ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস’ এর প্রতিপাদ্য ও ফ্যাটি লিভারের প্রেক্ষাপট

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত : ০০:০৫, ১২ জুন ২০২০ | আপডেট: ০০:০৯, ১২ জুন ২০২০

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

বেশিদিন আগের কথা না, মাত্র তিন বছর আগে সারা পৃথিবী থেকে ১৫০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ ঠিক করলেন তারা ফ্যাটি লিভার সম্বন্ধে ব্যাপক জন সচেতনতা তৈরীর জন্য প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস পালন করবেন। ২০১৮ সালের ৫ জুন ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডন থেকে একসাথে প্রচারিত হলো একটি প্রেস রিলিজ আর ১২ জুন পালিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস।

আমার বিশেষ সৌভাগ্য বাংলাদেশের যে দু’জন লিভার বিশেষজ্ঞ এই প্রেস রিলিজটিতে স্বাক্ষর করার সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি তাদের অন্যতম। অন্যজন আমার অগ্রজপ্রতিম জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি লিভার বিশেষজ্ঞ ডাঃ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। প্রথম বছর বিশ্বের ২৫টি শহরে উদ্যাপিত হয়েছিল দিবসটি। 

দ্বিতীয় বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ৬০টিতে। এ বছর আরো বড় পরিসরে পালিত হওয়ার কথা ছিল দিবসটির। সবচেয়ে বড় কথা, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের প্রস্তাবে এ বছর দিবসটি ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস’ হিসাবে উদ্যাপনে সাদরে সম্মতি জানিয়েছিলেন দিবসটির উদ্যোক্তা সংগঠন ‘গ্লোবাল লিভার ইন্সটিটিউট’। অবশ্য কোভিড-১৯-এর ডামাডোলে এখন তা সংকুচিত হয়ে ভার্চুয়াল জগতে কম্পিউটারের পর্দায় সীমাবদ্ধ হয়ে পরেছে।

বছরখানেক আগেও অবশ্য বিষয়টি তেমন ছিল না। আমরা যখন এক যুগেরও কিছু বেশি সময় আগে লিভার বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়ালেখা করছিলাম তখনো লিভারের পাঠ্যপুস্তকে এই রোগের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি পাতা। আর আজ ফ্যাটি লিভার-এর উপরই আছে একাধিক পাঠ্যপুস্তক। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক মেডিকেল প্রকাশনা সংস্থা ম্যাকমিলান আমার সম্পাদনাতেও ফ্যাটি লিভারের উপর একটি আন্তর্জাতিক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছিল।

সেদিন আর এদিন এক নয়। ফ্যাটি লিভার এখন ঘরে-ঘরে, মুখে-মুখে। এ রোগের কথা প্রথম শোনা যায় ১৯৬২ সালে। রোগ হিসাবে ফ্যাটি লিভারের ব্যাপ্তি ব্যাপক। লিভারে সাধারণ চর্বি জমা থেকে শুরু করে এর কারণে লিভার সিরোসিস আর এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। ইদানিং কালে পৃথিবীর আরো অনেক দেশের মতই বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেসব রোগীদের লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মুল কারণ খুজে পাওয়া যায় না, তাদের অনেকেই আসলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

পাশ্চাত্যে ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ এলকোহল। তবে আমাদের মতো দেশগুলোতে মেদ-ভুরি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ, আর হাইপোথাইরয়েডিজম আর মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ফ্যাটি লিভারের মুল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি খুবই বেশী। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৩% ডায়াবেটিস রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশে ৪৯% মানুষ যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস অনেক সময়ই ফ্যাটি লিভার করে থাকে। কর্টিকোস্টেরয়েড, টেমোক্সিফেন ইত্যাদি ঔষধ দীর্ঘদিন সেবনেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে।

তবে ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যাভাস ও লাইফ স্টাইল। সিডেন্টারি বা আয়েশি জীবন-যাপন আর অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা ফ্যাট যুক্ত খাবার খেলে লিভারে চর্বি জমতে পারে। আমাদের দেশে ইদানিংকালের খুবই জনপ্রিয় ‘ফাস্ট-ফুড’ কালচার এদেশে ফ্যাটি লিভারের বাড়তি প্রাদুর্ভাবের সম্ভবত একটি বড় কারণ।

সারা বিশ্বেই ফ্যাটি লিভারের দেখা মেলে। শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ আমেরিকান এ্যডাল্ট ও ১০ ভাগ শিশু ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। জাপান ও ইটালীতে মোট জনসংখ্যার ৩০% থেকে ৫৮%-এর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। 

ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দেখা দিতে পারে যাকে আমরা বলি স্টিয়াটো হেপাটাইটিস বা সংক্ষেপে ‘ন্যাশ’। পাশাপাশি এটিও এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ফ্যাটি লিভার লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। ভারতীয় উপমহাদেশে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের শতকার ১৬ ভাগের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালগুলো ঘাটলে দেখা যায় যে সমস্ত রোগীদের স্টিয়াটো হেপাটাইটিস আছে, তাদের প্রায় ৩০% পরবর্তী সময়ে লিভারে সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন। আর তাদের কারো-কারো এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। ফ্যাটি লিভার থেকে একবার লিভার সিরোসিস হলে, ১৫% রোগী সাত বছরের মধ্যে আর ২৫% দশ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণের ঝুকিতে থাকেন।

অন্যান্য বেশিরভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মত ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোন লক্ষণ থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যাথা, ভার-ভার ভাব বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পরার কথা বলে থাকেন।

শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব রোগীদের প্রায় ৫০%-এর লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশী থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই একথা বলা যায় না। ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আল্ট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটি স্ক্যান বা এমআরআই এক্ষেত্রে বেশী নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের অধিকাংশ রোগীরই রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বেশী থাকে।

ফ্যাটি লিভারের রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য ইদানিংকালে উপকারী পরীক্ষাটি হচ্ছে ফাইব্রোস্ক্যান। এটি অনেকটা আল্ট্রাসনোগ্রামের মত হলেও আসলে আল্ট্রাসনোগ্রাম নয়। এই মেশিনের সাহায্যে খুব সহজেই লিভারে ফাইব্রোসিস বা স্থায়ী ক্ষতির মাত্রা জানা যায়। অর্থাৎ জানা যায় লিভারে সিরোসিস হবার ঝুকি কতখানি। আর এটিই একমাত্র পরীক্ষা যা দিয়ে লিভারে চর্বিও পরিমাপ করা যায়। 

তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষাটি হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নির্ভুলভাবে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্বন্ধেও একমাত্র এই পরীক্ষাটির মাধ্যমেই শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মুল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার একটি অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রুত, অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে তাতে বরং হিতে-বিপরীত হওয়ার আশংকা থাকে। কারণ এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝুকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ঔষধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশনও করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের কারণ নির্ণয় ও তার যথাযথ চিকিৎসাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা থেকে লিভারকে রক্ষা ও পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক গবেষণা চলছে। এদেশে আমরাও এ বিষয়ে সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। একথা ঠিক যে এখনও এজন্য শতভাগ কার্যকর কোন ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে যা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় কিছুটা উপকারী বলে প্রমাণিত। আর এর সবই বাংলাদেশেই তৈরী হয়। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, প্রোবায়োটিক, ভিটামিন-ই ইত্যাদি।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় সর্বশেষ যে ওষুধটি ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে তা হলো ওবিটাকলিক এসিড। এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে আমরা আশাবাদী এই ওষুধটি যে শুধুমাত্র লিভারে চর্বির পরিমাণই কমিয়ে থাকে তাই নয়, বরং এটিই একমাত্র ওষুধ যা দিয়ে সম্ভবত লিভারের স্থায়ী ক্ষত বা ফাইব্রোসিসও কমিয়ে আনা যায়, অর্থাৎ ঠেকিয়ে দেয়া যেতে পারে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারও। খুবই খুশির কথা এই যে বাংলাদেশেও এই ওষুধটি তৈরি এবং বাজারজাত করা হচ্ছে।

একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হত হার্ট বা ব্রেনে চর্বি জমে হার্ট-এ্যাটাক বা স্ট্রোকের মত মারাত্বক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু বিগত দশকে সেই ধারনার আমুল পরিবর্তন এসেছে। এটি আজ প্রমাণিত যে ফ্যাটি লিভার, লিভারের অন্যতম প্রধান রোগ। সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য  চিকিৎসক ও রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ শুরুতে ব্যাবস্থা নিলে এ রোগ অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য। আর এবারের ‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবসের’ প্রতিপাদ্যও এটাই।

চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
এবং চেয়ারম্যান, ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দি লিভার বাংলাদেশ

এমবি//
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি