ভালোবাসা এবং ভালোবাসা
প্রকাশিত : ০০:১৩, ৩০ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৭:১৮, ৩০ মার্চ ২০১৮
মার্চ মাসের তিন তারিখ শনিবার বিকেলে যখন আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের তৈরি করে আনা রোবটদের যুদ্ধ দেখছি ঠিক তখনই হঠাৎ করে মনে হলো আমার মাথায় বুঝি “আকাশ ভেঙ্গে” পড়েছে। বড় কোনো দুঃসংবাদ পেলে আমরা বলি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তবে এটি পুরোপুরি আক্ষরিক। মনে হচ্ছে মাথার উপর সত্যি কিছু ভেঙ্গে পড়েছে একবার, দুইবার, বারবার। কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না, মানুষের চিৎকার হই চই তার মাঝে আমি উঠে দাড়ালাম। বুঝতে পারলাম যেটাই ঘটে থাকুক সেটা শুধু আমাকে নিয়ে। মঞ্চ থেকে আমি নিচে তাকিয়েছি, ছাত্রছাত্রীরা আতংকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছে। একজন ছত্রীর চোখে অবর্ণনীয় আতংক, সে দুই হাতেমুখ ঢেকে চিৎকার করছে।
আমি তাদের শান্ত করারা চেষ্টা করলাম, হাত নেড়ে বললাম, “আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি” কিন্তু আমার কথায় কোনো কাজ হলো না। নিচে দাড়ানো ছেলে মেয়েরা চিৎকার করতেই থাকলো। আমি মাথায় হাত দিলাম এবং রক্তের উষ্ণ ধারা অনুভব করলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম ভায়নক কিছু একটা ঘটে গেছে, কেউ একজন আমাকে মেরে ফেলার জন্যে আক্রমণ করেছে।
সেই মূহুর্তের অনুভূতিটি আমি কখনো ভুলব না। অনুভূতিটি ভয়ের নয়, অনুভূতিটি যন্ত্রণায় নয়, অনুভূতিটি হতাশা কিংবা ক্রোধেরও নয় অনুভূতিটি ছিল লজ্জার অনুভূতি। আমি বিস্ময়কর এক ধরণের লজ্জায় কুকড়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হল এই পৃতিবীতে এমন মানুষ আছে যে আমাকে এতে ঘৃণা করে, যে সে আমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে মেরে ফেলতে চায়? আমি কী করেছি?
চারপাশে কী হচ্ছে আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মঞ্চের এক পাশে একজনকে অনেকে মিলে মারছে, পাশে একটা চাকু পড়ে আছে। আমি দুর্বল ভাবে তাকে না মারতে বললাম আমর কথা কেউ শুনতে পেলো কী না জানি না। আমার ছাত্র আর সহকর্মীরা ততক্ষণে আমাকে জপটা ধরে টেনে সরিয়ে নিতে থাকে। পুলিশের যে সাদা মাইক্রোবাসটি ক্যাম্পাসে সরাক্ষণ আমাকে অনুসরণ করতে থাকে এবং এতোদিন যেটাকে আমি পুলিশ বাহিনীর একটা অর্থহীন কাজ বলে ভেবে এসেছি হঠাৎ করে সেটি আমার জীবন বাঁচানোর কাজে লেগে গেল। একটি ছেলে তার শার্ট খুলে আমার মাথায় চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। অন্যরা আমাকে রীতিমত পাঁজকোলা করে মাইক্রোবাসে তুলে নিল এবং মূহুর্তের মাঝে মাইক্রোবাসটি আমাকে নিযে হাসপাতালের দিকে ছুটে যেতে থাকে।
প্রথম আমার যে কথাটি মনে হলে সেটি হচ্ছে আমি এখনো জ্ঞান হারাইনি কাজেই আমাকে আমার স্ত্রী এবং কন্যার সাথে নিজে কথা বলতে হবে যেন তাদের খবরটি অন্য কারো কাছ থেকে পতে না হয়। সাধরাণত আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনে সবসময়ে একসাথে থাকি। কিন্তু আজকে এই মূহুর্তে সে ঢাকায়। প্রথমে আমার মেয়ের সাথে তারপর স্ত্রীর সাথে কথা বলে যতটুকু সম্ভব শান্তভাবে তাদের খবরটি দিলাম। বললাম, এখনো জ্ঞান আছে এবং এখনো চিন্তা করতে পারছি। তবে যেহেতু অনেক রক্ত পড়ছে তাই পরে কী হবে জানি না। আমি আমার ছেলে, ভাই বোন সবাইকে খবরটা দিতে বললাম। এক ধরনের খবর টেলিভিশন থেকে পেতে হয় না। মনে হলো ভাগ্যিস আমার মা বেঁচে নেই, না হলে তাকেও এই খবরটি দিতে হতো।
মাইক্রোবাস মোটামুটি ঝড়ের বেগে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এবং তখন আমি একটিু বোঝার চেষ্টা করলাম আমার আঘাত কতোটুকু গুরুতর। সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছে, আমি ভেবেছিলাম আমার আঘাত মাথায় তা্ই একটি সার্ট দলামোচা করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু পিঠেও একটি অনেক বড় আঘাত আছে আমি যেটার কথা তখনো জানি না। আমার একমাত্র সম্বল আমর মস্তিষ্কটি, মাথার আঘাতে সেটার কোনো ক্ষতি হয়েছে কীনা কে জানে? আমি ভাবলাম পরীক্ষা করে দেখি মস্তিষ্কটি ব্যবহার করতে পারি কী না। তাই ফিবোনাটি সিরিজটি বের করার চেষ্টা করলাম ১ যোগ ১ সমান ২, ২ যোগ ১ সমান ৩, ২ যোগ ৩ সমান ৫…..” গোটা দশেক পদ বের করে আমি বুঝতে পারলাম এখনো হিসেব করতে পারছি। তখন আমি আমার স্মৃতি শক্তি পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি আমার খুব প্রিয় কবিতা, মনে মনে তার প্রথম কয়েকটা লাইন আওড়ে গেলাম “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি বৃথিবীর পথে…..”। যখন দেখলাম বনলতা সেন কবিতাটি মনে আছে তখন নিজেকে নিজে বোঝালাম মস্তিষ্কের সম্ভবত গুরুতর ক্ষতি হয়নি।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানে বিশাল হই চই শুরু হয়ে গেলো। এতো দ্রুত কীভাবে খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং এতো দ্রুত কীভাবে হাসপাতাল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সেটি আমার জন্যে একটি রহস্য। আমাকে প্রথমে হুইল চেয়ারে তারপর একটি ট্রলিতে শুইয়ে হাসপাতালের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে নিয়ে যাওয়া হতে থাকলো। একটি ট্রলি দুইজনই ঠেলে নিতে পারে। কিন্তু আমি দেখলাম কয়েক ডজন ছাত্র শিক্ষক এবং অপরিচিত মানুষেরা আমার ট্রলিটি ঠেলে হাসপাতালের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানেরা ছবি নেওয়ার চেষ্টা করছে। দেখলাম কমবয়সী একজন একটি ক্যামেরা নিয়ে ভীড়ের মাঝে অনেক ঠেলাঠেলি করে একটা মোক্ষম ছবি তোলার চেস্টা করছে। আমার কী মনে হলো কে জানে, সকৌতুকে ছেলেটিকে ডেকে বললাম, “এসো, একটা সেলফি তুলে। ছেলেটি লজ্জা পেয়ে সরে গেলো। এখন মনে হচ্ছে ছেলেটাকে এভাবে লজ্জার মাঝে ফেলে দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু তখন আমি যথেষ্ট সন্তুষ্টি অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল যেহেতু এরকম অবস্থাতেও আমার সেন্স অব হিউমার অক্ষত আছে। তার মানে আমার মস্তিষ্কটিও নিশ্চয়ই অক্ষত আছে।
হাসপাতালের নানা জায়গা ঘুরে আমাকে অপারেশন থিয়েটারে আনা হলো। ততক্ষণে ডাক্তার এবং নার্সেরাও চলে এসেছেন। শুধু ডাক্তার এবং নার্স নয়, তার সাথে অসংখ্য মানুষ ক্যামেরা সহ সাংবাদিক, ছত্র, শিক্ষক, সহকর্মী, পুলিশ এবং অসংখ্য কৌতুহলী দর্শক। আমার অনেক সহকর্মী এবং পরিচিত মানুষ ভেঙ্গে পড়ে কান্না কাটি করছেন এবং আমি তাদের নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি ডাক্তার নই কিন্তু কমন সেন্স থেক বুঝতে পারছি আমার রক্তপাত বন্ধ করতে হবে এবং রক্ত দিতে হবে। অপারেশন থিয়েটারের এই বাজারের ভেতর সেটা কেমন করে করা হবে আমি জানি না। এর মাঝে আমার রক্তের গ্রুপের কথা বল হয়েছে (শুনে অনেকে বিশ্বাস নাও করতে পারেন, আমি আমার রক্তের গ্রুপ জানি, এ পজিটিভ) আমি যদিও এ পজিটিভ বলেছি, অপারেশান থিয়েটারে শুয়ে মনে হলো উৎসাহী কেউ কেউ সেটাকে ও পজিটিভ শুনতে পেয়েছে। যে ডাক্তার আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাকে বললাম, “ রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা না করে আমাকে রক্ত দেবেন না প্লীজ। “ ডাক্তার আমাকে অভয় দিলেন, বললেন রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে কখনো রক্ত দেওয়া হয় না।
অপারেশন থিয়েটার বোঝাই মানুষজনের মাঝেই ডাক্তাররা কাজ শুরু করে দিলেন, আমাকে জানালেন আমার আঘাতটা যাচাই করে চিকিৎসা শুরু করার আগে আমাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দিতে হবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে অজ্ঞান করা হলে আমি বুঝি আর জ্ঞান ফিরে পাব না। মাঝে মাঝেই আমার মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। কিন্তু আমি দাঁতে দাঁতে চেপে জ্ঞান ধরে রখার চেষ্টা করেছি। আমি অবুঝের মতো ডাক্তারদের সাথে তর্ক করতে শুরু করেছি, তাদেরকে বলতে শুরু করেছি আমাকে অজ্ঞান না করে চিকিৎসা শুরু করেন। ডাক্তারেরা বলছেন, তাহলে আপনার এতো যন্ত্রণা হবে যে সেই যন্ত্রণাতেই আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। আমি তাতেই রাজি। কিন্তু ডাক্তারার আমার মতো অবুঝ মানুষের ছেলেমানুষী আবদার মেনে নিশ্চয়ই চিকিৎসা করতে আসেননি। তাই আমি নিজেও জানি না কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছে।
এরপর অবছা আবছা ভাবে যখন আমার জ্ঞান হলো তখন মনে হলো আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো ততক্ষণ নিশ্চয়ই আমার শরীরে এড্রেনেলিনের বন্যা বইছিল তাই সব কিছুতে সজাগ হয়েছিলাম। তখন আমি পুরোপুরি নির্জীব। কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। একসময় চোখ খুলে তাকিয়েছি মনে হলো আমাদের শিক্ষামন্ত্রী আমার ওপর ঝুকে পড়ে কিছু একটা বলছেন। আমি শোনার চেষ্টা করলাম, মনে হলো তিনি বলছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্যে আমাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি যেন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা না করি।
এখন আমার চিন্তা করার বিশেষ ক্ষমতা নেই। চেতনা এবং অচেতনায় মাঝে ঝুলে আছি। হেলিকপ্টারে আমার এক দুইজন সহকর্মীকে দেখতে পেলাম। এক সময় হেলিকপ্টার উড়তে শুরু করল, কতোক্ষণ উড়েছে জানি না, মনে হলো বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে গেছে।
এক সময় হেলিকপ্টার থেমেছে, আমাকে স্ট্রেচারে করে নামানো হলো, সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই কেউ ওপরে আকাশের দিকে তাকায়নি। শুধু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি নির্মেঘ বিশাল একটি আকাশ, তার মাঝে ভরা একটি চাঁদ স্নেহভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি শিহরণ অনুভব করলাম, পৃথিবী এতো সুন্দর? এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারব?
আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে সি.এম.এইচ হাসপাতালে নেওয়া হলো। সেখানে আমার, সব আপনজনেরা অপেক্ষা করছে। কেউ কাছে আসছে না, সবাই দূর থেকে দেখছে। ডাক্তারেরা আমাকে পরীক্ষা করলেন, আমার স্ত্রী এসে একটু কথা বলল। তারপর আবার আমাকে সরিয়ে নেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মাঝে সি.সি.ইউয়ের অসংখ্য জটিল যন্ত্রপাতির মাঝে আমি অটকা পড়ে গেলাম। অবছা আবছা ভাবে মনে পড়ে কোনো এক সময়ে ডাক্তারদের কাছে চিঁ চিঁ করে জানতে চাইলাম, আমার অবস্থা কেমন? তারা বললেন, ভালো। আমি জানতে চাইলাম সবাইকে কী এটা জানানো হয়েছে? তারা বলেছেন যে হ্যাঁ, জানানো হয়েছে আমার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। আমি একটু স্বস্তির নি:স্বাস ফেললাম, আমি এখনো জানি না কারণটা কী, কিন্তু আমি অনুভব করতে পারি এই দেশের অসংখ্য ছেলে মেয়ের আমার জন্যে এক ধরণের ভালোবাসা আছে, “ধুম” করে মরে গিয়ে তাদের মনে কষ্ঠ দেওয়ার আমার কোনো অধিকার নেই।
বাইরে কী হচ্ছে আমি কিছু জানি না। চব্বিশ ঘন্টা পার হওয়ার পর শুণতে পারলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে আসবেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার-আমি কে? আমাকে দেখার জন্যে এই দেশের প্রধানমন্ত্রী চলে আসবেন?
সত্যি সত্যি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে এলেন, ডাক্তারেরা আমার সম্পর্কে রিপোর্ট দিলেন। সিলেট ওসমানী হাসপাতালের ডাক্তারেরা অবিশ্বাস্য চাপের মাঝে থেকেও কী অসাধারণভাবে আমাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েছেন সেটা বললেন। প্রধানমন্ত্রী আমার সাথে কথা বললেন, খোঁজ খবর নিলেন। চলে যাওয়ার সময় আমি কুন্ঠিত স্বরে বললাম,“ আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে ষোল কোটি মানুষের দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী আমার মতো একজনকে দেখতে চলে এসেছেন।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আপনজনের মতো হেসে বললেন, “প্রধানমন্ত্রী কোনো বড় কিছু না, আজ আছি কাল নেই। কিন্তু এটা সত্যি যে, আমি হচ্ছি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। এটা আমার অনেক বড় অহংকার, কেউ এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।” আমার মনে হলো এর চাইতে বড় সত্যি কথা আর কি হতে পারে? সাথে সাথে আমার এটাও মনে হলো যে আমার কতো বড় সৌভাগ্য যার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত তিনি আমাকে দেখতে চলে এসেছেন। কী অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার।
যাই হোক, আমি আমার জীবনে এভাবে এর আগে কখনো হাসপাতালে থাকিনি। হাসপাতালে থাকার অভিজ্ঞতাটুকু খুবই বিশ্ময়কর। কাউকে যদি বলতে হয় আমাকে শুধু একটি কথা দিয়ে বোঝাতে হবে-সেটি হচ্ছে ভালোবাসা। যে মেয়েটি আমার ঘরের মেঝেটি মুছে দিয়েছে সেখান থেকে শুরু করে যার নেতৃত্বে এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটি চলছে সবাই আমার জন্যে যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, আমি কোনোদিন তার প্রতিদান দিতে পারব না। কথা প্রসঙ্গে আমি তাদের বলেছি, যদি কোনোভাবে আমার এই হাসপাতলের অভিজ্ঞতাটুকু আগে হতো তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে আমার অগ্রজ হুমায়ূন আহমেদকে তার চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে না গিয়ে এখানে চিকিৎসা করার জন্যে বলতাম। আমার জন্যেই সবার বুকের ভেতর এতো ভালোবাসা, হুমায়ূন আহমেদকে তারা সবাই না জানি কতো গভীর মমতা দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্ঠা করতেন।
আমার এই ঘটনাটি ঘটে যাবার পর শুনেছি সারা দেশে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে, দেশের অনেক মানুষ নানভাবে আমার জন্যে তাদের ভালোবাসটুকু প্রকাশ করেছেন। আমি সেই দিনগুলোর খবরের কাগজ দেখিনি, টেলিভিশনের খবর শুনিনি। তারপরও আমি সবার ভালোবাসটুকু অনুভব করতে পারি। সবার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের অস্থিরতার খবর জানতাম বলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় না এসে সরাসরি এয়ারপোর্ট গিয়েছি, একটা প্লেন ধরে সিলেট গিয়েছি। যে মুক্তমঞ্চে বিভ্রান্ত ছেলেটি আমাকে আক্রমণ করেছিল সেই একই মুক্তমঞ্চে দাড়িয়ে আমার ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলেছি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় আমার ঘুরে ফিরে অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়, ওয়াসিম দীপন এরকম সবার কথা মনে পড়েছিল। যারা কেউ বেঁচে নেই। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছি, কেন বেঁচে গিয়েছি, এখনো জানি না। যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমার প্রিয় ছাত্র মাহিদ আল সালামের কথা মনে পড়ছে। শাহাবাগে আমার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ সভায় সে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছে অথচ দুর্বৃত্তের আক্রমণে দুদিন আগে একেবারে হঠাৎ করে তাকে জীবন দিতে হলো। কে জানে পৃথিবীটা কেমন করে এতো নিষ্ঠুর হয়ে যেতে পারে।
দেশের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে আমি এই লেখাটা লিখছি। অসংখ্য মানুষ আমাকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন তাদের সবার জন্যে ভালোবাসা। যারা আমাকে লিখেছে আলাদা করে আমি তাদের সবার কথা উল্লেখ করতে পারব না, শুধু ছোট একটা মেয়ের কথা লিখি। যে আমাকে সাহস দিয়ে লিখেছে একটু বড় হয়েই সে কারাটে ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাবে। তারপর ব্ল্যাক বেল্ট হয়ে আমার বডিগার্ড হয়ে বাকি জীবন আমাকে পাহাড়া দিয়ে বেড়াবে যেন আর কেউ কখনো আমার উপর আক্রমণ করতে না পারে।
আমার উপর এই আক্রমণটি না হলে আমি কী কখনো জানতে পারতাম কতোজনের বুকের ভেতর আমার জন্যে কতো ভালোবাসা জমা হয়ে আছে?
এমএইচ/টিকে
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।