরিশোধ করা হবে। মাসে ১শ’ ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতুতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১শ’ ৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

বছরে এক শতাংশ সুদ দিতে হবে এই ঋণের। ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। প্রয়োজন হবে ১শ’ ৪০ কিস্তির। লগ্নি করা টাকা ফেরাতে বছরে এক হাজার ৬শ’ ৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকার টোল আদায় করতে চাইছে সরকার। 

পদ্মাসেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, টোলের মোট কালেকশন থেকে সেতু রক্ষণাবেক্ষণ, টোল কালেক্টের খরচ এবং সরকারের লোন শোধ হবে। সেতু তৈরির টাকা সরকার সেতু বিভাগকে লোন দিয়েছে। সেতু বিভাগ প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ৩০-৩৫ বছরে সরকারকে ফেরত দিবে। এরকমই চুক্তি হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা পিআরআইর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই সেতুর ফলে আগামী ৩১ বছরে সড়ক ব্যবহারকারীরা পরিবহন খাত থেকে এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পাবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূর করার মতো অর্থনৈতিক সুবিধা তো থাকছেই। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পর্যালোচনায়ও একই ধরনের সম্ভাবনা উঠে এসেছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মাধ্যমে মোংলা বন্দর আরও সচল হবে। এই বন্দর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হলেও এর ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই বন্দর এবং নতুন স্থাপিত পায়রা সমুদ্রবন্দর গতিশীল হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। এ  সেতুর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে। মোংলা, পায়রা, বেনাপোল, ভোমরা বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি বহু গুণ বেড়ে যাবে। 

সরকার এর আগে গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। পদ্মা সেতুর কারণে পদ্মার দুই পাশে দ্রুত নগরায়ণ হবে। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে প্রচুর আবাসন কোম্পানি প্রকল্প নিয়েছে। সেতুর কারণে যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে এসব আবাসন প্রকল্পে অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। পদ্মা সেতুর ওপারে অর্থাৎ, জাজিরা প্রান্তেও আবাসন কোম্পানিগুলো তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করছে বলে জানা গেছে।

খুলনা এক সময় শিল্পনগরী হিসেবে খ্যাতি পেলেও বিভিন্ন কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর পর থেকে খুলনা আবার শিল্পোদ্যোক্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে এসেছে। অনেকেই শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কিনছেন। আবার অনেকে পর্যটনকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ করছেন। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুর কারণে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন জাগরণ ঘটবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। দারিদ্র্য কমবে। উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে জিডিপিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে পদ্মা সেতু।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, এখন বিদেশিরা বাংলাদেশের এই উন্নয়নকে মিরাকল বলে। পদ্মা সেতুর ফলে শুধু দেশের ২১টি জেলা নয়, পুরো বাংলাদেশই উপকৃত হবে। এর আশপাশে ট্যুরিজম অনেক ডেভেলপ করবে। রফতানির জন্য শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য সবগুলো পোর্টই প্রয়োজন হবে। খুলনা দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। এটার মাধ্যমে বড় একটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই এলাকায় কৃষি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা অনেক উপকৃত হবে।

জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যাতায়াত সময় ১০ শতাংশ হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক আয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প মূল্যায়ন দলিল অনুসারে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে এবং এতে জাতীয় জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সহজ হবে। ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে পণ্য পরিবহন ও যান চলাচল। সে কারণে আমাদের যে পণ্য আছে, সেগুলো সহজেই ঢাকা আসবে। আবার ঢাকা থেকেও সহজেই পণ্য নিয়ে যাওয়া যাবে। এই আসা-যাওয়ার ফলে অনেক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হবে। পণ্যের সহজলভ্যতা বাড়বে। সে কারণে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হবে। আমাদের যে বিস্তীর্ণ ইকোনমিক মার্কেট, সেগুলো আরও সমন্বিত হবে।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। যার ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। এছাড়া কর্মসংস্থান বাড়ার ফলে এই এলাকার বেকারত্ব দূর হবে। যার ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়ে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান দাবি করে বলেন, পদ্মাসেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব পুরোদেশে ছড়িয়ে পড়বে। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশীর্বাদ নয়, দেশের উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম সব দিকে এ সেতুর প্রভাব ছড়িয়ে যাবে।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি