কোভিড বছরে রোটারি ক্লাব
প্রকাশিত : ১৩:৫২, ১১ জুন ২০২০
মাষ্টারর্স করে দেশে ফিরেছি। হঠাতই একটা ফোনে রোটারীর সাথে আমার যোগাযোগ। ফোনটা করেছিলেন মরহুম মাওলা বক্স ভাই। পেশায় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাইরেক্টর। তবে ফোনটা করেছিলেন একেবারেই অন্য কারণে। ব্রিটিশ এ্যালামনাই ইন বাংলাদেশের ডাইরেক্টরীতে আমার নামটা দেখে তার সেই ফোন করা। তখন তারা সদ্যই চার্টার করেছেন রোটারী ক্লাব অব বনানী ঢাকা। ক্লাবটিতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমাকে তিনি ফোন করেছিলেন। রোটারী সম্মন্ধে যাদের জানা নেই তাদের অনেকেই হয়ত জানেন না যে না রোটারীতে যোগ দেয়াটা সব সময় আমন্ত্রণক্রমে।
কেউ চাইলেই রোটারীয়ান হতে পারেন না। সেই থেকে রোটারীর সাথে আমার যে সম্পর্ক এখনও তা বহাল তবিয়তেই বহাল। মাঝে পেশাগত ব্যস্ততায় বেশ কিছু দিন যোগাযোগটা ফিকে হয়ে এসেছিল। ২০১৮-এর শেষে দিকে চার্টার মেম্বর হিসেবে রোটারী ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সট প্রতিষ্ঠা এবং সমাপ্ত প্রায় বর্তমান রোটারী বছরে ক্লাবটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যোগাযোগটা অবশ্য এখন ক্রমশই গভীর থেকে গভীরতর হবার পথে।
রোটারী করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে হরেক রকম মানুষের সাথে। হরেক তাদের পেশা আর হরেক রকমের বাছ-বিচার। কিন্তু একটা জায়গায় অদ্ভুত একটা যোগাযোগ। অন্যের জন্য আরেকটু কিছু করার প্রচন্ড ক্ষিধা। অনেকেরই ধারনা রোটারী বোধহয় খানা-পিনা আর গাল-গপ্পের একটা জমপেশ জায়গা। ঢুকলে পরে বোঝা যায় বাস্তবতা আসলেএকশ আশি ডিগ্রী উল্টো। যেমন ঐ যে মরহুম মাওলা বক্স, যার হাত ধরে আমার রোটারীয়ান হওয়া,পেশাগত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি তার প্যাশনটাই ছিল রোটারীকে কিছু ভালো মানুষকে চিনিয়ে দেয়া যাতে জন-মানুষের আরেকটু কল্যাণ হয়।
গতবছর বন্যার সময় আমাদের ক্লাবের প্রথম ইন্সটলেশনটা খর্বকায় করে ইন্সটলেশনের খরচের বড় একটা অংশ রোটারির ডিস্ট্রিক্ট গভর্ণরের ত্রাণ তহবিলে তুলে দেয়ার আমার প্রস্তাবে হাসিমুখে সম্মতি দিয়েছিলেন আমাদের এই যে শিশু রোটারী ক্লাব তার সবকজন হাতেখড়ি রোটারীয়ান। আর দিবেনই না বা কেন? ডিস্ট্রিক্ট গভর্ণর রোটারিয়ান খাইরুল আলমতো তেমনই একজন রোটারিয়ান যিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্তএকজন অসহায় রিক্সা চালকের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য আমাকে বারবার ফোন করতে দ্বিধা করেন না, অথচ ঐ রিক্সা চালকের জন্য তিনি আমাকে যতবার ফোন করেছেন, তার নিজের অসুস্থতায় আমি তার পক্ষ থেকে তার এক-দশমাংশ ফোনও সম্ভবত পাইনি।
এই সময়টায় বিশেষ করে হাসপাতালগুলোয় স্বাস্থ্যসেবা যখন অনেকটাই সংকুচিত, সাধারণ রোগীদের এখনও যখন সুযোগ নেই আগের মত হাসপাতালে যেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার, তখন এই করোনা কালে আমার রোটারী ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সট প্রকাশ করেছে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তালিকাএসব বিশেষজ্ঞদের মোবাইল নম্বর, বিশেষায়নের ক্ষেত্র ও টেলি-কনসাল্টেশনের সময়সূচী প্রকাশ করা হয়েছে জাতীয় দৈনিকসমূহ, অনলাইন আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। এসব নম্বরে ফোন করে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষচিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ গ্রহণ করছেন।
পাশাপাশি আজকের বাস্তবতায়, কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে,মানবতাকে টেনে তোলায় আমার ক্লাবের এবং পাশাপাশি মোটা দাগে বাংলাদেশের রোটারিয়ানদের যে আগ্রহ তা প্রতি মুহুর্তে আমাকে কখনো বিমোহিত আর কখনো আপ্লুত করে। আবারও আমার ক্লাবের রোটারিয়ানদের কথাই বলি। এদের উৎসাহে আমরা এবারের দুর্যোগে পৌছে গেছি দিনাজপুর থেকে শ্রীমঙ্গল আর অবশ্যই ঢাকা শহরের নানা গলিতে। কখনো আমাদের ক্লাবের রোটারিয়ানদের যৎসামান্য আন্তরিকতায় হাসি ফুটেছে গাওয়াইরের নিম্নবিত্তের স্কুলের শিশু আর তাদের অভিভাবকদের মুখে তো কখনো একটু হেসেছেন ‘আপন নিবাস’ নিবাসী নিঃসঙ্গ বৃদ্ধারা।
পাশাপাশি পেয়েছি অদ্ভুত কিছু মানুষের সন্ধান যারা আমাদের হাতটা আরেকটু প্রসারিত করতে সহায়তা করেছেন। এদের মধ্যে আছেন ‘অপরাজেয় বাংলা’-র সদস্য সচিব এইচ রহমান মিলু, যার মাধ্যমে গোটা রমজান মাসে উপহারের প্যাকেট পৌছে গেছে ঢাকা শহরের অনেক এমন সব মানুষের ঘরে-ঘরে, সামাজিক অবস্থানের কারণে যারা এগিয়ে এসে সব সময় প্রয়োজনটা মুখ ফুটে হয়ত বলতে পারেন না। আছেন ‘আপনার স্বাস্থ্য’ সাময়িকীর সিনিয়র সাংবাদিক জাবেদ আলম।
নিজে অসুস্থ, অথচ সেদিকে খেয়াল খুবই কম। ঈদের আগে তার মাধ্যমে মোহাম্মদপুরে যে দু’জন শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাই-বোনের কাছে আমাদের সামান্য ঈদ উপহার পৌছে গেছে তা আমার রোটারি ক্লাবের প্রতিটি রোটারিয়ানের এবারের গৃহবন্দী ঈদের আনন্দকে পুর্নাঙ্গতা এনে দিয়েছে। তেমনিভাবে কুলাউড়ার চা বাগান শ্রমিকদের ঘরে আমরা পৌছে গেছি তরুণ আইনজীবী জীবনের সহায়তায় আর সরিষাবাড়ির অসহায় কিছু দুস্থ মানুষের কাছে আমাদের নিয়ে গেছেন তরুণ সাংবাদিক নিসার।
একইভাবে তেমনি সরাইলের জেলেদের কাছে আমাদের দেয়া জালগুলো আর দুঃস্থ কয়েকজন মহিলাদের জন্য সেলাই মেশিন পৌছে দিয়েছেন ছোট মফস্বল শহরের বড় মনের সাংবাদিক মনসুর। আর না বললেই নয় আপন নিবাসের সাজেদা আপার কথা। ঢাকার উত্তরখানে তার ‘আপন নিবাস’। আপন করে নিয়েছেন পরিবার-পরিত্যক্তা ষাট জন অসহায় বৃদ্ধাকে। তাদের সব দায়িত্ব এই মহিলাটির। কখনো খাগড়াছড়ি তো কখনো কমলাপুরের প্ল্যাটফর্ম - খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছেন, নিয়ে আসছেন অসহায় মানুষগুলোকে আর পৃথিবীতে তাদের শেষ দিনগুলোকে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে চলেছেন।
এই লেখায় উঠে এসেছে অনেকের নাম, আসেনি শুধু আমার ক্লাবের মানবদরদী রোটারিয়ানদের নামগুলো। কাকে ছেড়ে কার নাম লিখবো, ত্রিশের বেশি নাম থেকে বেছে নিব কোনটি, সিদ্ধান্তটা একটু কঠিনই ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার জন্য। তারপরও লেখাটা যখন প্রায় শেষ, দু-একজনের কথা উল্লেখ না করলে কেন যেন মনে হয় একটুখানি অন্যায় হবে। আমার ক্লাবে এমন কিছু রোটারিয়ান আছেন যাদের অনেককে অনেকে চেনেন অনেক পরিচয়ে, আবার অনেককে না। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে যখন আমাদের সমাজটাকে জর্জরিত করতে চায় একটি অশুভ শক্তি তখন তাদের একেকটি উদ্যোগ অন্ততঃ আমাকে অনেক বেশী আশাবাদী করে তোলে।
এদেরই একজন রোটারিয়ান অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া। প্রতি রমজানে কমলাপুরের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে শত-শত মুসলমানের জন্য যে নিয়মিত ইফতারের আয়োজন করা হয় তার পেছনে আছেন অনেকগুলো উদ্যোমি মানুষ। আর তাদের অন্যতম এই মানুষটি। আছেন আমার সহ-ধর্মিনী রোটারিয়ান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। সাম্প্রদায়িক শক্তির হিংস্র থাবায় যখনই ক্ষত-বিক্ষত যশোরের মালোপাড়া, ব্রাম্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর কিংবা ভোলার বোরহানউদ্দিন সেখানেই তার সরব উপস্থিতি শারীরিকভাবে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এবারের ঈদে ঢাকার কিছু উদ্যোমি তরুণ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইফতার আর ঈদের দিনে ঈদ উপহার পৌছে দিয়েছেন মিরপুরের একটি এতিমখানায় আর বৃদ্ধাশ্রমে। অনেকের সহযোগিতাই ছিল এর পিছনে। যেমন ছিল আমার ক্লাবের রোটারিয়ান দম্পতি রোটারিয়ান দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য আর রোটারিয়ান পর্ণা সাহার। ভাবা যায়? হয়ত যায়, হয়ত না। কিন্তু ভাবলেই কেমন যেন আরেকটু ভাল লাগে।
রোটারির বছর শুরু হয় জুলাই মাসের প্রথম দিনটিতে। দায়িত্ব নেন নতুন বোর্ড। সারা দুনিয়ায়, প্রতিটি ক্লাবে, একই দিনে, একই সাথে। রোটারি ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সট-এর সভাপতি হিসাবে আমার দায়িত্ব পালনের যবনিকায় বাকি আর অল্প ক’টি দিন। রোটারির সাথে আমার সেই যে নিরানব্বই থেকে পথ চলা, তা বোধ করি চলবে আরো বহু দিন। তারপরও দায়িত্ব পালনের একটি পর্যায়ে এসে বাজছে যখন বিদায়ের ঘন্টাটি টুন-টুন করে, মনের কোথায় যেন একটু টনটনে অনুভূতি! আর ভাললাগার আর ভালবাসার সেই অনুভূতিগুলো আর সবার সাথে একটু ভাগাভাগি করায় এই একটু ছোট্ট চেষ্টা!
চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।