কী হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট
প্রকাশিত : ০৯:২৩, ১০ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১০:২৮, ১০ অক্টোবর ২০১৮
বর্বরোচিত ও নৃশংস ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় হচ্ছে আজ বুধবার। এর মধ্য দিয়ে ১৪ বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। ইতিমধ্যে রায়কে কেন্দ্র করে মামলার আসামিদের গাজীপুরের কেন্দ্রীয় কাশিমপুরের কারাগার থেকে আদালতে আনা হচ্ছে।
কিন্তু কি ঘটে ছিল সেই দিন?
[খোলা ট্রাকের উন্মুক্ত মঞ্চ। প্রায় ২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে ট্রাক থেকে নিচে নামছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তবে ফটোসাংবাদিকদের অনুরোধ রক্ষার জন্য আরও প্রায় এক মিনিট মঞ্চের ট্রাকে অবস্থান করেন তিনি। ট্রাকে থাকাবস্থাতেই বেলা ৫টা ২৩ মিনিটে মঞ্চের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয় একের পর এক পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে কেঁপে উঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকা। রক্তবন্যা বইছিল এলাকা জুড়ে। মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছিল আকাশ-বাতাস।
প্রাণ বাঁচাতে ট্রাকের ওপরই শুয়ে-বসে পড়েন শেখ হাসিনাসহ অন্যরা। কিছু সময় পর শেখ হাসিনাকে দলীয় নেতা-কর্মীরা মানব-বর্ম রচনা করে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আবারও শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। বাধ্য হয়ে তারা আবারও ট্রাকের কাছে ফিরে আসেন। প্রায় সাত মিনিট ধরে চলতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড হামলা।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রটেকশনে থাকা পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা প্রতিরোধ গড়তে গুলি ছোড়েন। চলে ডিএমপি সদস্যদের লাঠিচার্জ। সাত মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয় গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির কলঙ্কিত অধ্যায়ের দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যাই ছিল মূল টার্গেট। ওই এক মিনিট অপেক্ষা না করলে হয়তো রচিত হতো অন্য ইতিহাস। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে গেলেও নিহত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা যায়, চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় অবস্থান নেয়। মু্ক্তাঙ্গনের পাশ থেকে ১৫টি আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে ওলামা লীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মিছিলের মধ্যে ঢুকে নজরদারি এড়িয়ে হামলাকারীরা সমাবেশ এলাকায় প্রবেশ করে। তিনটি টিম সরাসরি আক্রমণের দায়িত্বে থাকলেও একটি ছিল ব্যাকআপ টিম।
মঞ্চের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান ছিল জান্দাল, কাজল, বুলবুল ও লিটনের। পশ্চিম ও পশ্চিম-উত্তর দিকে থাকা দ্বিতীয় দলে ছিল সবুজ, জাহাঙ্গীর আলম, মাসুদ ও উজ্জ্বল। একটু দূরে ছিল মোস্তাকিম, মোরসালিন, আরিফ হাসান ও ইকবালকে নিয়ে গঠিত তৃতীয় দল। অপারেশনে থাকা দলের ব্যাকআপে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ্ মাজারের পাশেই অবস্থান নিয়েছিল আবু বক্কর, জুয়েল, খলিল, শুভ, বাবু ও ফেরদৌস।
প্রথম গ্রেনেড হামলা শুরু হয় মঞ্চের দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকা দল থেকে। পরে বাকি দুটি দলও নৃশংস ওই হামলায় অংশ নেয়। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের ধোঁয়া ও পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশ। শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ—সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ ও আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা আর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে তৎকালীন সরকারের পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই। জঙ্গিরা তাদের সঙ্গে থাকা ১৫টি গ্রেনেডের মধ্যে দুই দফায় ১৩টি গ্রেনেড চার্জ করে। ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলেও একটি বিস্ফোরিত হয়নি। রমনা ভবনের পাশের গলি থেকে দুটি গ্রেনেড অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান ২৪ আগস্ট।
তবে ওই দিনই নিহত হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুজন।
হামলায় আহতের মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রয়াত মো. হানিফ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট রহমত আলী, সাঈদ খোকনসহ আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ।]
দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের একটি অংশকে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।
এসএ/
আরও পড়ুন