ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ অক্টোবর ২০২৪

শব্দদূষণে অতিষ্ঠ নিকলীর জনজীবন, দ্রুত প্রতিকার জরুরি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০০:২০, ২৩ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১০:১৭, ২৩ আগস্ট ২০২০

বিস্তীর্ণ জলরাশির কোমল হাতছানি, নদীর বুকে হরেক রকম বর্ণিল নৌকার অবিরাম কোলাহল, বর্ষণমুখর দিনের নিরব আবাহন—বর্ষায় এ রকম চোখ জুড়ানো ও হৃদয় নাড়ানো নানা অনুসঙ্গে সজ্জিত হয় কিশোরগঞ্জের হাওরঘেরা নিকলী উপজেলা। 

সম্প্রতি বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সড়কগুলো সংস্কার হওয়ার সুবাদে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগে যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এত দিন বিষয়টি অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে অজানাই ছিল। তবে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে এর রূপের খবর ছড়িয়ে পড়লে নিকলী ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। 

পর্যটকদের সরব পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে বেড়িবাঁধসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়ক, যা এলাকাবাসীর মনে সঞ্চার করে উৎসবের আমেজ।

পর্যটকদের গমনাগমনকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিকলীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত দিন ধরে তারাই উপভোগ করে আসছেন। বিশ্বায়নের এ যুগে কোনো কিছুই আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, এটা উচিতও না। এখানে পর্যটকরা আসবেন, জলকাব্যের গহীনে হারিয়ে যাবেন—এটা তাদের জন্য আনন্দের বিষয়।

হতাশার কথা হলো, পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা (ট্রলার) নিয়ে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে গান বাজানোর ফলে এখানে মারাত্মক শব্দ দূষণ হচ্ছে। 

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর উচ্চশব্দের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হলেও নিকলীর নদীগুলোতে সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একের পর এক আসতে থাকে পর্যটকবাহী এসব ট্রলার। আর এতে লাউড স্পিকার ও মাইকের মাত্রাতিরিক্ত শব্দে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছেন ‘উজান ও ভাটি এলাকার সেতুবন্ধন’ খ্যাত নিকলী উপজেলার মানুষ। 

এ দূষণের কারণে উপজেলার নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শব্দের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশু, অসুস্থ ও বয়স্করা। দিনের বেলায় শিশুদের ঘুম ও পড়াশোনোয় মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির মুখোমুখি তারা। অভিভাবকদের আশঙ্কা, এ অবস্থার সমাধান না হলে বধির হওয়ার মতো অসুস্থতা নিয়ে বেড়ে ওঠবে একটি প্রজন্ম।

অজপাড়া গাঁ হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোর মতো শব্দদূষণে পড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা। 

শোক দিবসেও থামেনি উম্মাদনা:

ট্রলার নিয়ে আসা পর্যটকেরা ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসেও দেদারসে অপ্রাসঙ্গিক গান বাজিয়ে উম্মাদনা সৃষ্টি করে। গোটা দেশে যখন শোকের আবহ বিরাজমান তখন নিকলীর নদীগুলো কাঁপছিল শোকের বিপরীত আয়োজনে। অসহনীয় শব্দে তটস্থ ছিল শিশু-বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষ। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই সেদিন বাসায় বসে বসে অস্থির সময় পার করেন। এছাড়া এলাকাবাসীর অভিযোগ, উচ্চশব্দে গান বাজানোর কারণে নদীতীরবর্তী মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ইবাদাতে সমস্যা হচ্ছে। 

শব্দদূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি:

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শব্দদূষণের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির দেখা দেয়। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃৎকম্প, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, অনিদ্রা (ইনসমনিয়া), মানসিক উত্তেজনা ও উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি), স্ট্রোক ও বিরক্তি সৃষ্টি হয়৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু এবং বয়স্করা৷ শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়, অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিও প্রভাবিত হয় এতে।

অনিয়ন্ত্রিত শব্দে কর্মজীবীদের ভেতরে কাজের দক্ষতা ও মনোযোগ কমে যায়, সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।

শব্দদূষণের আরও কিছু ঝুঁকি:

স্বাস্থ্য বিশষজ্ঞদের মতে, শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, শব্দের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধিতে যেকোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ বেড়ে যায়। আর যদি তা হয় ৬৫ বছরের বেশি বয়সে তাহলে প্রতি ১০ ডেসিবেল বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭ ভাগ করে বাড়তে থাকে! 

অথচ হিসাব করে দেখা গেছে, লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে ১১০ ডেসিবল শব্দ নির্গত হয়, যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

আইনের প্রয়োগ নেই:

দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ বিধিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এর আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যা বললেন:

জানতে চাইলে নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামছুদ্দিন মুন্না বলেন, ‘এটা আমাদের নজরে এসেছে। এটা বন্ধে এরই মধ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। সমস্যা হলো, যারা এটা বাজাচ্ছে তারা যেহেতু নদীপথে আসে সেহেতু ধাওয়া করে অনেক সময় তাদের ধরা সম্ভব হয় না। দুই-একটা ধরে ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ধরনের শব্দদূষণ বন্ধে জনসচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচারণা চালানো হবে। শুধু আইন প্রয়োগ করে তা বন্ধ করা যাবে না। আমরা আশা করি, আমাদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরাও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন।’

জনপ্রনিধিদের বক্তব্য:

জানতে চাইলে নিকলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ. এম. রুহুল কুদ্দুস ভূঞা (জনি) বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার পর্যটক আসার পরিমাণ কমে গেছে। পিকনিক হোক, আনন্দ হোক—এতে কোনো নিষেধ নাই। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মাধ্যমে কারও শান্তি বিনষ্ট করে এটা করা যাবে না। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, এ ধারা অব্যাহত থাকবে। ভাড়ায় চলা অনেক ট্রলার চালকদের কাছে শব্দযন্ত্র থাকে। আমরা ওদেরকেও সতর্ক করেছি। এ ব্যাপারে শিগগিরই একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।’   

এ প্রসঙ্গে নিকলী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কারার শাহরিয়ার আহম্মেদ (তুলিপ) বলেন, ‘বিনোদনের নামে অতিরঞ্জিত কিছু হচ্ছে। মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম বাজাক…, কিন্তু অতিমাত্রার শব্দ তো সমস্যা। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে করতে হবে। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটকরা আমাদের মেহমান। এখানে এসে তারা বিশাল জলরাশির উদার সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। অন্যদিকে তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে নিকলী উপজেলা। কিন্তু তাদের মাধ্যমে শব্দদূষণ হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত, যা অন্য সচেতন পর্যটকদের জন্যও বিব্রতকর। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে বিনোদনের চিন্তা আত্মঘাতী।’

লেখক: ​​​​​ আ. ন. ম. মনির উদ্দিন, গণমাধ্যমকর্মী।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি