বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাংলার ইতিহাসের অনন্য দলিল
প্রকাশিত : ১১:৪৩, ১৭ মার্চ ২০২০
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে (২০১২)। বইটি প্রকাশের পর বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। বইটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে উপদেষ্টা হিসেবে ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন যুক্ত ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ, আমি এবং অধ্যাপক ফখরুল আলম নিয়মিতভাবে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করে প্রকাশের উপযোগী পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি। বঙ্গবন্ধুর লেখা পাণ্ডুলিপি উদ্ধার এবং যত্নের সঙ্গে গভীর মমতায় রক্ষা করে সম্পাদনা ও প্রকাশনার মূল ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ছোটো বোন শেখ রেহানাও এ কাজে ছিলেন তার সহযোগী।
২০০২ সালের শেষ দিকে আমরা যখন এই কাজ শুরু করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। আমি যখন এই কাজে যুক্ত হই তখন বিরোধী নেতার সরকারি বাসভবন থেকে তিনি সুধা সদনে উঠে এসেছেন। আমরা সপ্তাহে তিন-চার দিন কাজ করতাম। কাজ হতো আনন্দময় ও আন্তরিক পরিবেশে। তবে কাজ করতে হতো খুব সিরিয়াসলি এবং সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পাণ্ডুলিপি তো আর কারো নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সকলে মিলে যখন কিছু কিছু করে পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল তখন তত্কালীন বিরোধী দলের নেত্রী নিজেই তা কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিতেন। তার এই নিষ্ঠা এবং আন্তরিক প্রয়াস ও প্রযত্ন আমাদের অভিভূত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যের ইতিহাসের ধারায় এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইটিতে বঙ্গবন্ধু তার পারিবারিক ইতিহাস এবং তার বাল্যকাল থেকে রাজনৈতিক জীবনগঠন এবং যে আনুপূর্বিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন (সে সম্পর্কে স্বকীয় ভাষায় তার জীবনকথার ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন তা বাঙালি জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ইতিহাসের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রটির উত্সমূলকে বুঝতে গেলে এ বইটি পাঠ অপরিহার্য। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য ও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কৌশল সম্পর্কেও জানা যাবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মপূর্ব পারিবারিক ইতিহাস দিয়ে শুরু করে তার বাল্যকাল, স্কুলজীবন, গোপালগঞ্জে বাংলার তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়ের ইতিহাস এবং তার ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠার নানা পর্যায় এত সুন্দর, আকর্ষণীয় ও অনবদ্য ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন—যা পড়ে বোঝা যায় তিনি যে একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ কিংবা অসাধারণ দক্ষ কর্মী ছিলেন শুধু তা-ই নয়, একজন নিপুণ লেখক হিসেবেও এ বইয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন। তার প্রাণবন্ত জীবনবোধের দীপ্তিতে উজ্জ্বল এ বইটি সেজন্যই আমাদের বিশিষ্ট লেখক-গবেষক এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রশংসাধন্য হয়েছে। এর পাঠক শুধু যে বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন সম্পর্কে জানবেন তা-ই নয়, তার অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের গভীরতা, সাহস, যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা, সুরুচি এবং দুঃখী মানুষের প্রতি সীমাহীন দরদ-সহমর্মিতার কথাও অনুধাবন করতে পারবেন।
দেখা যাবে যে, তিনি কখনোই আবেগে আক্রান্ত হয়ে ভেসে যাননি, প্রতিটি ঘটনাকেই তিনি তার মতো করে বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এবং তার সে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাস্তবতার সঙ্গে ছিল সংগতিপূর্ণ। কারণ তিনি ইতিহাসের পটে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে যে আন্তরিকতায় তুলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে একজন তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিকের রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। সেই সঙ্গে দেখা যাবে যে, কোনো ঘটনাকে তিনি একপেশেভাবে দেখেননি। ঐ ঘটনার যে অন্য দিকও থাকতে পারে, সে দিকটাও তার লেখায় পরিস্ফুট হয়েছে।
তিনি যখন মাদারীপুরে স্কুলের ছাত্র তখন রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসেন নেতাজি সুভাষ বসুর সমর্থক স্বদেশি আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। বিগত শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে এক জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় রূপান্তরিত হলেন। লক্ষ করার বিষয়, তখন থেকেই তিনি শুধু মেঠো বক্তৃতা এবং রাজনৈতিক স্লোগানে আচ্ছন্ন ছিলেন না। আবুল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মীদের আর্থসামাজিক প্রশিক্ষণ এবং নিজস্ব একটি পত্রিকার মাধ্যমে কর্মসূচিভিত্তিক আধুনিক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করেন। এই লক্ষ্যেই আবুল হাশিম সাহেব ‘মিল্লাত’ নামে কলকাতা থেকে একটি প্রগতিশীল সাপ্তাহিক খবরের কাগজ প্রকাশ করেন। তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কাগজ বিক্রি করতেন। রাজনীতির প্রতি কতটা কমিটমেন্ট থাকলে এটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়।
নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকৃতিগতভাবেই যে শেখ মুজিবের ভেতরে ছিল তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বিজ্ঞ নেতার চোখ এড়ায়নি; ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরকালে তিনি তার নোটবুকে সেদিনই তাই লিখে নিয়েছিলেন—‘শেখ মুজিবুর রহমান’, পরবর্তীকালে সম্ভাবনাময় এক নেতা। কলকাতায় গিয়ে তরুণ মুজিব যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে এলেন সেখানেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে একজন বিখ্যাত বাঙালি ছাত্রনেতা হিসেবে তার নাম সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ১৯৪৩ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আর তার দুই বছর পর ইসলামিয়া কলেজের সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি কলকাতা ছাড়াও দিল্লি করাচিতে যখন সেখানেই রাজনৈতিক যে বিষয়ে যোগদান করেছেন—সেখানেই স্বকীয় নেতৃত্বের গুণাবলির স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি যে কাজটি বিশেষভাবে করার চেষ্টা করতেন তা হলো—পূর্ব বাংলা যাতে উপেক্ষিত না হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন—তিনি যেন বাংলার কথা বলেন। অবিভক্ত ভারতের কলকাতা এবং বিহারে দাঙ্গা হওয়ার পর তিনি যেভাবে রাতদিন দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় কাজ করেছেন তা লক্ষ করার মতো। সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধেও তার অবস্থান ছিল পরিষ্কার। ১৯৬৪ সালে ঢাকার দাঙ্গাপীড়িতদের ত্রাতা ছিলেন শেখ মুজিব। তার রাজনৈতিক দর্শনেও এই বিভেদের, ধর্মীয় হানাহানি এই নরহত্যার কোনো স্থান নেই।
অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া একটি দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়—এই ছিল তার মূল রাষ্ট্রদর্শন। সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিম প্রমুখ বৃহৎ বাংলার যে-আন্দোলনের জড়িত ছিলেন সেটা ব্যর্থ হওয়ার পরই মূলত তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সঙ্গে যুক্ত হলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই তত্কালীন কেন্দ্রীয় নেতাদের বিশেষ করে লিয়াকত আলী খানদের আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝে ফেললেন যে, ‘আমরা প্রতারিত হয়েছি’। স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে আসার আগে কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোটেলে তার ভগ্নিপতি ও রাজনীতিক আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে তাই বলেছিলেন, ‘আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তাতে পূর্ব বাংলার কোনো কল্যাণ হবে না। অতএব আমাদের আবার নতুন করে সংগ্রাম করতে হবে।’
সেই সংগ্রামের অভিপ্রায় নিয়েই তিনি ঢাকায় এলেন এবং ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি নইমুদ্দিন আহমদকে কনভেনর করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলেন। অলি আহাদ এই মুসলিম শব্দ থাকায় সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে সভ্য হতে অস্বীকার করল। বঙ্গবন্ধু বলছেন : আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম : ‘এমনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের অবস্থা চিন্তা করতে হবে।...কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি। সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তনে সময় লাগবে।’ একেই বলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতা। এক বছর পরই ১৯৪৯-এর ২৩শে জুন গঠন করলেন পূর্ব পাকিস্তানি আওয়ামী মুসলিম লীগ। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করেন ১৯৫৫ সালে। কারণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কী ভয়াবহ হতে পারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা তার ছিল। সেজন্যই তিনি এবার যথেষ্ট সতর্ক হলেন এবং আজীবন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েই সুপরিকল্পিত সংগ্রামে লিপ্ত হলেন।
অসংখ্য জেল-নির্যাতন ভোগ করে পারিবারিক শান্তি বিসর্জন দিয়ে বহু ত্যাগের মাধ্যমে শেষে তার আজীবনের স্বপ্নের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যারা পড়বেন, তারা একজন দক্ষ লেখকের জীবনকাহিনিতে বাংলার ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটতে পারবেন অবলীলায়। দেখবেন একেবারেই আমাদের সেই পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমানকে; পরবর্তীকালে যিনি বঙ্গবন্ধুরূপে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। তার বক্তৃতা করার ঢং, কথা বলার ধরন এবং শেকড়সংলগ্নতা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের কত মর্মভেদী কথা এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
সেই সঙ্গে জানা যায় তখনকার অজ্ঞাত-অখ্যাত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের হ্যাংলাপাতলা ছেলেটি কীভাবে অসাধারণ রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়ে উঠলেন। এ বই পড়ে মনে হয়, যিনি এ ধরনের আত্মজীবনী লিখতে পারেন, তার পক্ষেই মূলত ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের অমন ভাষণ দেওয়া সম্ভব।
এ বইয়ের মনোযোগী পাঠক বইটি পড়ে বুঝতে পারবেন বইটি আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার রাজনৈতিক পটভূমিগত যেমন ইতিহাস তেমনি শেখ মুজিবের ইতিহাস স্রষ্টা হয়ে ওঠারও ইতিহাস। সেই অসাধারণ নেতার অসামান্য আত্মজীবনী তাই জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এতদিন এটি ছিল আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি, এখন জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে।’
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
আরও পড়ুন