ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

বাজেট রিপোর্টিং

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ১৫:১১, ১১ জুন ২০২০

এক লক্ষ কোটি টাকা কত বড় না ছোট তা-কী আমি অনুধাবন করতে পারি? আপনি পারেন? ছাত্র অবস্থায় বন্ধুদের ফাঁফরে ফেলার জন্য বলতাম তোকে দশ হাজার কোটি টাকা দিলাম। তুই খরচ কর। একটা শুধু শর্ত–কাউকে টাকা দান করতে পারবি না। দান ছাড়া যে কোন খরচ–ভোগ এমনকি বিনিয়োগও করতে পারিস। এই ফাঁফরটা আমি আমার ২০/৩০ জন বন্ধু এবং ঘনিষ্টজনকে দিয়েছিলাম।

আশ্চর্যের বিষয় যে আমার কোন ঘনিষ্টজন সে টাকা খরচ করতে পারে নাই। এটা ’৯০ দশকের শেষভাগের গল্প। এখন যদি আপনাকে দেয়া হয়, আপনি পারবেন? চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কেউ পারবেন না - তা বলছি না। বলতে চাচ্ছি, এক হাজার কোটি টাকা আসলেই অনেক টাকা। সাধারণ মধ্যবিত্ত যে রকম বাড়িতে থাকে (চারতলা দালান), এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে জেলা শহরে জমিসহ এখন সে রকম প্রায় ২০০ বাড়ি বানানো যায়। দুর্নীতি সহকারে ২৫০ বেডের হাসপাতাল বানানো যায় ৩/৪টা। দুর্নীতি বাদ দিতে পারলে কমছে কম ৫টা। দালানকোঠাসহ প্রাইমারি স্কুল হবে শ’দুয়েক।

বাজেট কত বড় হচ্ছে, কত হাজার না লক্ষ কোটি টাকার হচ্ছে, কোন খাত কত বরাদ্দ পাচ্ছে, কত টাকা কোন উৎস থেকে আসবে, কত টাকা ঘাটতি, কত টাকা ঋণ–এসব কী সাধারণ মানুষ বোঝে? বোঝার শক্তি আছে? বুঝতে চায়? ধারণা করি ৯৯% মানুষ এসব বোঝে না। কিন্তু বোঝাটা দরকার, জরুরি। প্রবৃদ্ধি বাড়লে আমার লাভ কী? এটা একটা কমন প্রশ্ন। কারো কাছে উত্তর নেই। প্রস্তাবিত বাজেট অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটা বাড়াবে বা কমাবে তার আলোচনা দরকার। সরকারের কোন কোন প্রস্তাব আয় বৈষম্য আর কোন কোন প্রস্তাব সম্পদ বৈষম্য বাড়াবে/কমাবে তার একটা ফর্দ থাকা দরকার। মানুষ যেন সে ফর্দ নিয়ে সাদুবাদ বা প্রতিবাদ করতে পারে।

নাগরিকরা জানতে চায় বাজেটে আমার জন্য কী করা হচ্ছে– কয়টা হাসপাতাল বানানো হবে, কতজন নতুন ডাক্তার, নার্স নিয়োগ দেয়া হবে, পুলিশের সংখ্যা কত বাড়বে, অপরাধ কতখানী কমবে, দুর্নীতি রোধে কি কি নতুন পদক্ষেপ থাকছে, কত লোকের নতুন কর্ম সংস্থান হবে, গেল বছর কত কর্ম নষ্ট হয়েছে, গৃহায়ণের জন্য সরকারের নতুন পদক্ষেপ কি, কতগুলো নতুন স্কুল হবে, কত কিলোমিটার রাস্তা মেরামত হবে, কয়টা সেতু হবে, গণপরিবহনে দুর্ভোগ কিভাবে কমানো হবে, সরকারী সেবাগুলো সহজে দেয়ার জন্য কি করা হচ্ছে, ব্যক্তি কর কতটুকু বাড়ল/কমলো– এসব মানুষ জানতে চায়। নিজেকে বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায়। পারে না।

একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা আরেকভাবে বলি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ গত বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে–এরকম একটা সংবাদ থেকে কী বুঝব? স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর একটা মানে হতে পারে যে বেশি বেশি স্বাস্থ্য সেবা পাব, ঔষধ পাব, ইত্যাদি। টাকা বাড়ালেই কি স্বাস্থ্য সেবা বেশি পাওয়া যায়? উত্তর সহজ না। ৬% বৃদ্ধি মানে কী?

গত বছর হাসপাতাল থেকে যতটুকু ঔষধ পেয়েছি এবার তার থেকে ৬% বেশি পাব? গত বছর আমাকে হাসপাতালের লাইনে যত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে এবার তার থেকে কী ৬% সময় কম দাঁড়াতে হবে? এরকম ধারণা কী করা যায়? হাস্যকর, তাই না? আরেকটা মানে হতে পারে, স্বাস্থ্য প্রশাসকদের দুর্নীতির সুযোগ ৬% বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কোন মানেটা যে বুঝব, তাই জানি না। আসলে এইসব বাজেট রিপোর্টিং অনর্থক। মানুষের বুঝ-বুদ্ধির বাইরে। সামান্য সংখ্যক টেকনিক্যাল মানুষ ছাড়া আসলে বাজেট থেকে কেউই কিছু বোঝে না। অনেকে ভাব নেয়।

কত লক্ষ কোটি টাকার বাজেট, গত বছরের চেয়ে বেশি না কম, রাজস্ব খাত, ভ্যাট, আয়কর, অভ্যন্তরীণ খাত ব্যাংক লোন প্রবৃদ্ধি– এসব দেশের ৯৯% মানুষ বোঝে না। বোঝার দরকারও নেই। এগুলো শুধুই অর্থনীতি বিশ্লেষকদের কাজে লাগে। মিডিয়া কার জন্য রিপোর্ট করে? সাধারণ মানুষের জন্য না-কি বিশেষজ্ঞদের জন্য, না-কি দুই দলের জন্য।

এক সঙ্গে দুই দলকে কি সন্তুষ্ট করা যায়? বাস্তবে ওটা না হয় বিশেষজ্ঞদের জন্য না পাবলিকের। জনগণকে বাজেটের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে না পারলে জনগণ সচেতন হবে না। জনগণ সচেতন না হলে বাজেট গণমুখী হবে না। খামাখা বড় বড়, জটিল, কুটিল, কঠিন বিষয় রিপোর্ট করে কি লাভ? কে বোঝে? এক লক্ষ কোটি টাকা কত বড়, তা দিয়ে কি কি করা যায় তাইতো ৯৯% মানুষ ধারনা করতে পারে না। যে রিপোর্ট করে সে কি পারে?

টেলিভিশন আর দৈনিক পত্রিকা একই ঢঙে বাজেট কাভার করে। এই দুই মিডিয়ার পাঠক/দর্শক এক নয়। বাজেট কাভারেজ অবশ্যই ভিন্ন রূপে করা উচিৎ। টেলিভিশন আপামর জনসাধারণ দেখে। দৈনিক পত্রিকা পড়ার মানুষের অনুপাত কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। এখন কিছু পাকনা বুড়ো (অবশ্যই শ্রদ্ধার্থে বলা) ছাড়া খুব বেশি মানুষ দৈনিক পত্রিকা পড়ে বলে মনে হয় না। পত্রিকায় সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যতটা থাকা উচিৎ ততটা অবশ্যই টেলিভিশনে নয়। এই বিবেচনা বোধ মিডিয়াকর্তাদের থাকা উচিৎ।

আরেকটা বিষয় হচ্ছেঃ বাজেট নিয়ে যাই হোক না কেন, আলোচনা হয়। বাজেটের পর থাকতে হয়ে বাস্তবে কি হল আর কি হলো না তার তুলনা। এই তুলনা বিগত পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে খুঁজি, পাই না। প্রতি বছর সিএজি অফিস থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে বাস্তব খরচের হিসেব জমা দেয়া হয়। সেই হিসেবের সঙ্গে সেই হিসেব বর্ষের বাজেটের একটা তুলনা যদি মিডিয়ায় থাকত তা হলে বুঝতে পারতাম সরকার বাজেটের নামে আসলে কী করে। তুলনার অভাবে বাজেটের আসল রূপ আমজনতা কখনোই জানতে পারে না।

লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড। 

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি