চামড়ার দাম নেই, তবে জুতার দাম কেন চড়া?
প্রকাশিত : ১১:৫৩, ১৪ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১০:৩৯, ১৭ আগস্ট ২০১৯
কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এবার ছিলো সর্বনিম্ন পর্যায়ে। কিন্তু চামড়ার এতোটা দাম কমলেও জুতা,স্যান্ডেল,ব্যাগের মতো চামড়া জাত পণ্যের মূল্য এখনো চড়া রয়েছে, তার দাম কমার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
জেলার বাজারগুলোতে গতবারের চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
অনেক বাজারে এত কম দামে বিক্রি না হওয়ায় অবহেলায় মাটিতে লুটাচ্ছে চামড়া। চামড়া বাজারের এই ধসের শিকার মধ্যস্বত্বভোগী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। আর যেসব হতদরিদ্র মানুষ কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা থেকে একটা অংশ পেয়ে থাকে প্রতিবছর, এবার তাদের ভাগ্যেও জুটবে না কাঙ্খিত অর্থ।
মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণেই এই চরম মন্দা। আর কেউবা নিচ্ছেন সুযোগ। সব মিলিয়ে কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র দামে। এতে নষ্ট হতে পারে প্রায় ৪০ শতাংশ কাঁচা চামড়া। আড়তদাররা বলছেন, গত ৩০বছরের মধ্য এবারই কাঁচা চামড়ার সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসিন্দা প্রিয়া আক্তার বলেন, যখন কোরবানির চামড়া প্রায় পানির দরেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন,তখনো দোকান থেকে চামড়ার পণ্য কিনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে।
কিছুদিন আগে কোরবানির গরুর চামড়াটা বিক্রি করতে হল মাত্র তিনশো টাকায়। এর বেশি কেউ দাম দেবে না। কিন্তু এর আগে যখন দোকান থেকে জুতা-স্যান্ডেল কিনেছি,কোনটাই চার-পাঁচ হাজার টাকার নিচে কিনতে পারিনি। এখনো পারছি না। তাহলে এতো সস্তায় চামড়া কিনে, সেটা দিয়ে জিনিসপত্র বানিয়ে এতো বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে কেন? একজন ক্রেতা হিসাবে আমার তো মনে হচ্ছে আমি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।
আর এক বাসিন্দা ফাহমিদা খাতুন বলেন, ''যখন কোন পণ্যের উপাদানের দাম কমে যায়, ওই পণ্যটিরও দাম কমা উচিত। এখানে চামড়ার কাঁচামালের দাম কমলেও, তৈরি পণ্যের যে দাম কমছে না, এক্ষেত্রে একটি সঙ্গতির অভাব রয়েছে।''
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী লিখেছেন, ''গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত চামড়ার দাম কমলেও, জুতার কিন্তু বেড়েই চলেছে। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতোই। পশুর ক্রয়মূল্যের সঙ্গে তার চামড়ার দামের সামঞ্জস্য নেই। আবার চামড়ার সঙ্গে জুতার বিক্রির মূল্যের সঙ্গতি নেই। এ বছর কোরবানির সময় প্রতি বর্গফুট কাচা চামড়ার মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫ টাকায়, ঢাকার বাইরে ৩৫টাকা। অর্থাৎ একেকটি গরুর চামড়া হাতবদল হয়েছে তিনশো থেকে আটশো টাকার মধ্যে।
সূত্র জানায়, গত বছরের তুলনায় এবছর চামড়াপ্রতি দাম কমেছে প্রায় ৪শ থেকে ৫শ টাকা। আর প্রতি পিস ছোট চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৩শ থেকে ৪শ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৬শ থেকে ৭শ টাকায়। মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫শ টাকা, যা গতবছরও বিক্রি হয়েছে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা দরে।
এছাড়া বড় চামড়া ৮শ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর বিক্রি হয়েছে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা করে। এদিকে, ঈদের দিন বিকাল থেকে সারা দেশের কাঁচা চামড়া রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় আসতে শুরু করেছে। আড়তদারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠেছে লালবাগের শায়েস্তা খান, রাজ নারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন রোড।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন। তবে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় এবার ৫০ শতাংশ আড়তদার কমে গেছে। কিন্তু পশু কোরবানি এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পোস্তায় এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি কাঁচা চামড়ার বেচা-কেনা।
কাঁচা চামড়ার দাম কমার বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, কাঁচা চামড়া দাম কমার কয়েকটি কারণ রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো-বিনিয়োগে সংকট। ব্যাংক আগের মতো চাহিদার তুলনায় অনেক কম অর্থায়ন করছে। এছাড়া যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া নিয়ে আসেন তারা বিক্রির জন্য তাড়াহুড়ো করেন। চাইলে তারা লবণ দিয়ে তিন মাস রেখে দিতে পারেন। কিন্তু তা না করে বিক্রি করতে চান। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের চামড়া খাতে।
পোস্তায় চামড়া নিয়ে আসা একাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী জানান, এখন চামড়া ভালো আছে, রাতে এ চামড়ার মান নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আরো দাম কমে যাবে। এমন আশঙ্কার পাশাপাশি সঠিক নিয়মে চামড়া সংরক্ষণ না করার কারণে এবছরও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। হয় নষ্ট করতে হবে নতুবা নামমাত্র দামে তাদের দিয়ে যেতে হবে।
কাঁচা চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী সুমন বলেন, সকাল ৮টায় যে পশুগুলো কোরবানি হয়েছে সেগুলোর চামড়া পোস্তায় আনতে বেশি সময় লাগেনি। তবে এখানকার আড়তদাররা সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কিনতে রাজি হচ্ছে না। তারা অল্প দাম দিতে চায়। আনুমানিক ২৫ বর্গফুট হবে এমন ৪টি চামড়া গড়ে ১২০০ টাকা করে কিনেছি। সরকারি দাম ফলো করা হয়েছে। চামড়ায় যে বিনিয়োগ করেছি, সেই অনুসারে আড়তদারেরা চামড়া কিনতে রাজি নন।
আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, আড়তদারেরা নির্ধারিত দামের চেয়ে কমে চামড়া কিনছেন। এখন চামড়া বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ করে চামড়া কিনে আর্থিক সংকটের কবলে পড়তে হবে। আমরা চামড়ার জন্য যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছি, বিক্রি করতে দেরি হলে পুরো টাকাই লোকসান হবে। তাই লোকসান কমাতে তাদের কাছেই চামড়া বিক্রি করতেই হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এ বছর প্রায় ১ কোটি কোরবানির পশুর চামড়া আমদানি করার টার্গেট আছে। তবে আমরা রাজধানী থেকে প্রতি বর্গফুট লবণছাড়া চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় সংগ্রহ করছি। এ হিসাবে ছোট প্রতি পিস চামড়ার দাম ৩শ থেকে ৪শ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫শ থেকে ৬শ টাকা এবং বড় দুই হাজার থেকে ২৫শ বর্গফুট চামড়ার দাম ৮শ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, সব মিলিয়ে এবছর চামড়াখাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে। ট্যানারি মালিকরা সাড়ে তিনশ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রেখেছেন। অন্যান্য ঈদের সময় ১০ থেকে শতাংশ নগদ টাকা দিলেও এবার সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন টাকা পেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা টাকা না পেলে চামড়া কিনবেন কিভাবে।
ফলে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। যারা টাকা পেয়েছেন তারা চামড়া কিনছেন। তাই এবছর ২৪৫ জন আড়তদারের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন আড়তদার চামড়া কিনতে পারছেন। এছাড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থান থেকে বেশি দামে চামড়া কিনছেন। তারা একদিকে চামড়ার সিলেকশন বোঝেন না, অপরদিকে, বর্গফুট না বুঝে পশুর চামড়া ক্রয় করছেন। তাই আড়তদারদের দোষারোপ করছেন।
টিআর/
আরও পড়ুন