কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের খবর দিল আবহাওয়া অফিস
প্রকাশিত : ১০:৩৯, ৩ মে ২০২৪
আবহাওয়া বিভাগের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয় চলতি মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে দেশে উচ্চ তাপপ্রবাহ ও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা, বজ্রপাত ও বজ্র-ঝড়, কালবৈশাখী ঝড় ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ মে) এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া বিভাগের পরিচালক ও কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।
দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে আরও জানা গেছে, এ মাসে দেশে ৩ থেকে ৫ দিন বজ্র শিলাবৃষ্টিসহ হালকা ধরনের কালবৈশাখী ঝড় এবং ২ থেকে ৩ দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ মাঝারি থেকে প্রবল কালবৈশাখী ঝড় সংঘটিত হতে পারে।
তাছাড়া চলতি মে মাসে দেশের কোথাও কোথাও এক থেকে ৩টি মৃদু তাপপ্রবাহ (তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সে.) এবং এক থেকে ২টি তীব্র তাপপ্রবাহ (তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২) বয়ে যেতে পারে। গত মাসের মতো এ মাসেও দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে ২টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং এর মধ্য থেকে একটি এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।
চলতি মে মাসে উজানে ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীসমূহের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং কতিপয় স্থানে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে।
আবহাওয়া বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি মে মাসে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ কমিটির উক্ত সভায় পর্যালোচনায় জানা গেছে, গেল এপ্রিল মাসে (চৈত্র-বৈশাখ) সারা দেশে গড়ে মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৮১ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবার বিভাগ-জেলাওয়ারি হিসাবে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে।
উত্তর জনপদের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কোন বৃষ্টিপাতই হয়নি। ঢাকা বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ৯১ ভাগ কম, চট্টগ্রামে ৮৪ ভাগ কম, খুলনায় ৮৯ ভাগ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবার সিলেট বিভাগে মৌসুমের এ সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ২৯৬ মিলিমিটারের স্থলে ২৯৩ মি.মি., অর্থাৎ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে পর পর চার মাসে দেশে ধারাবাহিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আবহাওয়া বিভাগের পর্যালোচনায় আরো জানা গেছে, গেল এপ্রিল মাসে মার্চে দেশে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় যথাক্রমে গড়ে ৩ দশমিক ২ এবং ২ দশমিক ৮ সেলসিয়াস বেশি ছিল। সারা দেশে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি সে. ঊর্ধ্বে ছিল। আগের মাসে মার্চে দেশে গড় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সে. কম ছিল। গত এপ্রিল মাসে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩০ এপ্রিল যশোর জেলায় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সে.।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, বৈশ্বিক উষ্ণতা, আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থার কারণে গত এপ্রিল মাসে দেশে ৫২ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, ৭৬ বছরের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী টানা উচ্চতাপ এবং ৪৩ বছরের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি, বজ্র-ঝড় বৃষ্টিহীন চৈত্র-বৈশাখ মাসের ব্যতিক্রম এবং চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করে।
এ অবস্থায় ফল-ফসল, কৃষি-খামার, চিংড়িসহ মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরী খাত, জনস্বাস্থ্য, প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে অনেকেই। হিট শকে আধাপাকা ইরি-বোরো ধান, অর্থকরী ফল-ফলাদি আম, লিচু, পেঁপে, আতা, সফেদা, জামরুল ইত্যাদির ফলন বা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বৃষ্টি বজ্রবৃষ্টিতে কিছুটা কমছে গরমের দাপট : চলমান তাপদাহ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় অব্যাহত রয়েছে। তবে গত মঙ্গলবারের তুলনায় গত দুই দিনে উচ্চতাপের দাপট কিছুটা কমেছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন বুধবার যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.৮, তার আগের দিন মঙ্গলবারে (৩০ এপ্রিল) মৌসুমের রেকর্ড তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪৩.৮ ডিগ্রি সে.। গতকাল ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৩৮.৩ এবং সর্বনিম্ন ২৯.৩ ডিগ্রি সে.। এছাড়া উচ্চ তাপ ছিল রাজশাহী, পাবনা ও যশোরে ৪১, কুষ্টিয়ায় ৪০.৫ ডিগ্রি সে.।
এক মাসের টানা উচ্চ তাপপ্রবাহ খরা-অনাবৃষ্টির পর গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্র-ঝড়, বজ্রবৃষ্টির সুবাদে চলমান উচ্চ তাপপ্রবাহের দাপট কিছুটা কমতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিতে স্বস্তি দেখা দিচ্ছে জনজীবনে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে কুতুবদিয়ায় ২৭ মিলিমিটার। এছাড়া চট্টগ্রাম, ফেনী ও স›দ্বীপে ৭, সীতাকুণ্ডে ৬, বান্দরবানও নোয়াখালীতে ৪, রাঙ্গামাটিতে ২২, কক্সবাজারে ১১ মি.মি. ছাড়াও রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে হালকা কিংবা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে সকালে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে হিমেল দমকা হাওয়ার সাথে ঘণ্টাখানেক বৃষ্টিপাত হয়। এ সময়ে অনেকেই রাস্তাঘাটে-মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে স্বস্তি প্রকাশ করেন। এক মাস টানা উচ্চতাপ ও খরার পর চট্টগ্রামে ক্ষণিকের বৃষ্টিতে সাময়িক স্বস্তি দেখা দেয়।
আগামী এক সপ্তাহের পূর্বাভাস
শুক্রবার (৩মে) সন্ধ্যাসহ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার (তিন দিন) আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারী তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ কিছু জায়গায় কমে আসতে পারে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস এবং রাতের তাপমাত্রা এক থেকে ২ ডিগ্রি সে. হ্রাস পেতে পারে।
আগামীকাল শনিবার (৪মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আগামী রোববার (৫মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা হ্রাস ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
চলমান তাপপ্রবাহ কিছু এলাকায় কমে আসতে পারে। উচ্চ তাপপ্রাবাহের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে। এর পরের ৫ দিনে সারাদেশে বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে এবং বৃষ্টিপাত ক্রমেই বিস্তার লাভ করতে পারে। তাপমাত্রা আরও হ্রাস পেতে পারে। তাপপ্রবাহের এলাকা কমে যেতে পারে। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
সিলেটে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির আভাস
ভারতের উজানে অতিবৃষ্টির ঢলে সিলেট অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কোন কোনটি বিপদসীমায় প্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে পাউবো। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেয়া পূর্বাভাস বুলেটিনে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও বৈশি^ক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতে উজানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট জেলার ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন সুরমা নদীর কানাইঘাট, লুভাছড়া নদীর লুভাছড়া, সারিগোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট জেলায় সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে স্বল্প মেয়াদে বিপদসীমার উপরে অবস্থান করতে পারে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলের উজানে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ১২০ মিলিমিটার এবং আসামের সিলচরে ২৯ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এমএম//
আরও পড়ুন