ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে বেগম মুজিব

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৫০, ১৩ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৪:৩৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

[জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সহধর্মিণী গম ফজিলাতুন্নেছা। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রেণু নামেই ডাকতেন। তিনি ছিলেন একজন নিরহঙ্কার, নির্লোভ, ত্যাগী, কষ্টসহিষ্ণু, প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ বধূ এবং আদর্শ মাতা। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, বড় নেতা এবং দেশের স্থপতি হওয়ার পেছনে প্রেরণাদায়িনী ছিলেন বেগম মুজিব। কারাগারে বঙ্গবন্ধু যাতে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন তার জন্য নিজের জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। পাঠকদের উদ্দেশে বেগম ফজিলাতুন্নেছা রেণু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ডায়রিতে যা লিখেছেন তা তুলে ধরা হলো।]

বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর সহধর্মিণীর কথা ডায়েরিতে লিখেছেন যা পরে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী”। বললম, “লিখতে যে পরি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।

আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কতৃর্পক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলেগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।”

বঙ্গবন্ধু তাঁর বিয়ে সম্পকে ডায়রিতে লিখেছেন, “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।”

স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া প্রসঙ্গে ডায়েরির এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “টাকার বেশি প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামে বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।”

অন্য জায়গায় লিখেছেন, “ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাবে। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এক বৎসর মাহিনা দেই নাই। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। কাপড় জামাও নতুন করে বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। দিল্লি ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠিও দিয়েছিলাম। আব্বাকে বলতেই হবে।  আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হল। কিছুই বললেন না। পরে বলেছিলেন, “বিদেশ যখন যাও বেশি কাপড় নেওয়া  উচিত নয় এবং সাবধানে থাকতে হয়।” টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, “কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালভাবে করতে  হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।” আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।”

ডায়েরিতে বেগম মুজিব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, “একদিন আমার হাতের কব্জি সরে গিয়েছিল, পড়ে যেয়ে। ভীষণ যন্ত্রণা, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। আমাকে বোধহয় মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। একজন নতুন ডাক্তার ছিল জেলে। আমার হাতটা ঠিকমত বসিয়ে দিল। ব্যথা সাথে সাথে কম হয়ে গেল। আর যাওয়া লাগল না। বাড়িতে আমার আব্বা ও মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। রেণু তখন হাছিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাছিনা তখন একটু হাঁটতে শিখছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়ে ছিলেন। রেণু জানত, আমি সিগারেট খাই। টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।”

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাছিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।”

জেলে থাকতে থাকতে বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন ফরিদপুরের জেলে, তাঁকে দেখতে বাড়ির লোকজন গিয়েছিল। সেই দিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধু ডায়রিতে লিখেন, “বাড়ি থেকে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে মেয়েরা মামার বাড়ি, আর পুরুষরা নৌকায় থাকতেন।  রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব  খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার  কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল।”

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি