কেন এই ‘বাবা দিবস’!
প্রকাশিত : ১৫:৩৪, ২১ জুন ২০২০
বাবা দিবসের কোন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি নাই, সে বিশাল বিতর্কের বিষয়। তবে আমি বিষয়টির কোন পক্ষেই অবস্থান করব না। নিবন্ধটির পাঠকই শেষমেষ নির্ধারণ করতে পারবেন কি প্রকারে দিবসটি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে নাকি নিছক একটি দিন শেষ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য যে, দিবসকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার গভীরতা উপস্থাপন করা যায় না। আবার করা যায়ও বটে। কিন্তু সেই অবস্থানটি আমাদের জন্য কতটুকু সেটাই আলোচ্য বিষয়। আমি তো দেখছি, দিবস না হলেও যা আমার দিবস হলেও তাই।
‘বাবা’। অনন্য এক শব্দ। পৃথিবীতে ‘মা’কে যতো ভালোবাসা ও সম্মান দেওয়া হয়েছে, তারপরই রয়েছে ‘বাবা’। যুদ্ধে লড়াইরত সৈনিককে তার ঢাল যেভাবে তলোয়ারের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তমনিভাবে বাবা সব অপঘাত থেকে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। ঢাল না থাকলে কি হতো, তা হয়তো সৈনিকই কিছুটা বুঝতে পারেন কিন্তু বাবার অভাব তাকে তদরুপ তাড়না দেয় না, যদরুপ ঢালহীন সৈনিকের হয়। ঢালহীন সৈনিক বুঝতে পারে ঢাল তার জন্য কতটুকু জরুরি। তেমনি বাবা হারানো সন্তান বুঝতে পারে বাবা তার জীবনে কি ছিলেন? বাবার জন্যই সে কতটুকু সাহসী ও প্রাণচঞ্চল ছিল।
বাবা’রা সব পারেন, সন্তানের জন্য সব করেন। যে তরুণ-যুবক স্বেচ্ছাচারী হয়ে কতই না আড়ম্বরপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করত, সেই তরুণই এক দিন অনাড়ম্বরের সারথী হয়ে যান। কারণ তিনি বাবা হয়ে সন্তানের জন্যই যেন পৃথিবীর সব স্বাচ্ছন্দ কিনে আনেন। সন্তানের সুখের সওদাগর বনে যান। ডাক হরকরার মতো বাবারা ছোটাছুটি করেন নিরন্তন। সন্তানের জীবনে যেন পঙ্কিলতার কোন স্পর্শ না লাগে এ জন্য বাবা ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। পরম নির্ভরতায় বাবার হাত ধরেই সন্তানের পথচলা শুরু হয়ে অবিরত চলতেই থাকে। নিরবে-নিভৃতে বাবারা সন্তানের জন্য সুখ ত্যাগ করেই যান। এ ত্যাগ কোন ইতিহাসে গাঁথা হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গুঞ্জণ তোলে না, এ ত্যাগ আপাত কোন প্রাপ্তি আশা করে না। এ ত্যাগ শুধুই ভালোবাসার।
বাবা! মধুর এক শব্দে পৃথিবীজোড়া নির্ভরতা যুক্ত। প্রতিটি মানব সন্তান এ নির্ভরতার ছায়ায় জীবনভর থাকতে চান। কিন্তু তা কি হয়? বাবারা আসেন সন্তানের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে, তারপর নিরবে-নিভৃতে চলে যান। বাবা চলে যাওয়ার পরেই না সন্তানের কাছে বাবার অভাব অনুভূত হতে শুরু করে।
বাবার হাতের কড়ে আঙ্গুলটা ধরেই শুরু হয় সন্তানের পথ চলা। এই তো সে দিনেই বাবার বা হাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে গ্রামের মেঠো বাট দিয়ে গ্রাম্য মেলায় প্রথম যাওয়া। বাবার হাত ধরেই শত ভীড়ে রঙ্গীন পৃথিবী চিন্তামুক্তভাবে আবিষ্কার করা, হারিয়ে যাওয়ার নেই-কো ভয়; বাবার আঙ্গুল যে আছে হাতের মুঠোয়। সবে হাঁটতে শেখা সন্তান বাড়ির বাইরে প্রথম পা ফেলে বাবার হাত ধরে। বাইরে গিয়ে ছোট্ট অচেনা চোখে ঠেকেছে হাজার হাজার অচেনা-অজানা কত কী…। বাবা ওটা কি, এটা কি বাবা? ওই যে ওইটা, দেখ দেখ বাবা, এই তো গেল! পৃথিবীর সব কিছুই বাবা আঙ্গুল উঁচিয়ে চিনিয়ে দেন। শুরু হয় সন্তানের অবিরল পথচলা। সন্তান যখন একটু ঠিকঠাকভাবে পথ চলতে শুরু করে তখন বাবারা চলে যান। আর ফেরেন না। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বাবাদের যেন চুক্তি হয় চুপটি করে চলে যাওয়ার।
এখন আসেন দিবস থাকা বা না থাকার বিষয়ে। কেউ কেউ নাক শিটকান- এই দিবস বাঙ্গালীদের জন্য নয়। এটা পশ্চিমা সংস্কৃতি। আবার কেউ আধুনিকতার একটা সিড়িও মনে করে থাকেন। কিন্তু দিবস হোক বা না হোক, এ কেমন হলাম আমারা! যেখানে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিয়ে সন্তানের টালবাহানা রুখতে আইন করতে হয়! আইনের মাধ্যমে বাবা-মাকে তাদের অধিকার আদায় করতে হবে। তাহলে যে জাতি সত্ত্বার গৌরবের জিকির করছি সেটাই কি আমরা! এখানে দিবস হয়ে কি হলো, আর না হলেই বা কি হতো? আমরা যতো তথাকথিত উত্তরাধুনিকতার ভাব ধরি না কেন, আমরা যেন বর্বরতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। এটাও ঠিক বর্বর যুগেও মনে হয় বাবা-মাকে এতটা অসম্মান ও অবহেলার শিকার হতে হয়নি।
সাত ভাইয়ের ছোট, বাবার ছোট সন্তান হওয়ার কারণে ভালোবাসা ও অভিমান একটু বেশিই ছিল যেন। সেই অভিমান এখন আর হালে পানি পায় না, পাবেও না। গত এক বছর হলো বাবাকে হারিয়েছি। সেই দিন রাতের কথা মনে আছে আমার। রাত দশটায় টেলিভিশন স্টেশনের বার্তা কক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। ঠিক সে সময়ই বড় ভাইয়ের ফোন, ‘আব্বা বেশ অসুস্থ। আমরা হাসপাতালে, তুই অফিস থেকে বেরিয়ে চলে আয়।’ সেল ফোনটা কান থেকে টেবিলে রেখে দিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে এক নাগাড়ে তাকিয়ে কি যেন হাতড়াচ্ছিলাম। কিসের যেন একটা প্রতিবেদন লিখছিলাম, তখনও শেষ হয়নি সেটা। উঠে দাঁড়ালাম। এর আগেও বেশ কয়েকবার অসুস্থ হলেও এই অসুস্থের খবরে হৃদয়টা কেন যেন কেঁপে উঠল। এরপর ফোনের পরে ফোন এলো। আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢাকায় অপর ভাইয়ের সঙ্গে মধ্যরাতে বাড়ির পথে। শ্বাস বন্ধ হয়ে দেহ থেকে প্রাণ চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে যেমন দেহ মৃদু কেঁপে ওঠে, তেমনি করে কেঁপে উঠল আমার। বাবা অসুস্থ কিন্তু সবার ব্যতিব্যস্ততায় তো তা মনে হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অজান্তেই বারিধারার নহর বইতে লাগল। পথিমধ্যে ভাই আস্তে করে জানালেন, বাবার চলে যাওয়ার কথা।
বাড়িতে যখনই যাই। প্রতি রাতে পৌর কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু আমি কথা বললেও বাবার কবরটা ছিল একদমই নিরব। আমার বাবা আজ নেই। সব বাবার সঙ্গে সন্তানদের যেমন সুন্দর স্মৃতি থাকে আমারও তেমনি রয়েছে অনেক স্মৃতি। বাবার কক্ষে বাবার পানদানি, টর্চ লাইট ও চশমাখানা এখনও পড়ে আছে নিরুত্তাপ। ওই বস্তুগুলোও যেন শোকের মাতমে দিশেহারা। আমি বাবার বিছানায় বসে আলমিরা ভরা বই হাতড়ে বাবার স্পর্শ খুঁজেছি। স্পর্শ পেয়েছি কিনা জানি না, তবে বিচ্ছেদের কড়া কষ্টটাই অনুভূত হয়েছে।
লেখক- সাংবাদিক।
এমএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।