সংখ্যালঘুত্ব ও করোনা সঙ্কট: বৃটেনের চালচিত্র
প্রকাশিত : ১৮:২২, ৮ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৮:২৫, ৮ জুন ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
খুব সঙ্গত কারণেই সব দেশেই করোনা সঙ্কটের মূল লক্ষ্য অদ্যাবধি স্বাস্থ্যবিষয়ক, এই যেমন- সংক্রমণ পরীক্ষার সম্প্রসারণ, সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ চিহ্নিতকরণ, সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে কি করা যেতে পারে ইত্যাদি। এই সঙ্কটের বিভাজিত বিশ্লেষণ এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়া এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, এ সব বিষয়গুলো গুরুত্বসহ আত্মপ্রকাশ করছে। কারণ, করোনা সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ সমাধানে তাদের বিরাট ভূমিকা থাকবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বৃটেনে করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতিস্বত্ত্বাগত বিষয়গুলোর ওপরে গতকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বে এটিই এ জাতীয় বিষয়ের ওপরে প্রথম প্রকাশনা।
জাতিস্বত্ত্বা-বহির্ভূত কিছু কিছু বৈষম্যের মাত্রিকতার কথা প্রথমেই বলে নেই। বৃটেনে যাঁদের বয়স আশির ওপরে, করোনা-উদ্ভূত কারণে তাঁদের মৃত্যুর সম্ভাবনা যাঁদের বয়স চল্লিশের নীচে, তাঁদের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি। অন্যদিকে, করোনা আক্রান্ত পুরুষদের মৃত্যুর আশঙ্কা নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ। বৃটেনের উন্নত অঞ্চলগুলোর চেয়ে পশ্চাৎপদ অঞ্চলে করোনা-উদ্ভূত মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেশি। নিরাপত্তা প্রহরী, ট্যাক্সি বা বাস চালক, নির্মাণ শ্রমিক কিংবা সামাজিক সেবাদানকারী - এসব পেশাধারী মানুষদের করোনার শিকার হওয়ার ঝুঁকিও বেশী।
যদি জাতিস্বত্ত্বার প্রেক্ষাপট ব্যবহার করা হয়, তা’হলে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাবে। আবার কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া যাবে, যেগুলো পরোক্ষ। পরোক্ষ প্রমাণের কথাই প্রথমে বলা যাক। পরোক্ষ প্রমাণগুলো অনুসঙ্গভিত্তিক। যেহেতু নিরাপত্তা প্রহরী, ট্যাক্সি বা বাস চালকদের ঝুঁকি বেশী এবং যেহেতু এদের বেশীর ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয়, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর, সুতরাং আনুসঙ্গিকতার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয়, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই করোনার শিকার।
এবার প্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রটি দেখা যাক। বৃটেনে এ পর্যন্ত চিকিৎসক, সেবিকা, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ২০০ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে করোনা-ভাইরাসে। এর মধ্যে প্রতি ১০ জনের ৬ জনই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশই এশীয় এবং ২৪ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ।
পুরো জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে যখন বিচার করা হয়, তখন দেখা যায় যে, শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে করোনা-মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় বাংলাদেশীদের করোনা থেকে মৃত্যুর আশংকা দ্বিগুণ। একইভাবে, চৈনিক, ভারতীয়, পাকিস্তানী, অন্যান্য এশীয়, ক্যারিবীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা-মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গ বৃটিশদের চেয়ে ১০শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। সুতরাং যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশীদের মধ্যে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বৃটেনে করোনা-প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশীরা কেন রয়েছে। এর কারণ বিবিধ - এর কিছু কিছু জীবনযাত্রা প্রণালী ও কৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত; কিছু কিছু অর্থনৈতিক কারণ-উদ্ভূত; কিছু কিছু স্বাস্থ্য-বিষয়ের সঙ্গে জড়িত।
বৃটেনে বাংলাদেশীরা একই চালার নীচে সম্প্রসারিত পরিবার হিসেবে বসবাস করে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যেরা ঠাসাঠাসি করে একই কক্ষের মধ্যে বাস করেন। সে সব বাড়ির স্বাস্থ্য ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো নয়। ফলে একাধিক ব্যাপার ঘটে। এক, সামাজিক জনদূরত্ব সম্ভবও নয়, এটার প্রচলনও নেই। দুই, যখন কেউ সংক্রমিত হন, তখন সঙ্গ নিরোধও কষ্টকর। বাংলাদেশীদের কৃষ্টিই হলো কাছাকাছি একত্রে থাকার, সঙ্গ নিরোধের নয়। সুতরাং সামাজিক জন দূরত্ব বা সঙ্গ নিরোধের গুরুত্বকে মূল্য দেয়া হয় না। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যাভ্যাসের ব্যাপারেও নানান রকম সমস্যা আছে। এ ছাড়াও বিজ্ঞান-অমনস্কতাও বাঙ্গালী চিন্তা-চেতনার অংশ। এসব কিছু মিলেই বাংলাদেশীদের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি দেখি, তা’হলে দেখা যাচ্ছে- যে সব কাজে বাংলাদেশীরা নিয়োজিত, সে সব কাজ বাড়ি থেকে করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশীরা দোকানে কাজ করেন, ক্ষুদ্র ব্যবসা চালান, নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করেন এবং বাস ও ট্যাক্সি চালান। সুতরাং চাকুরী ও অর্থনৈতিক কারণে তাদের প্রতিদিনই ঘর থেকে বেরুতে হয়। সুতরাং তাদের করোনা- সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বহুসংখ্যক বাংলাদেশি পুরুষের নানান রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, যা তাদের জীবন-প্রণালীর প্রতিফলন। তারা অতিমাত্রায় ধূমপান করেন, পান-সুপারী খান, শরীরচর্চা করেন না এবং লাল মাংসসহ তেলযুক্ত গুরুপাক খাবার খান। ফলে, তারা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, প্রমেহ, হাঁপানী ও অন্যান্য শ্বাস প্রণালীজনিত রোগের শিকার হন। এমতাবস্থায়, তারা যদি করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন, তা’হলে তা মৃত্যুঘাতী হতে পারে।
এটাও বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রয়োজনের প্রতি বৃটিশ সরকারের একটি ঔদাসীন্য আছে। স্থানীয় পর্যায়ে, যেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বসবাস করেন, মান সম্পন্ন সরকারি সেবা দেয়া হয় না - তা সে স্বাস্থ্যসেবাই হোক, কিংবা হাসপাতাল সেবাই হোক। সংখ্যালঘুদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং তাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করার কাজটিও ঠিকমতো করা হয় না সরকারি পর্যায়ে। এসব কারণেও বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মাঝে করোনা-সংক্রমনের হার বেশী।
উপর্যুক্ত প্রতিবেদনের ফলাফলগুলো নিতান্তই প্রাথমিক। তবু এসব প্রাথমিক পর্যবেক্ষণগুলো তিনটে কর্মকাণ্ডের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রথমত: যুক্তরাজ্যে বাংলদেশীদের অবস্থা ও প্রয়োজন নিয়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন বৃটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারেন। দ্বিতীয়ত: উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর ওপরে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশীদের মধ্যে আলচনার সূত্রপাত করে একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে পারেন এ দেশের বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী এবং তৃতীয়ত: ওপরে ব্যক্ত বিষয়গুলোর আরো বিশদ ও বিস্তারিত গবেষণা।
আবারও যুক্তরাজ্যে যে সব বাংলাদেশী গবেষক ও বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন এ কাজটির সমণ্বয় সাধন করতে পারেন। গতকাল প্রকাশিত সংখ্যালঘুত্বের আঙ্গিকে করোনা সঙ্কট শীর্ষক প্রতিবেদনটি বর্তমান লেখাটিতে উত্থাপিত বিষয়গুলোর উপলব্ধি-সীমান্ত সম্প্রসারনের একটি সুনন্দ সুযোগ।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।