বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেল কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
প্রকাশিত : ১৬:২০, ৫ জুন ২০২৪
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ ৫ জুন। দিবসটিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বৃক্ষরোপণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখায় পুরস্কার বিতরণ করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছে বান্দরবান লামার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
বুধবার (৫ জুন) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এগ্রো রিসোর্সের কো-অর্ডিনেটর রাবিয়া নাজরীন।
এদিন সকালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২৪’র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ও বৃক্ষরোপণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়।
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিস্তৃত কোয়ান্টামম। যা এখন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যদের সঙ্ঘবদ্ধ দান, আন্তরিক শ্রম ও সহযোগিতায় ২৬ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই জনপদ।
বাংলাদেশের অন্যতম স্বাস্থ্যকর ও প্রকৃতিবান্ধব এই জনপদটি এখন প্রায় হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩০০ প্রজাতির পাখি ও ২০০ প্রজাতির প্রজাপতির নিরাপদ আবাসস্থল।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এখানে আড়াই সহস্রাধিক বঞ্চিত শিশু-কিশোরের একটি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, যার নাম কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ। আরও রয়েছে যোগ ও ধ্যানচর্চার জন্যে আত্মিক জাগরণভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সেবামূলক উদ্যোগ।
কিন্তু শুরুর চিত্রটি এমন ছিল না। ১৯৯৮ সালে অল্প কিছু ভূমি সংগ্রহ করে শুরু হয়েছিল এ জনপদ নির্মাণের কাজ। সে-সময় পুরো জায়গাটা ছিল আগাছায় পূর্ণ, আর পোড়া পাহাড়। শতবর্ষী সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। বর্ষার শেষে আগাছা নির্মূলের জন্যে পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো। এত অনুর্বর আর অস্বাস্থ্যকর ছিল যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় জায়গাটিকে বলা হতো ক্যাষ্টা (নিকৃষ্ট) জায়গা। মশা আর ম্যালেরিয়া ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই শুরুর দিকে গাছ লাগানো ও চারাগুলোকে বাঁচানোই ছিল অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি কোয়ান্টামের কর্মীরা। বর্ষাকালে সারাদেশ থেকে গাছের চারা সংগ্রহ করা হলো। কিন্তু কর্দমাক্ত পথে গাড়ি চলাচল সম্ভব নয়। তাই তারা মাথায় করে চারা নিয়ে যেত। চারা লাগানোর পরে বর্ষা মৌসুম শেষ। সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী মে মাস পর্যন্ত বৃষ্টি নেই। তখন তারা স্থানীয় টেকনিক অনুসরণ করল। প্রতিটি গাছের গোড়ায় মাটির কলসি দিয়ে দেয়া হলো। কলসিতে ছিদ্র করে কাপড়ের সলতে দিয়ে সারাদিন ধরে চারা গাছে পানি দেয়া হতো।
ক্রমাগত বনায়ন ও যত্নায়নের ফলে রুক্ষ্ম, ঊষর লামার কোয়ান্টামম ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠতে লাগল শীতল আর সবুজে সুশোভিত।
পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে শুরু হয় ব্যাপক সবুজায়ন কার্যক্রম। সারাদেশের স্বেচ্ছাকর্মীদের সহযোগিতায় প্রতিবছর বর্ষায় লক্ষাধিক ফলদ, বনজ, ভেষজ ও ফুলের চারা রোপণ করা হয়।
বর্তমানে কোয়ান্টামমে প্রায় এক হাজার প্রজাতির দেশি-বিদেশি, বিরল ও বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ রয়েছে। বৈলাম, কুম্ভি, কুরচি, হাড়গোজা, চালমুগরা, ধারমারা, নাগলিঙ্গম, রঙ্গন, কুসুম, মিলেশিয়া, নাইচিচি উদাল, তমাল, হিজল, পাদাউক, কেলিকদম, বান্দরহুলা, সিভিট, কামদেব, চুন্দুল, বাঁশপাতা, লোহাকাঠ, মুসকন্দ, ঢুলিচাঁপা, বরুণ, উদয় পদ্ম, হিমঝুড়ি-সহ বিভিন্ন দেশি বিরল বৃক্ষের পাশাপাশি বাওবাব, কাইজেলিয়া আফ্রিকানা, রাজঅশোক, নেপোলিয়ান হ্যাট, মাদাগাস্কার জেসমিন, সোলান্ড্রা, এজেলিয়া, মেক্সিকান ফ্লেইম ভাইন, বহুনিয়া গ্যালপিনি, ফিডেল উড-ট্রিসহ বিভিন্ন বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতির ফুলের গাছ রোপিত হয়েছে কোয়ান্টামমে।
উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যে একদল তরুণ প্রকৃতিপ্রেমী কর্মী রয়েছে এখানে। তারা দেশের বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বিরল প্রজাতির গাছের বীজ ও চারা সংগ্রহ করে থাকেন। নিজস্ব নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে ঢাকার রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরার রাজউক কলেজ, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ, কুমিল্লার হামদার্দ ইউনির্ভাসিটি, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে বিরল প্রজাতির চারা সরবরাহ করছে কোয়ান্টাম।
পাহাড়ি প্রকৃতিকে ঠিক রেখে কোয়ান্টামমের প্রতিটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে আলাদা নির্মাণশৈলীতে। টিলার ধাপে ধাপে নির্মাণ করা করা হয়েছে এখানকার ভবনগুলো। এমনকি কোনো স্থানে গাছকে আবর্তিত করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আগ্রহ ও উদ্যোগে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে ফুলের বাগান। যেগুলোর পরিচর্যা শিক্ষার্থীরা নিজেরাই করে থাকে। গড়ে উঠেছে হার্বেরিয়াম ও সীড ব্যাংক। এখানকার ভূপ্রকৃতিতে শৈলসারির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে অসংখ্য প্রবাহমান পানির ঝর্ণাধারা। পাহাড়ি এসব ঝিড়ির দুধারে রয়েছে বুনোফুল, ফার্ন আর অর্কিডের সমারোহ।
ছুটির দিনগুলো একদল শিক্ষার্থী পাহাড়ি ঝিড়ি/ ছড়ায় হার্বেরিয়ামের জন্যে নতুন নতুন উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করে থাকে। এখন তারা স্বপ্ন দেখছে একটি বিশ্বমানের বোটানিক্যাল উদ্যান গড়ে তোলার।
বছরের বিভিন্ন সময়ে নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয় বিভিন্ন মেলা ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মশালা। এরমধ্যে ২০১৭ সালে তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেনের কোয়ান্টামম সফরে ‘সবুজায়ন মেলা’ এবং ২০২১ সালে পাখিবিশারদ ইনাম আল হকের সফরে ‘পাখি মেলা’ অন্যতম।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ আর ভাষাশহিদদের স্মরণে এখানে নেয়া হয়েছে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ—শহিদ স্মরণে। ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ ও ৫ জন ভাষাশহিদের স্মৃতিতে রোপণ করা হয়েছে ১২টি শিমুল গাছ। ২১ ফেব্রুয়ারিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই শহিদ স্মরণে পুষ্পঅর্পণ করে থাকে।
বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংরক্ষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও সমভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে এখানে। পাখির খাবার উপযোগী ফলের গাছ যেমন বট, পাকুর, ঝিড়বট, চম্পা, ডুমুরসহ অসংখ্য গাছ রোপণ করা হয়েছে পুরো কোয়ান্টামম জুড়ে। প্রজাপতির জন্যে রোপণ করা রয়েছে অনেক হোস্ট প্লান্ট। ফলে আশেপাশের যে-কোনো এলাকার চেয়ে হরেক রকম পাখি ও প্রজাপতিরা এখানে খুঁজে পেয়েছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়।
গত ২৬ বছরের এই সুদীর্ঘ যাত্রার পুঁজি ছিল একমাত্র বিশ্বাস ‘আমরা পারি’। এই বিশ্বাসেরই রূপান্তর ঘটেছে সঠিক পরিকল্পনায়, কঠোর পরিশ্রমে ও সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় গড়ে ওঠা কোয়ান্টামমের এখনকার চিত্রে। এক সময়ের রুক্ষ্ম বিবর্ণ পাহাড় আজ পরিণত হয়েছে পত্র-পুষ্প-পল্লবে প্রস্ফুটিত এক আলোকিত জনপথে।
এএইচ
আরও পড়ুন