ঢাকা, রবিবার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪

‘সোনালী ডানার চিল’ 

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ১৫:২৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৫:৩৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বেইলী রোড। রাত ৮টা। হরেক রকম খাবারের দোকান। এক দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে কিছু কিশোর কিশোরী। সদ্য বালক বালিকা থেকে কিশোরে রুপান্তর তাদের। চালচলন কথাবার্তায় প্রচন্ড ইঁচড়ে পাকা তারা। হাত পা নেড়ে নেড়ে এমন ঢং করে কথা বলছে ওরা, তাকিয়ে রইলাম। ভালোও লাগছে। আবার কখনো একটু বিরক্তও লাগছে পাকামোতে। ওই রুমে আরও যে কিছু মানুষ বসে আছে, তা নিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব তাদের। বয়স্করা অনেকেই বিরক্তসূচক শব্দ করছেন কাণ্ড দেখে। একগাদা খাবার কিশোর কিশোরীদের সামনে। খাচ্ছে, নষ্ট করছে। বসে বসে ভাবছিলাম এত টাকা কোথায় পায় ওরা? যত খাবার, তার বিল আসবে মনে হয় কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এক সন্ধ্যায় এত টাকা  ওড়ানোর বিলাসিতায় আমি বিস্মিত। অভিভাবকরা কত টাকা আয় করলে সন্তানদের এক বেলার আড্ডার খাবার এমন বিল দিতে পারেন আমার বোধগম্য হলো না। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে, কিছুটা যেচে পরেই কথা বললাম ওদের সাথে। 

জেবিন নামের মেয়েটি দেশ নিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত। এদেশে কোনো ফিউচার নেই। রবিন, সানি চলে যেতে চায় দেশের বাইরে। সেখানে লাইফ আছে। বাঁচা যায়। বাংলাদেশ বোরিং কান্ট্রি। জ্যাম ধূলায় ভরা শহর। বাঁচতে হবে নিজের জন্য। সাফিন বলে, একটাই জীবন, চিল করেই পার করে দিতে হয়। নিজে এনজয় করতে হয়। রবিনের ভাবনা, সবার কথা ভেবে লাভ কী। যার যার জীবন তার তার। এতো স্যাক্রিফাইস করে কি হবে? জয়া, কোকে চুমুক দিতে দিতে বলে, খাওয়া একটা এনজয়ের বিষয়। এত টাকা খরচ করছো একটু খারাপ লাগছে না? আমার প্রশ্নে কাঁধ একটু শ্রাগ করে শ্রেয়া, কেন? বাবা মার দায়িত্ব সন্তানকে দেখা। তারাই তো এনেছেন পৃথিবীতে। তাই যা যা লাগবে তারা দিবে। বাধ্য তারা দিতে। খারাপ লাগবে কেন? সব বাবা মার তো অর্থনৈতিক অবস্থা সমান না.. আস্তে আস্তে আমি বলি, তোমরা তাদের অবস্থা বুঝবে না? কি বুঝবো? টাকা তো অনেক দেখি তাদের। বেশি না দিলে ইমোনোশাল ব্ল্যাকমেইল করি। ভয় দেখাই, রাগ করি। ভাংচুর করি। তখন টাকা এমনিই পাওয়া যায়। 

এভাবে টাকা অপচয় করা কি ভালো? আমার প্রশ্নে তারা হেসেই গড়াগড়ি। টাকা কী থাকার জিনিস? কোক বার্গার পিজা না খেলে হবে? উঁহ ভাত! মোটা বানায়। খাই না। আম্মু জোর করে। খুব বিরক্ত লাগে। আরে বাবা আধুনিক হও। সেই পুরোনো আমলের মানসিকতা। ভাত-তরকারি। বোরিং! কাঁধ শ্লাগ করে একজন। পাত্তা দিলাম না। বললাম কখনো নীল আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছো? দেখেছো কী সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া? কিংবা সোনালী ডানার চিল? থালার মতো রুপালী চাঁদ? ওরা হেসেই লুটোপুটি। কি আছে আকাশে? একজন হাসতে হাসতে বলে একবার হুমায়ূন আহমেদ এর গল্পে পড়েছি চাঁদের কথা! প্লান করে দেখা হয়নি। কবিরা চাঁদ নিয়ে, জোসনা নিয়ে সব ফানি ফানি কথা লেখে। হাসি পায়। এক বন্ধুকে হাত দিয়ে দেখায়, ও একবার আবৃত্তি করেছিল নজরুল ইসলামের কবিতা।
 
মনে স্বস্তি পেলাম, যাক বাবা একজন হলেও বই পড়েছে। কবিতা পড়েছে। বললাম, ঝকঝকে পূর্ণিমা রাতে নদীর পানি রুপার মতো ঝকঝক করে। তাতে কী হয়েছে?  জয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আমাকে। মনে মনে বললাম, না বাবা-মায়েরা আমার তাতে কিছুই হয়নি। মোবাইল ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে থেকে তোমাদের অনেকেরই চোখ আজ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি দেখছো না তোমরা। নদী দেখবে কিভাবে? সারারাত জেগে থেকে, সারাদিন ঘুমিয়ে থাকো তোমরা। তোমাদের স্বচ্ছ সাদা চোখে আজ ভারী ভারী চশমা। তোমরা হাঁটতে পার না। দৌঁড়াতে পার না ভারী শরীর নিয়ে। চিকেন খেয়ে খেয়ে তোমরা জান না ভাজা ইলিশের স্বাদ।  

তোমাদের মন আজ বড় রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা একটুতেই আজ অসহিঞ্চু। তোমরা প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। তোমরা কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখ না। তোমরা দোঁলনচাপার গন্ধ চেনো না! তোমরা শিউলী ফুল কুঁড়াতে যাও না। তোমরা খালি পায়ে শিশিরে হাঁটো না! শোন না ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক! একটা সুন্দর আকাশ দেখলে তোমাদের কান্না পায় না! তোমাদের নরম মনটা আজ বড় পাথুরে হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের অনেক অভিভাবকদেরও সময় নেই তোমাদের নিয়ে ভাবার। সময় দেবার। তারাও ছুটছেন। কালো টাকা, সাদা টাকা উড়ছে চারিদিক। সে টাকায় জগত হচ্ছে রঙিন। মিথ্যারা আজ বড়ই শক্তিশালী। তাদের দাপটে নীতিবানরা আজ মাথা কুটে মরে, লজ্জা পায় তারা লজ্জাহীনতার চর্চা দেখে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের। মধ্যবিত্তের টানাপোড়নে হাপিত্যেস কাক। দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে কেটে যায় একটা মরিচ পোড়া জীবন। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি...’ ছড়াগুলো যেন আজ দূরের শোনা কোনো গল্প। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প’।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি