করোনা বাস্তবতা বিবর্জিত বাজেট
প্রকাশিত : ১৪:৫২, ১৩ জুন ২০২০
করোনা পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলো কেমন হবে তা নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলছে বিশ্বময়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানেন না কবে নাগাদ করোনাকে দমন করা যাবে। নোবেল বিজয়ীসহ বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদেরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না যে করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতিটা কত গভীর হবে আর কতকাল ধরে চলবে। এর মধ্যে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে সহসা ওঠা যাবে না। বেশিরভাগের মতামত এরকম যে করোনা দমনের পর অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে ৩ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে। যেমন লেগেছিল ৩০ দশকের মহামন্দার পর।
আমাদের অর্থমন্ত্রী ওসবের তোয়াক্কাই করলেন না। এমনভাবে বাজেট দিলেন যে মনে হলো দুনিয়ায় করোনাভাইরাস নামক কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই; দুনিয়াটা, দেশটা একেবারে স্বাভাবিক। গতানুগতিকভাবেই বাজেটের আমার-আকৃতি বড় করেছেন। কিছু পণ্যের উপর কর কমিয়েছেন, কিছুর উপর বাড়িয়েছেন, কোন খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন, কোন খাতে কমিয়েছেন–যেমনটা সবসময় করেন। একদম আগের মত। স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে তবে সে বরাদ্দ কিভাবে করোনা মোকাবেলা করবে তা বোঝার কোন উপায় নেই। বর্তমান সময়টা যে একটা ক্রান্তিকাল - বাজেটের বিষয়-আশয় দেখলে তা বোঝার কোন উপায় নেই।
বাজেটে ঘোষণার বেশ কয়েকমাস আগে থেকে বড় বড় অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, বুদ্ধিজীবী, সকলেই বলেছেন যে এবারের বাজেট ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করতে হবে। বাজেট কী হওয়া উচিৎ তা নিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই আমার দুটি লেখা প্রকাশ হয়েছে। সে লেখা দুটিও একই রকম ভাবধারা থেকে লেখা। একটা লেখায় অর্থনীতির কয়েকটি প্রধান খাত ধরে ধরে দেখিয়েছি কি কি করনীয় আছে। আরেকটা লেখায় করোনা দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার উপায় বিধৃত করা হয়েছে।
করোনা মোকাবেলা করার জন্য বাজেটে যা যা দরকার ছিল তাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ১) করোনা যে সকল ক্ষতি করেছে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করা; ২) আগামী দিনের জন্য সামাজিক সুরক্ষা তৈরি করা; এবং ৩) করোনা দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করা। বাজেটের প্রধান দূর্বলতা হচ্ছে এই তিনটি বিষয়ের একটাকেও সুনির্দিষ্টভাবে মোকাবেলা করার উপায় বাতলানো হয়নি।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ বেশি দিয়েছেন; করোনা মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছেন। বরাদ্দ বেশি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, এমন নয়। বেশি বরাদ্দ বেশি দুর্নীতির পথও তৈরি করে। করোনা মহামারীর মত এত ব্যাপক এবং সর্বগ্রাসী দুর্যোগের সময়ও দুর্নীতিবাজদের বোধোদয় হয়নি। তারা করোনা যুদ্ধে সম্মুখসারীর যোদ্ধা চিকিৎসা কর্মীদের জীবন রক্ষাকারী মাস্ক, পিপিই নিয়েও ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড না থাকায় বাড়তি বরাদ্দ দুর্নীতির সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারে। থোক বরাদ্দ দুর্নীতির উর্বর ভূমি হয়ে উঠতে পারে।
করোনা মহামারীর সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামাজিক প্রতিরোধ শক্তি কত দুর্বল। হাসপাতালে হাসপাতেলে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মরেছে অনেক মানুষ। এই সময়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর থেকে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হবে বলেঅনেকের ধারণা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল যে এখন শুধু করোনা টেস্ট করতে ৮/১০ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বিছানা নেই; করোনার আগেও ছিল না। করোনা রোগীরা অব্যবস্থাপনার ভয়ে হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না; বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছে। ডাক্তারেরাও সে পরামর্শই দিচ্ছেন। স্বাভাবিক সময়েই সারাদেশে সরকারী হাসপাতালে বিছানার থেকে মেঝেতে বেশি মানুষ থাকত। করোনার আবির্ভাবে সে পরিস্থতি আরও খারাপ হয়েছে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এমন যে সরকারী ডাক্তারেরা বেসরকারী হাসপাতালে বা নিজের চেম্বারে রোগী পাঠানোর জন্যেই শুধু সরকারী হাসপাতালে যান। অনেক হাসপাতালে মেডিকেল এসিস্ট্যান্টরা অস্ত্রপচার করে–এমন ভয়াবহ খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। সরকারী হাসপাতালে ঔষধ এবং অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণ না পাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এগুলো দুর্নীতিবাজ ডাক্তার আর প্রশাসকদের পেটে যায়।
এই সুযোগে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত বেসরকারী হাসপাতাল গজিয়ে উঠেছে। সেগুলো চিকিৎসার নামে মানুষের পকেট কাটেঃ অপ্রয়োজনে টেস্ট করে, অস্ত্রপচার করে বিল বাড়ায়; প্রায়ই ভুল চিকিৎসা করে মানুষ মেরে ফেলে। দুই/একটা ছাড়া, করোনা মোকাবেলায় বেসরকারী হাসপাতাল কোন কাজে আসেনি। তারা করোনা রুগীতো বটেই, করোনার ভয়ে সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসা দেয়নি। একটা হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীদের পুড়িয়ে মেরেছে। চিকিৎসা সামর্থ্য বৃদ্ধি করার জন্য স্বল্প কিংবা দীর্ঘ মেয়াদী কোন পদক্ষেপ বাজেটে নেই।
করোনাভাইরাস শুধু মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেনি, কর্মহীন করেছে কমবেশি ছয় কোটি মানুষকে। এই মানুষেরা আয় হারিয়ে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সামগ্রিকভাবে পর্যটন খাত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর সকল ব্যবসা-বাণিজ্য লকডাউন খুলে দেয়ার পরেও অত্যন্ত ঢিলেতালে চলছে।
এসকল ব্যবসা-বাণিজ্য ২৫% থেকে ৫০/৫৫% পর্যন্ত বিক্রয় করতে পারছে। এত কম বিক্রি করে কেউ মুনাফা করতে পারে না। সকলেই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসা এবং বণ্টনের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও স্বাভাবিক পরিস্থিতির তুলনায় অনেক কম বিক্রি করতে পারছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে পণ্যের দামে। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মুরগীর দাম এখন আগের থেকে বেশ কম।
করোনা প্রতিরোধ বলতে দেশে এখন বাস্তবে কিছু নেই; আগামীতে থাকবে এমন কোন লক্ষণও নেই। তার মানে, করোনা বিনা বাঁধায় ছড়াতে থাকবে। করোনা যতদিন ছড়াতে থাকবে সচেতন মানুষ ততদিন ঘর থেকে বেড় হবে না; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোন পণ্য বা সেবা কিনবে না, অর্থনীতি এমন ভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত টিকা বা নিরাময়ী ঔষধ না পাওয়া যায়।
অর্থনীতির মন্দগতির ফলে দিনে দিনে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা হারাবে, লোকসান বইতে না পেরে কর্মী ছাঁটাই করবে। আরও বেশি মানুষ কর্মহীন হবে। করোনার কারনে ইতোমধ্যে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে আরও অনেক হবে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে বিদেশে কর্মহীন প্রবাসীরা। দারিদ্র্যের হার এখন আর ২১ শতাংশে নেই। অনেকে ধারনা করছেন ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যে নিপতিত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কোন পদক্ষেপ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেননি।
যতদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসে ততদিন পর্যন্ত কর্মহীন পরিবারগুলোকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মাসে নগদ অর্থের সহায়তা দেয়া দরকার। এ নিয়ে বর্তমান লেখকসহ অনেক বড় বড় অর্থনীতিবিদ করোনা আক্রমণের শুরুতেই অনেক লেখালেখি করেছেন। তাদের পরামর্শ ছিল, সরকার কর্মহীন ১.৫ কোটি পরিবারকে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫,০০০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পাঠাবে।
সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদের হাতে টাকা থাকলে ব্যাসিক অর্থনীতি চালু রাখা সহজ হয়। সরকারের এই টাকার প্রবাহ চালু থাকলে কৃষি পণ্যের দাম কমতে পারত না। কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষ এই করোনাকালে অর্থনীতিটা বাঁচিয়ে রাখতে পারত। তা হয়নি। দিন দিন অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। সংকোচনের হারটা কমিয়ে রাখা যেত।
দেশে কর্ম সংস্থানের কোন ডাটাবেজ নেই। সরকার অনেক চেষ্টা করে কোনমতে একটা ডাটাবেজ দাঁড় করে ঈদের আগে ১.৫ কোটি নয়, তার মাত্র তিনভাগের একভাগ মানুষকে প্রতিমাসে ৫,০০০ টাকা নয়, একবার ২,৫০০ টাকা মোবাইলের মাধ্যমে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। নতুন বানানো ডাটাবেজ ভুলে ভরা।
সে টাকা পাঠানো নিয়েও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়ায় তা বন্ধ ছিল। এখন পর্যন্ত ৫০ লাখ পরিবারের সকলে এই টাকা দেয়া যায়নি। সদ্য ঘোষিত বাজেটেও এ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। কর্মহীন মানুষ কি খাবে, কি করে বাঁচবে তা নিয়ে সরকারের কোন চিন্তাভাবনার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায়নি। সরকার এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রকৃতির মর্জির উপর ছেড়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
করোনা দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার সুযোগ এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। দুনিয়াব্যাপী জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতির দাম এখন অনেক কম। আগামীতে আরও কমবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারনে চীন থেকে বিভিন্ন দেশের লোকেরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। সে বিনিয়োগ ধরার জন্য এখনই মোক্ষম সময়। বিনিয়োগ ধরার জন্য দেশের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে।
তাছাড়া আমাদের রয়েছে বেশ বড়সড় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তার উপর আছে বৈদেশিক মুদ্রায় অত্যন্ত কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করার এখনই সময়। দরকার শুধু সরকারের উদ্যোগ আর প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেয়া। বিনিয়োগটা সরকার এবং বেসরকারী খাত যৌথভাবেই করতে পারবে। অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটে এ বিষয়ের কোন উল্লেখ নেই।
এ বাজেটের আয় এবং ব্যয় যেকোন দিকে তাকালে বোঝার উপায় নেই যে সারাদুনিয়ায় মহামারী চলছে। এই মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক হবে বলে বেশ কয়েকমাস ধরে বলে আসছে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং আরও অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর একেকটা ৬% থেকে ১০% পর্যন্ত সংকুচিত হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছিল। বিশ্ব অর্থনীতি মোটের উপর ৩% সংকুচিত হবে বলে আরও তিন/চার মাস আগে থেকে বলা হচ্ছে। সে অবস্থার ধণাত্বক পরিবর্তন হয়েছে এমন কোন আলোচনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেই।
দিন দিন বরং খারাপ সংবাদই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পোন্নত দেশগুলোর মত অতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না বলে মনে করি। তারপরেও বাজেটে দেয়া প্রবৃদ্ধির টার্গেট ৮.২ শতাংশকে কোন মতেই গ্রহণ করা যায় না। আসলে এবারের বাজেটটা দেখলে মনে হয়, দুনিয়ায় করোনা নামের কোন জীবাণুর অস্তিত্ব নেই, ছিল না। বাজেট প্রণয়নে করোনার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। এটা বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় তৈরি করা বর্তমান বাস্তবতা বিবর্জিত কাগুজে একটা দলিল মাত্র।
লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।