টাকাটা হাসিমুখেই হাতে তুলে দিলেন বাবা
প্রকাশিত : ১৮:৩২, ২২ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৮:৫১, ২২ জুন ২০২০
সময়টা ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। উত্তরবঙ্গে এই সময়টা কতটা শীতের তীব্রতা তা বোধহয় কাউকে নতুন করে বলতে হবে না। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির কোচিংয়ে তখন আমি প্রাণের শহর রংপুরে।
ছোটবেলা থেকেই যা কিছু চেয়েছি বাবা দেননি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কোন দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারি আপনার খুব কাছের এবং সবচেয়ে পরম আদরের ছেলে হয়েই বড় হয়েছি। এসএসসি পরীক্ষার বাকি আর মাত্র আড়াই মাস। শহরে রেখে সন্তানকে পড়াশোনা করানো একজন কৃষক বাবার জন্য কতটা কঠিন সেসময়টা প্রথম আঁচ করতে পেরেছিলাম, যা আজও মনে করতেই অঝোরে কাঁদি।
ডিসেম্বরের ওই সময়টায় মাসের অর্ধেক প্রায় যায় কিন্তু টাকা পাঠাতে না পারায় মেস ভাড়া ও খাওয়ার টাকা দিতে পারিনি তখনো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম বাবার কাছে টাকা নেই। শেষ মেষ সম্প্রতি জন্ম নেয়া একেবারে ছোট ছোট দুটো ছাগল ছানা মাত্র ১৪০০ ( এক হাজার চারশত) টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা কনকনে শীতের মধ্যেও সশরীরে আমাকে দিয়ে যান।
আপনার গায়ে তখন একটি মাত্র পাঞ্জাবি, শরীরে নেই কোন শীতের পোশাক, এমনকি মাফলারও। নিজের ব্যবহৃত গামছা মাথা আর কান ঢেকে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টা। টাকাটা হাতে তুলে দিয়েছেন হাসিমুখেই। কোন কষ্ট কিংবা হতাশা তাতে লেগেছিল না। বরং বুকে পুষে রাখা ছিল লাল টুকটুকে স্বপ্নখানা, ছিল সন্তানকে বড় করার অদম্য সাহস আর প্রেরণা জাগানোর প্রতিচ্ছবি। যে মুহূর্ত আজও আমার প্রতিক্ষণে চোখের সামনে অবলিলায় ভেসে ওঠে বাবা।
আামিও আমার নিজের চেয়ে, তোমার সেই ত্যাগ আর কষ্টোগুলোকে বৃথা যেতে দিতে চাইনি। হয়েছিলও তাই। তার মান রেখেছিলাম ভাল ফলাফল করে। রেজাল্টের কথাশুনে আমার চেয়ে আনন্দের একফালি চাঁদ দেখেছিলাম তোমার চোখেমুখে।
তোমার অক্ষর জ্ঞানার্জনের কোন সুযোগ হয়নি। কিন্তু, নিজের সন্তানদের কখনো পড়ালেখা ছেড়ে কাজে ডাকোনি। উল্টো পড়ালেখার জন্য হাজারও কষ্টোগুলো সয়ে গেছো অবলিলায়। এমনকি, সমাজের আট-দশটা শিক্ষিত মানুষ তার সন্তানকে সুশিক্ষিত করে তুলতে যতটা তৎপর, তার চেয়েও হাজারগুণে পেরেশানি তোমার।
এমনকি, সন্তানকে শুধু একাডেমিক পড়াশুনা নয়, দিয়েছো নৈতিক শিক্ষা। তুমি কোরআন বেশ ভালই পড়তে পারো। যার ফলে প্রথম কোরআনের বাণী শুনেছি পৃথিবীতে জন্মের পরই তোমার সুরলিত কণ্ঠে আযানের মধ্যদিয়ে। শিশুকাল থেকেই ধরে ধরে কোরআন শিখিয়েছো, সত্য বলতে শিখিয়েছো, কিভাবে ছোটকে স্নেহ, বড়কে সম্মান করতে হয়, তা তোমার ব্যক্তি জীবন থেকে শিখেছি। মধ্যকথা, পারিবারিক শিক্ষা বলতে যা বুঝায়, বলা চলে সবটাই তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।
এরপরের জীবন সেতো শুধুই তুমিই বাবা। কৃষিকাজ করে সংসার চলে তোমার। তারপরও শহরে দেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করালে। প্রতিমাসে টিউশন ফি আর মেসভাড়া বাবদ দিতে হতো সাড়ে ৪ হাজার টাকা। মোটে দিতে ৫ হাজার। প্রতিটি টাকায় লেগে থাকতো তোমার ঘাম।
প্রথম বর্ষের রেজাল্ট একটু খারাপ হওয়ায় মাকে প্রতিষ্ঠানে পাঠালে। কখনো জিজ্ঞেস করোনি, বাবা পড়াশোনা করছো তো? শুধু ভাবতে আমার সন্তান কখনো হেরে যাবে না। অবশ্যই ভালকিছু করবে।সেবারও হয়েছিল তাই। তোমার মান রাখতে পেরেছিলাম। জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটায়ও তুমিই সেনাপতি ছিলে বাবা। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছো বলেই হয়তো জয়ী হয়েই ফিরেছিলাম।
এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে একদিনের মাথায় নিজ শহর ছেড়ে রাজধানীতে আসলাম। যত কষ্টই হোক, তোশক, কাথা, কম্বল, ট্রাংক প্রভূতি আসবাবপত্র কিনে দিয়ে নগত ২৫,০০০ (পঁচিশ হাজার) টাকা হাতে দিলে। বললেও না, শহরে যাচ্ছো ভালভাবে চলিও, ঠিকমতো পড়াশোনা করিও।
শুধু কাছে নিয়ে অনেক্ষণ তাকিয়েছিলে, বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল কিন্তু কেন জানি চোখেমুখে এতটাই অশ্রু ছিল, তা আর হয়ে ওঠেনি। বুকভরা স্বপ্ন নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে পাঠালে। যেখানে ছিল শুধুমাত্র জয়ী হয়ে ফেরার তাড়া।
তোমার আকাশ সমান দোয়া আর ভালবাসায় ৬টি মাস সর্বোচ্চ চেষ্টা করে কাঙ্খিত ফল নিয়েই ঘরে ফিরেছিলাম। সেদিন, অঝরে আনন্দের কান্না করেছিলে তুমি। আমিও শুকরিয়া স্বরূপ মহান রবের কাছে মাথা ঠেকিয়ে অঝোরে কেঁদেছি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও তোমাকে রেহাই দেইনি। প্রতিমাসেই ৩০০০ টাকাসহ বিভিন্ন কাজে অনেক টাকা নিয়েছি তোমার কাছ থেকে। যা চেয়েছি, কখনো বলোনি পারবে না দিতে। আজ আমি কর্মজীবনে। এ সময়ে যেভাবে তোমার পাশে থাকার কথা আমি পারছি না। তারপরও তোমার নেই কোন অভিযোগ।
জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটাও একা নিয়েছি। নিজের বাড়ি থেকে শতশত মাইল দূরে বিয়ে করেছি। গাড়িতে ওঠার অভ্যাস নেই বলে যেতে পারনি তুমি। কষ্টের পাহাড় চেপে রেখেছো বুকে। তারপরও কোন অভিযোগ, অনুযোগ নেই তোমার। তুমি কি বাবা!!!
সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে নিজের জীবনকে তীলে তীলে শেষ করেছো। এখন আর ঠিকভাবে শরীরটা আর কাজ করছে না তোমার। সে অনেক অনেক ক্লান্ত। তার বিশ্রাম দরকার। তারপরও তুমি ছুটছো। সন্তানদের কাছে হাত পাততে রাজি নও তুমি। কোনো সন্তান টাকা দিল কী-না, তা নিয়ে মনের মাঝে অনেক কষ্ট থাকলেও, সন্তানদের তা বুঝতে দাও না।
আজ তুমি শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ। কিন্তু আমি এখনও তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি। শুধু আশার ভেন্টিলেশনে রেখেছি তোমায়। তারপরও আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছো প্রতিনিয়ত। বলছো, সুদিন ফিরবে বাবা, ধৈর্য্য ধরো। তবে, চেষ্টার কমতি রেখোনা।
আজও যখনি বাড়িতে ফিরি, শুধু চেয়ে থাকো মুখের দিকে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকি, একদিকে যেমন আনন্দ পাও, অন্যদিকে হারানোর ভয় কাজ করে তোমার মনে। কখন বলি বাবা ছুটি শেষ।
শহুরে জীবন শুরুর পর থেকে বাড়ি থেকে চলে আসার প্রতিটি পর্বে বুকে নিয়ে শুধু অঝরে কাঁদো আর চুমু খাও। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে, সবকিছু ফেলে ছুঁটে যাই তোমার কাছে।
একজন বাবা হওয়া সত্যিই অনেক কঠিন। আমার এই পথচলায় প্রতিটি পদচারণায় শুধুই তুমি বাবা। তোমার মতো বৃক্ষ ছাঁয়া দিচ্ছে বলেও আজও শ্বাস নিতে পারছি। জীবনে হয়তো তোমাকে অনেক কষ্টে রেখেছি, এখনও তোমার পাশে কাঙ্খিত রূপে দাঁড়াতে পারিনি কিন্তু, তোমার দেয়া শিক্ষায় একজন নৈতিকতা ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে পেরেছি বলে মনেকরি।
সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই চাওয়া, তোমার জন্য আর আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন মায়ের জন্য যেন কিছু না করা পর্যন্ত আমাকে কিংবা তোমাদেরকে তুলে না নেন।অনেক অনেক অনেক ভালবাসি বাবা।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।