ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

আয়নায় আমি: যা না বললেই নয়

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৭:৫৫, ৮ জুন ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

সুপ্রিয় নীতা’দি, তোমার ব্যাপারটি কি বল তো? ওপারে গিয়েও কি তোমাকে বক্ বক্ করতে হবে? আর কি সব উদ্ভট প্রশ্ন তোমার! জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ‘কৃষ্ণাঙ্গ জীবনেরও মূল্য আছে’র বিক্ষোভ মিছিলে আমি গিয়েছিলাম কিনা? নীচের দিকে তাকিয়ে তোমার মনে হয়েছে যে, বিভিন্ন দেশের বিক্ষোভ মিছিলে কৃষ্ণাঙ্গরা আছে, শ্বেতাঙ্গেরা আছে, কিন্তু বাদামী রঙ্গের মানুষ মাত্র গুটি কয়েক। অতো ওপর থেকেও সবকিছু দেখা যায় নাকি গো?

তোমার সমস্যা কি, জানো নীতা’দি? সবকিছুর খুঁটি-নাটি না জানলে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না! তার মধ্যে আবার দেশ দেশ করে পাগল হয়ে গেলে! বাদামী রঙের মানুষেরা (তোমার ভাষায়, আসলে দক্ষিণ এশীয়রা) ঐ রকম একটি সামাজিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকলে তোমার তো আবার আত্মাভিমানে লাগবে। শোনো, বাদামী রঙের মানুষেরাও গিয়েছিলো। খুব কম সংখ্যায়? তা, মানে, আসলে কি জানো, ব্যাপারটা হচ্ছে....। আচ্ছা, আচ্ছা, মারতে এসো না, তোমার কথাই ঠিক।

হলো কি? তুমি কি আমাকে ছাড়বে না? আমি বিক্ষোভ মিছিলে গেলাম না কেন? আমি যাবো বিক্ষোভ মিছিলে? তোমার কি মাথা খারাপ? ঐ গোলমালের মধ্যে আমি যাবো? আমি চিরটাকাল সব রকমের ঝুঁকি এড়িয়ে এসেছি, কোন রকমের গোলমেলে জিনিষে জড়াই নি, নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি, আর আমি কি না যাবো মিছিলে? তা’ছাড়া, আমার মা বলে দিয়েছেন, সব সময়ে যে দিকে ভীড়, আমি যেন তার উল্টো দিকে যাই।

তা’ছাড়া আমার ভয় নেই? আমাকে যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়? জেলে পুরে দেয়? পেটায়? পুলিশের কালো খাতায় যদি আমার নাম উঠে যায়? আরো তো সমস্যা আছে। আমার ওপরওয়ালা যদি আমাকে মিছিল করতে দেখে এবং তারপরে চাকরী থেকে ছাড়িয়ে দেয়? তা’ছাড়া আমার চেনা-শোনা কেউ যদি দেখে ফেলে? কালোদের মিছিলে কালোদের সঙ্গে আমি? ছি: ছি: সে বড় শরমের কথা হবে!

অন্যের ভালোর জন্যে, জগতের মঙ্গলের জন্যে, মানবতার জন্যে যুথবদ্ধ হওয়া উচিত? তুমি আমাকে হাসালে নীতা’দি! আরে, মানবতা আর মানবাধিকার! ওগুলো তো কথার কথা - মুখে মুখে বলি গো, নিজের স্বার্থ এলে কে সেগুলো মনে রাখে? আর ভুলে যাচ্ছো কেন, আমি বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। আমি নিজে নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত - আমি আমার নীচে যে আছে, তাকে আমার কিছুই ছেড়ে দেবো না। কিন্তু আমার ওপরে যে আছে, তার সবকিছুতেই আমি ভাগ বসাতে চাইবো। আমার স্বার্থকেন্দ্রিকতাই আমার সবকিছু -ঐ মিছিলে গিয়ে আমি তা নষ্ট করবো? এতো বোকা আমি না। আর আমাদের নিজস্ব দাবি দাওয়ার মিছিল হলে তবু একটা কথা ছিল। তাই বলে অন্য মানুষদের মিছিলে?

এ ভিন্ন আসল কথা কি জানো? চুপি চুপি তোমাকে বলি - কালোদের আমি একদম পছন্দ করি না। ওদের চেহারা পছন্দ হয় না, ওদের কথা বার্তা, গান, খাওয়া কিছুই পছন্দ হয় না। এদের দেখলেই ভয় লাগে - মনে হয় এই বুঝি ছিনতাই করতে আসছে। ওরা অপরাধ জগতের লোক - ওদেরকে আড়ালে আবডালে আমরা ‘কাল্লুই বলে থাকি’। ঐতো গেল বছর, ঝিল্লু ভাইয়ের মেয়েটার একটু একটু ভাব হয়েছিল একটা কালো ছেলের সঙ্গে। ভারী ভদ্র ও অত্যন্ত মেধাবী সম্ভাবনাময় একটি তরুণ। খবর শুনেই ঝিল্লু ভাই আচ্ছা করে পেটালেন - মুখে শুধু একটাই কথা, ‘হারামজাদী মেয়ে, আর যাবি ঐ ‘কাল্লুর’ কাছে?

সপরিবারে বেড়াতে দু’দিনের জন্যে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন বড়ুয়া’দা। ফিরে এসে দেখেন, চুরি হয়েছে বাড়িতে। কোন কিছু না বিবেচনা করে আমরা সবাই এক বাক্যে গণরায় দিলাম যে, মোড়ের কালো ছেলে কলিন আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাজ এটা। ‘কাল্লুরা’ ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ করতে পারে না। পরে অবশ্য বেরুলো যে বড়ুয়া’দার মাদকাসক্ত ভাতিজার কাজ এটা। আমার কিন্তু এখনো মনে হয়, ওটা কলিনেরই কাজ। আমি বিশ্বাস করি না কালোদের, সম্মান করি না ওদের, মিশতেই চাই না ওদের সঙ্গে। আর তুমি কি না আশা করছো আমি কালোদের মিছিলে যাবো?

কি বললে, দিদি? সাদারাও সমান অপরাধ করে। আহ্হা, তা’তে কি? ওরা হল সাহেবের জাত। আর আমি তো কালো নই - আমি হচ্ছি গিয়ে, ঐ যাকে তুমি বলতে ‘বাদামী’, তাই। ওরা আমাকে উপেক্ষা করলে কি হবে, আমি হচ্ছি সাদাদের অনেক কাছাকাছি - ফর্সা মানুষই আমার পছন্দ। আমার পুত্রের বিয়ের জন্যে তো তাই মেয়ে দেখেই চলেছি। ‘দুধে আলতায়’ না হলে সে মেয়ে চলবে না। আমার ছেলে ঘোর কালো? এমন কথা তুমি বলতে পারলে? ওর রঙটা একটু মাজা বটে, তবে সে হচ্ছে ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ’।

এবার তো বুঝতে পারলে দিদি যে তোমার ‘বাদামী’ ভাইটি কেন বিক্ষোভ মিছিলে যাবে না। সব খুলেই কইলাম। কারণ গতরাতে অন্য জগত থেকে আমার স্বপ্নে এসে আমাকে বহুত জ্বালিয়েছো। উত্তর তো সব পেয়েই গেলে। আজ রাতে আর স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমাকে জ্বালিও না। তুমিও ঘুমাও আর আমাকেও একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও, লক্ষ্মী দিদি আমার।

তোমাদের জগতে কি শুভেচ্ছা বিনিময় হয়? হলে- আমার শুভ কামনা তোমার জন্যে। [এ লেখার সব নামগুলোই কাল্পনিক]

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি