ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

একুশে টেলিভিশন দখল ছিলো গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধের বড় উদাহরণ

আব্দুস সালাম, চেয়ারম্যান ও সিইও, একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৩৯, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের প্রথম টেরিষ্ট্রেরিয়াল টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের(ইটিভি) জন্য আমার সংগ্রামটা যেন শেষ হওয়ার নয়।  বার বার স্টেশনটি দখল হয়েছে । জেল খেটেছি। দেশ ছাড়াতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সংগ্রাম ছাড়িনি। সংগ্রামটি আমরা একুশের জন্য। মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য। 

২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর একুশের জন্য একটি কালো দিবস। ওইদিন শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আব্দুস সোবহান গোলাপের নেতৃত্বে এস আলম গ্রæপ ইটিভি দখল করে নেয়। তার প্রায় এক বছর আগে  রাতে আমি ইটিভি ভবন থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে আটক করা হয়। আমি প্রায় তিন বছর জেলে ছিলাম।

আমাকে আটকের পর আমার বিরুদ্ধে সাতটি মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। রিমান্ডে নেয়া হয়। জেলে নেয়ার পর আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয় ইটিভির মালিকানা নিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমার  আঙ্গুল কেটে ফেলা হলেও কোনো কাগজপত্রে সই করবনা। আমাকে মাথা নয়োতে ব্যর্থ হয়ে তারা নানা ধরনের জাল কাগজপত্র তৈরি করে। আমার জেল জীবনের  প্রায় এক বছরের মাথায় ওই জাল কাগজপত্র দিয়ে ইটিভি দখল করা হয়। আসলে এর নেপথ্যে ছিলেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। 

আমি চেষ্টা করতাম সব সময়ই স্বাধীন সাংবাদিকতার। ২০১৪ সালে নির্বাচনে রিগিং করা হয়েছিল,  সেটা ইটিভিতে দেখানো হয়। নির্বাচনে একতরফাভাবে ১৫৪ জনকে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত করা, ভোটে কারসাজির চিত্র নিয়ে আমরা ইটিভিতে ব্যাপক প্রচার করতে থাকি। তখনই শেখ হাসিনা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হন। এরপর আমি বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের লন্ডন থেকে দেয়া বক্তৃতা লাইভ সম্প্রচার করি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি। তখন তারা আমাকে আটকের একটা অজুহাত পেয়ে যায়। ৬ জানুয়ারি  ভোর রাতেই আমাকে আটক করে। আমাকে জেলে নেয় এবং আমার ছোটভাইসহ ইটিভির কয়েকজনকে ডিজিএফআই’র লোকজন আটক করে নির্যাতন চালায়।

আমাকে আটকের পর ইটিভি দখলের প্লট তৈরি করে সরকার। আর সেই ষড়যন্ত্রে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং কিছু সাংবাদিক জড়িত ছিলো।  শেখ হাসিনার তখনকার বিশেষ সহকারী  আব্দুস সোবহান গোলাপের নেতৃত্বে এস আলম গ্রæপ ইটিভি দখল করে নেয় ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর। দখলের আগে তারা সর্বশেষ বৈঠক করে ইটিভির উল্টো দিকে সোনারগাঁ হেটেলে।

ইটিভি দখলে সামনে ছিলো ডিজিএফআই-এর তখনকার কর্মকর্তা কমান্ডার এম সোহায়েল। আর পেছনে কলকাঠি নাড়েন ডিজিএফআই-এর সাবেক মহাপরিচালক জেনারেল আকবর হোসেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলমসহ ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। দখলে জড়িত ছিলেন শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের সাবেক দফতর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মহাসচিব কে এম শহীদুল্লাহ এবং এস আলম গ্রæপের কর্মকর্তারা। কথিত সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল ইটিভির দখলে কথিত সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দেন।

একুশে দখলের পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনে যান আব্দুস সোবহান গোলাপ। মনজুরুল আহসান বুলবুল দখলে সহায়তার পুরস্কার হিসেবে হয়ে যান প্রধান সম্পাদক। নির্বিচারে চাকুররিচ্যুত করা হয় একুশের কর্মীদের। বন্ধ করে দেয়া হয় দেশজুড়ে, মুক্তখবর, জনতার কথা, একুশের চোখসহ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। আর স্টেশনটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি, সম্প্রচার সামগ্রী লুটপাট করা হয়। ইটিভিকে পরিণত করা হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দালালির স্টেশনে।  মুক্ত সাংবাদিকতা বিদায় নেয় ইটিভি থেকে।

এখানে দু:খের সঙ্গে একটি কথা বলতে চাই। আমাকে আটকের পর সারাদেশে একুশের সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করলেও আওায়ামীপন্থী সাংবাদিক সংগঠন বা নেতারা কোনো প্রতিবাদ করেননি। উল্টো তাদের অনেকেই আমি যাতে জেল থেকে বের হতে না পারি তার ষড়যন্ত্র করে।

আর ওই জিজিএফআইর কর্মকর্তারা তখন পদোন্নতি পান। সোহায়েলকে করা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান । যদিও  ৫ আগস্টের পর তিনি এখন কারাগারে আছেন। আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম এখনো সেনাবাহিনীতে বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি এখন  ব্রিগেডিয়ার।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ যেমন মুক্তি পায় তেমনি দখল হওয়া ইটিভিও মুক্তি পায়। ওই দিন একুশের কর্মীরা আমাকে একুশে টেলিভিশনে নিয়ে আসেন। জাতি মুক্তির স্বাদ পায়। একুশে টেলিভিশনও মুক্তির স্বাদ পায়। আমরা এখন নতুন যাত্রা শুরু করেছি।  আমার অঙ্গীকার হলো ইটিভি  স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে   এগিয়ে যাবে। একুশের যে সংগ্রামী চরিত্র তা বহাল থাকবে।

শেখ মজিবুর রহমানও  বাকশাল কায়েম করে দুই-একটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তার মেয়ে শেখ হাসিনাও একুশে দখল করে একই পথে হেঁটেছেন। একুশে দখল ছিলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় হামলা। কিন্তু স্বৈরাচাররা টিকে থাকেনা।  বাংলাদেশের এই নতুন যাত্রা , একুশের নতুন যাত্রা তার প্রমাণ।

২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল একুশের  আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ২০০২ সালেও ইটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ ৫ বছর সংগ্রাম করে আমরা ফের অন-এয়ারে আসি ২০০৭ সালে। আর সর্বশেষ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কোপানলে পড়ে ২০১৫ সালে। কিন্তু একুশে কখনো মাথা নেয়ায়নি। আমার সংগ্রাম কখনো বন্ধ হয়নি।  স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য একুশের এই সংগ্রাম কখনোই থামবেনা। আমাকেও থামানো যাবেনা।

লেখক: , চেয়ারম্যান ও সিইও, একুশে টেলিভিশন
এসএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি