ঢাকা, বুধবার   ০৬ নভেম্বর ২০২৪

একজন ‘ভাল নারী’ ও তার পেশা

প্রকাশিত : ১৪:৫৯, ১২ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৫৩, ১৪ মার্চ ২০১৮

লেখক: নাজমুন নাহার তুলি

লেখক: নাজমুন নাহার তুলি

“ শোন মেয়ে তুমি চাকরি করলে স্কুল বা কলেজে শিক্ষকতা করো নয়তো করার দরকার নেই, বাসায় বসে থাকো। বেশী হলে সরকারী চাকরি। সন্ধ্যা করে ঘরে ফিরবা এসব মানুষ ভাল বলেনা। বিয়ের প্রস্তাব আসলেও মেয়ে শিক্ষকতা করে শুনলে ছেলেপক্ষ আগ্রহ দেখায়। মানুষ সম্মান করে” এই কথাগুলো আমাদের দেশের বেশীরভাগ বাবা মায়েদের । মেয়ের পরিবারের একমাত্র চিন্তা মেয়েকে ভালভাবে সুপাত্রস্থ করা। কিছু কিছু মা বাবা এমন থাকেন তারা যেন মেয়ের বিয়ে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারেন না। একজন মেয়ের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো বিয়ে।


ছোট বেলা থেকেই তাকে এমন শিক্ষা দেয়া হয় যেন পড়ালেখা শুধু ভাল পাত্রের সাথে বিয়ের জন্য। এখান থেকেই শুরু হয় একটা মেয়ের চিন্তার সীমাবদ্ধতা। নিজের গন্ডির বাইরে চিন্তা করতেই সে তখন ভুলে যায়। ক্রমেই তার নিজের ধারণা হয় যে, আমার কাজ-ঘর সংসার আর সন্তান সামলানো। আর এতেই আমার মহত্ব ও সফলতা নিহিত আছে। এর চেয়ে বেশী আর কি আছে আমার জীবনে। আমাদের দেশের বেশীরভাগ নারী মনে করেন তার জন্য উপযুক্ত কাজ ঘরের কাজ। তারা ধরেই নেন, বাইরের কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব নয়।

সমাজের মানুষ বলেই দেয়, চাকরি করে ঘর সামলানো অনেক কঠিন এসব তুমি পারবেনা। কিছু মানুষতো কয়েক কাঠি সরস। তাদের ভাষ্যমতে গৃহিনী বা ঘর সামলানো একটি মহৎ পেশা। এই স্বান্তনা পুরস্কার নিয়েই হাসিমুখে নিজের পরিচয় বিসর্জন দিয়ে দেন অনেকে। এসব পড়ে অনেক মেয়েরাও নিশ্চয়ই ভাবছেন ‘কি ফালতু আর বাজে নারীবাদী টাইপের কথা” । আসলেই এসব বাজে কথা। কারণ আপনি বলতেই পারেন, আমার চাকরি করতে ইচ্ছে করেনা, ভাল লাগেনা , ঘরের কাজ ভাল লাগে তাই করি। এটা আমার ইচ্ছা। কিন্তু বিশ্বাস করুন কখনো আমি কোন ছেলেকে এরকম ‘ভাল লাগেনা চাকরি করতে, বসে বসে খাব’ এরকম চিন্তা করতে দেখিনি।
একজন ভাল মা, ভাল সহধর্মিণী, ভাল মেয়ে হতে হলে কি হতে হয়? কিভাবে চলতে হয়? কিভাবে কথা বলতে হয়? তার পেশা কি হলে তাকে ভাল মেয়ে বলা যায়? ভাল মেয়ের সংজ্ঞা কি? “মেয়েটা খুব ভাল” বললেই কেমন আদল চোখের সামনে ভেসে উঠে?


পুরুষশাষিত সমাজের জন্মলগ্ন থেকেই নারীকে দেখা হয় পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন পুরুষ নারীকে যেভাবে দেখতে চায় সেভাবেই নারীর আচার আচরণ পুরুষের সুবিধার্থে তৈরি করা। কিছু নিয়মের ছাঁচে ফেলে তারা নারীকে দেখতে বেশী অভ্যস্ত। অতিপুরনো সেই ফাঁদে নারীরাও আজ জড়িয়ে গেছেন ভীষণভাবে। নারীবাদ নিয়ে এত উচ্চবাচ্য কিন্তু বারবার পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ার অভিন্ন লক্ষণ মাত্র। যেখানে স্বয়ং পুরুষেরা নারীপক্ষের শুভাকাঙ্খী হিসেবে মুখোশ পরে থাকেন।


দশভূজা দেবী হয়ে চারিদিক সামলানো ঘরে বাইরে নারীকে দেখলে আমোদ বোধ করি বোধহয় সকলেই। সকাল বিকেল খেটে টাকা রুজি করা নারী যখন সুনিপূণভাবে ঘর সামলায় তখনই তিনি হয়ে ওঠেন অনন্যা। কোন এক কাজ করে কখনো সমাজের চোখে ভাল নারী হয়ে উঠতে পারেনি নারী। প্রারম্ভ থেকে পরিচালিত নিয়ম নীতি উপেক্ষা করলেই তার কপালে জোটে গঞ্জনা। সময় বদলে ধীরে ধীরে পুরুষতন্ত্রের কালো হাত পড়েছে এখন নারীর পেশায়। বিভিন্ন ছাঁচে তৈরি করা ‘নিরাপদ’ পেশাই হল নারীর জন্য উপযুক্ত। এখন মূল কথা হল নিরাপদ পেশা বা নারীর জন্য উপযুক্ত পেশা বলতে আমরা কি বুঝি? সাধারনত পুরুষতন্ত্রের ভাষায় ‘নিরাপদ’ পেশা মানে হল যে পেশা নারীর সামগ্রিক জীবনের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। যে পেশা নারীকে অবাধ সময় দেয় বাচ্চা লালনপালন ও সংসার সামলানোর। হুমায়ূন আজাদ যথার্থ বলেছেন, “ গৃহ, প্রেম, বিবাহ, সন্তান, স্বামী মাতৃত্ব এসবেই নারীর সুখ নিহিত এরকম অপপ্রচার করেছে পুরুষ এবং তা সফল” ।

অনেকে বেশ গর্বের সহিত মায়ের পেশা লিখেন গৃহিণী। একজন মানুষের পেশা গৃহিণী কিভাবে হয়? উনি কি মাস শেষে টাকা পান? লিভ নিতে পারেন? প্রমোশন হয়? কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়? অপরদিকে একজন পুরুষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে উন্নত থেকে উন্নততর করা। নিজের সামগ্রিক পেশা জীবনে সফলতা না আনতে পারলে সে ‘ভাল সমর্থ পুরুষ’ নয় । অপরদিকে নারীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংসার যাপন এবং শুধুই সংসার যাপন। তাই শিক্ষিত অনেক পরিবারের মেয়েকেও শুনতে হয় ‘মেয়েকে ভাল করে পড়াশোনা করিয়েছি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য” এখানে মেয়ের পড়াশোনার ও মুখ্য উদ্দেশ্য ভাল বিবাহ ও ভাল মা হওয়া, মানুষের মত মানুষ হওয়া কিংবা নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য নয়। গৃহকর্ম থেকে শুরু করে কৃষিকাজ, সন্তান লালন-পালনসহ সাংসারিক ও উৎপাদনশীল সব কাজে নিয়োজিত নারীর কাজকে সর্বদা হেয় করা হয়। নিজের পছন্দের পেশা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বাঁধা তো চিরন্তন ।

পুরুষ নারীকে যেমন পেশায় দেখতে চায় সেই পেশাই নারীর জন্য আদর্শ বলে গণ্য করা হয়। পেশা নির্বাচনের পূর্বশর্তই হলো পরিবারের কাজ সেরে সময় পেলে বাহিরে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। আমাদের দেশের ৯০ ভাগ মা বাবা কে দেখি মেয়ের চাকরীর ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই চিন্তা করে নেন মেয়ের পেশা হলো অপশনাল। করলে করবে না করলে করবেনা। বাচ্চা হওয়ার আগে চাকরী করা যাবে, এরপরে বাদ দিয়ে দিলেই হবে। বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ির সেটা পছন্দ কিনা সেটার উপর ও নির্ভর করে মেয়ের পেশা। অথচ একজন ছেলের বেলায় কখনো এমন করে কখনো কেউ চিন্তা করেনা। একটা ছেলের জন্মই তার সুন্দর সুদৃঢ় ক্যারিয়ার গড়া অনেক টাকা ইনকাম করা, নিজের পরিবারের দ্বায়িত্ব নেয়া। আর সবথেকে বাস্তব সত্য হলো বিয়ের আগে একজন পেশাজীবি বা শিক্ষিত নারীর চিন্তা করতে হয় ‘আমাকে ওই পরিবার চাকরি করতে দিবে তো?’ যে পরিবার মেয়েকে বিয়ের পরেও মেয়েকে চাকরি করতে দেয় তারা আবার সমাজের মহান শ্রেনির। ঘরের বউকে তারা যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছে। এসব পরিবারেই আবার নারী কোন কিছুতে মতামত দিতে চাইলে অনেকেই বলে থাকেন ‘ দুটো টাকা রুজি করে বলে দেখো কি দেমাগ’।


সবকিছু থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সাম্যের মত ফালতু কথা না বলে বলতে পারি সবাই তার নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাক। যার যতখানি আছে তার সবটুকু নিয়ে এগিয়ে যাক তার নিজের লক্ষ্যে। বেঁধে দেয়া নিজস্ব কোন ছকে নয়, বরং মুক্ত পৃথিবীতে সে বেছে নিক নিজের মন মত পেশা। আমরা সেইদিনের প্রত্যাশা করতেই পারি যেদিন নারী তার ভাললাগা , আগ্রহ, প্যাশন এর জায়গা থেকে নিজের পেশা নিজে বেছে নেয়ার মুক্ত খোলাপথ খুঁজে পাবে। স্বাধীনতা কেউ তাকে দিয়ে দিবেনা , সমাজের সকল রক্ষণশীল নিয়ম স্বাভাবিকভাবেই সেদিন ভেঙ্গে যাবে যেদিন নারী নিজে উপলব্ধি করবে তার আসলে নিজের স্বতন্ত্র সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য তাকে কোন পথ বেছে নিতে হবে।

 

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি