যেভাবে জন্ম হলো একটি পতাকার
প্রকাশিত : ১৮:০৭, ২৫ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১০:২৯, ৪ এপ্রিল ২০১৮
ইউসূফ সালাহউদ্দীন। ফাইল ছবি
আমি ইউসূফ সালাহউদ্দীন। ১৯৬৯-৭০ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আহসানউল্লাহ হলের ২০৪ নং কক্ষে থাকতাম। বাংলাদেশের পতাকা তৈরিতে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০৪ নং কক্ষে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা তৈরি করা হয়। এই তথ্য সঠিক নয়। আমি ১৯৮৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী জীবন যাপন করছি। যারা এই (২০৪ নম্বর কক্ষে পতাকা তৈরির) তথ্য দিচ্ছেন, তাদের তথ্যের উৎস কি আমি জানি না। তবে আমাদের আজকের ও আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস রেখে যাওয়া জরুরি। সেই তাড়না থেকেই লিখতে বসলাম।
আমার আহসানউল্লাহ হলের ২০৪ নং কক্ষ ১৯৬৯-৭০ সালে কার্যত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এই কক্ষেই ছাত্রলীগের স্বধীনতাপন্থী (নিউক্লিয়াসের) নেতাদের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়েছে। তবে আমার কক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং এটা তৈরিও হয়নি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিবন্ধে এবং ফেসবুকে পোষ্টিং দেখি যেগুলোতে বাবু শিবনারায়ন দাসকে অর্থাৎ আমার শ্রদ্ধেয় শিবুদাকে বাংলাদেশের পতাকার নকশাকার কিংবা রূপকার হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এবার একটি জাতীয় দৈনিকে এক নিবন্ধে জনাব ডা: এম এ হাসান ইউসূফ সালাহউদ্দীন, অর্থাৎ আমাকে এবং জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশকে বাংলাদেশের পতাকার ডিজাইনার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর কোনোটাই সঠিক নয়।
`ফেব্রুয়ারী ১৫ই বাহিনী` যেটাকে সবাই `জয়বাংলা’ বাহিনী` বলে উল্লেখ করে থাকে সেই বাহিনীর পতাকা তৈরিতে ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল তাঁদের একজন হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৭০ এর ৬জুন রাতে তৎকালীন ইকবাল হল, বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের নীচতলার ১১৮ নং কক্ষে যৌথ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পতাকার নকশা ঠিক করা হয়। তাতে মুখ্য ভুমিকা ছিল শহীদ কাজী আরেফ আহামদের এবং নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও মরহুম আবদুর রাজ্জাক। আর এই সবকিছুর স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এছাড়া পতাকা তৈরিতে অন্যান্য যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন বা যারা শ্রম দিয়েছেন তাদের নাম নিম্নোক্ত বিশদ বর্ননায় উল্লেখ করছি।
৬০এর দশকের ৬-দফা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আগুনঝরা দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে একাধিক গোপন ও কিছু কিছু প্রকাশ্য সংগঠন গড়ে উঠে। ঢাকাতে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে ৬০ দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬-দফা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ৬৯ এর গনঅভ্যূত্থানের অভিজ্ঞতায় শানিত ছাত্রলীগের একাংশের উদ্যোগে এমনি একটি সংগঠনের পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাদিবস স্মরনে এই বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ই বাহিনী’ যেটাকে আজকাল ব্যাপকভাবে “জয়বাংলা বাহিনী” হিসাবে উল্লখ করা হয়ে থাকে। বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় বাহিনী পতাকার। যেটাকে ইংরেজীতে বলা হয় ‘রেজিমেন্টাল কালার’। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৭০ সালের ৭ জুন ৬-দফা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগ আয়োজিত সমাবেশের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকে বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিবাদন প্রদান ও বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে বাহিনীপতাকা গ্রহণের মাধ্যমে এই বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৬ জুন রাতে পতাকা তৈরি নিয়ে সভা বসল সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৮ নং কক্ষে। এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব আর শাহজাহান সিরাজের নামে। সভায় ছিলেন কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, শিব নারায়ন দাস এবং আমি। সভায় অবস্থান না করে যারা পতাকা তৈরির জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ সহিদুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, গোলাম ফারুক, রফিকুল ইসলাম ওরফে লিটল কমরেড ও কামরুল আলম খান ওরফে খসরু অন্যতম। সভায় কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাবের উপর আলাপ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, শহীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত তারই প্রতীক। আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ সোনালি আঁশের রঙে হবে যার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র হবে তারই প্রতীক।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম। খসরুভাই কয়েকজন ছাত্রকর্মীকে নিয়ে গেলেন বলাকা সিনেমা হলের তিনতলায় এক বিহারি দরজির দোকানে। বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার কাপড়। এখন হলো আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো। তিনি বললেন ‘আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না’।
কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব। আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল) ৩০৮ নং কক্ষে। থাকতেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। রফিকুল ইসলাম নিউমার্কেটে বন্ধুর দোকান থেকে রং আর তুলি যোগাড় করল। নিয়ে ফিরলাম সবাই ইকবাল হলের ১১৮নং কক্ষে।
বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার কেটে লাল বৃত্তের উপর বসিয়ে তাতে সোনালী রং লাগিয়ে দিলেন। হয়ে গেল বাংলাদেশের মানচিত্র। তৈরি হয়ে গেল বাহিনী পতাকা। পতাকাতৈরির সঙ্গে জড়িত যাদের নাম আমি উল্লেখ করেছি তাঁরা ছাড়াও আরও অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এই বাহিনী সংগঠিত করার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মাঝে আফম মাহবুবুর হক, আফতাবউদ্দীন আহমদ, রেজাউল হক চৌধুরী, স্বপনকুমার চৌধুরী, বদিউল আলম, রায়হান ফেরদৌস, বিপ্লব রায়, আবদুল্লাহে সানি, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুল হক, নজরুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ অন্যতম।
এখানে বলা প্রয়োজন যে উল্লেখিত নামের বাইরেও আরও অনেকেই এই কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন যাঁদের অনেকের আজ ৪৭ বছর পর আমার স্মরণে নেই। পরদিন অর্থাৎ ৭ই জুন সকালে আমরা বাহিনীর সদস্যরা সার্জন্ট জহুরুল হক হলের প্রাঙ্গনে জমায়েত হলাম। সেখান থেকে মিছিল করে আমরা পল্টন ময়দানে গেলাম। সেখানে মঞ্চে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জ্ঞাপন শেষে আসম রব বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে উপরোল্লিখিত বাহিনীপতাকা গ্রহন করেন। এই পতাকা নিতেই আমরা মুক্তি যুদ্ধ করেছি আর পরবর্তীতে এই পতাকাই মানচিত্র বাদ দিয়ে জাতীয় পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন জাতীয় দৈনিকটির প্রতিবেদনে ঢাকা কলেজের ১৯৬৫-৬৭ ব্যাচের ছাত্রলীগ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন খানমজলিশ, ইউসূফ সালাহউদ্দীন, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী ফিরোজ শাহ, আবদুল্লাহ সানি ও গোলাম ফারুকের সমন্নয়ে গড়া যে গোপন সংগঠনের কথা বলা হয়েছে তা সঠিক। আমরা এই সংগঠনের নাম দিয়েছিলাম ‘বাংলা মুক্তি জোট (বামুজ)’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এরকম অনেক সংগঠন তখন সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল। তবে বামুজের সঙ্গে পতাকা তৈরির কোনো সম্পর্ক ছিল না।
লেখক: ইউসূফ সালাহউদ্দীন
সাবেক সভাপতি, বুয়েট ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান।
/ এআর /
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।