এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সূচি তৈরির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
প্রকাশিত : ১৪:০৮, ৬ জুলাই ২০২২ | আপডেট: ১৪:১০, ৬ জুলাই ২০২২
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহ সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাই সক্ষমতা থাকার পরও এই খাতে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিংয়ের বিকল্প নেই।
তবে মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিয়য়ের সূচি ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বুধবার সকালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবস্থাপিত ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’, ‘শেখ জামাল ডরমিটরি’ এবং ‘রোজী জামাল ডরমিটরি’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান এ কথা বলেন।
“প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক, কখন কোন এলাকায় কত ঘণ্টা লোডশেডিং হবে, এটার একটা রুটিন তৈরি করে সেভাবে লোডশেডিং, যাতে সেই সময়ে মানুষ প্রস্তুত থাকতে পারে, যাতে মানুষের কষ্টটা আমরা লাঘব করতে পারি। সেই বিষয়টা আমাদের নজরে দিতে হবে,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, “বিদ্যুৎ উৎপাদন আমরা বাড়িয়েছি। সেই বিদ্যুৎ আজকে আমরা সমস্ত বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হয়েছি, তবে আপনারা জানেন যে রাশিয়া-ইউক্রেনের যে যুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তীতে আমেরিকা রাশিয়ার ওপর যে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিল, ইউরোপ স্যাংশন দিল। ফলাফলটা এই দাঁড়িয়েছে, এখন তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, ডিজেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে।”
প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। সবকিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালিয়ে রাখা, আমাদের নিজস্ব যেটুকু গ্যাস আছে, তা ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে রাখাটাই একটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে গেছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “ফার্নেস অয়েল যার মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে এক হাজার ৪০ টাকা। অর্থাৎ ৩৩২ টাকা, ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এলএনজি যেটা মাত্র এমএমবিটিও ১০ ডলারে ক্রয় করা হতো, সেটা এখন ৩৮ ডলার। আর ২৮০ পার্সেন্ট প্রায় তার দাম বেড়ে গেছে। কয়লা সেটাও ১৮৭ ডলার ছিল, সেটা এখন ২৭৮ ডলার।ডিজেল যেটা ছিল ৮০ ডলার, এখন সেটা ১৩০-এ চলে আসছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে, এটা নাকি ২০০ থেকে ৩০০ ডলার পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। অর্থাৎ এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে সারা বিশ্ব যাচ্ছে। আমরা এমন নির্ভরশীল ডিজেলের ওপর সেই ডিজেলের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে।”
তবে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর আমেরিকা বা ইউরোপ অবরোধ আরোপ না করলে পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ নাও হতে পারত বলে মনে করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “এই স্যাংশনটা যদি না হতো তাহলে রাশিয়া থেকে, ইউক্রেন থেকে, এরা যুদ্ধও করত, আবার তাদের তেল বা ফার্টিলাইজার, গম এগুলোর সাপ্লাইটাও ঠিক থাকত। যদিও জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলের উদ্যোগে একটা চ্যাম্পিয়ন গ্রুপ হয়েছে। তার মধ্যে আমি আছি। সেখানে আলোচনা হয়েছে। সেখানে আলোচনা করে অন্তত বিশেষ করে খাদ্যটা যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, খাদ্য এবং সার যেন তারা আসতে দেন, এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
“স্যাংশনের কারণে এবং সুইফট বন্ধ করার কারণে আমরা ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে জিনিস কিনতে পারছি না। ইউক্রেন থেকে জিনিস কিনতে পারছি না। কাজেই ফিন্যান্সিয়াল ম্যাকানিজমটা যে কী হবে, এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি। ইউরোপের খুবই দুরাবস্থা, যদিও তারা রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) দিয়ে কিনে নিচ্ছে।”
রাশিয়ান মুদ্রা রুবল দিয়ে পণ্য কেনার সুযোগ বাংলাদেশের খুবই সীমিত বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “...বাংলাদেশের সে ব্যাপারে খুবই সীমিত সুযোগ আছে। তবুও আমাদের প্রচেষ্টা আছে, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের বিদ্যুৎ আমরা সকলের ঘরে দিয়েছি, এটা ঠিক। বর্তমানে কিন্তু আমাদেরকে লোডশেডিং করতেই হবে। উৎপাদনও আমাদের সীমিত রাখতে হবে, যাতে আমাদের এই ভর্তুকিটা না দিতে হয়।’
বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “ভর্তুকির বিষয়েও আমি আপনাদের জানাতে চাই, বিদ্যুতে মোট ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর যে এলএনজি আমদানি করছি গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ইন্ডাস্ট্রি চালু রাখার জন্য সেখানে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
“প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় হয় ৫৯.৬০ টাকা, কিন্তু আমরা সেটা বিক্রি করছিলাম, গ্রাহকদের কাছে দিচ্ছিলাম মাত্র ৯.৬৯ টাকায়, যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরেও বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে।নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১২.৮৪ টাকা। এককপ্রতি পাইকারি মূল্য দিচ্ছি মাত্র ৫.০৮ টাকায়। কোথায় ১২.৮৪, সেখানে মাত্র ৫ টাকায় আমরা দিচ্ছি। ফার্নেস অয়েল প্রতি একক উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে ১৭.৪১ টাকা। সেখানেও আমরা দিচ্ছি ৫.০৮ টাকায়। সেখানেও ভর্তুকি।”
তিনি বলেন, “ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬.৮৫ টাকা, কিন্তু সেখানেও আমরা ৫.০৮ করে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। কয়লা থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সেটাও ১২.৩৭ টাকা, কিন্তু দেয়া হচ্ছে মাত্র ৫.০৮ টাকায়।”
দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এই পরিমাণ ভর্তুকি কতদিন দেয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এই যে একটা বিশাল অঙ্ক, আমরা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি, এই ভর্তুকি কতক্ষণ আমরা দিতে পারব? কারণ আমাদের মানুষের খাদ্য দিতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, গৃহহীনদের ঘর দিতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। কৃষিতে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। এবারের বাজেটেও প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হবে। এবারের বাজেটেও সেটা আমরা ধরেছি, কিন্তু আমরা যদি ভর্তুকি না কমাই, সরকারে টাকা আসবে কোত্থেকে?”
এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তিনি বলেন, “অবশ্য সে কারণে আমি সবাইকে আহ্বান করেছি, প্রত্যেককে নিজের সঞ্চয়টা বাড়াতে হবে। খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং যতটুকু পারা যায় বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে; বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে।”
এএইচএস
আরও পড়ুন