সূচক দিয়ে কি জীবন বাঁচানো যায়!
প্রকাশিত : ২০:২৭, ২৭ জুন ২০২০ | আপডেট: ২০:৪২, ২৭ জুন ২০২০
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমজিডি) বাস্তবায়ন শেষে বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন, মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু, দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় এগিয়ে ছিল। গত কয়েক বছরে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে হু হু করে। আগামী অর্থবছর আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় দুই লাখ কোটি টাকায় ঠেকবে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ তিন মাস কাজ না করে চলতে পারে না বেশিরভাগই মানুষ। কর্মজীবি মানুষ তো সাতদিনও নয়। আর শিল্পপতি বিশেষত গার্মেন্টস মালিকরা তো এক মাসেই কুপোকাত হয়ে সরকারের কাছে হাত পাতলেন। সেই অবহেলিত জনগণের করের টাকা দিয়েই তাদেরকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার কি উন্নয়ন হয়েছে! সেটা নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। আমরা এমন স্বাস্থ্যখাত গড়েছি, যেখানে খোদ চিকিৎসকরাও একটা অক্সিজেন মাস্ক না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালের সামনে কান্নারত বাবা তার শিশুকে কোলে নিয়ে নির্বাক বসে থাকছেন। মারাও যাচ্ছেন। রোগী বহনের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে পাশাপাশি কেউ রোগীকে কাঁধে নিয়ে আবার কেউ সেই রোগীর মুখে লাগানো অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে নিয়ে হাঁটছেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হ্যাঁ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন তো হয়েছেই। হাসপাতালের জানালায় হাজার টাকার পর্দা নামিয়ে উঠানো হয়েছে লাখ টাকার পর্দা। শত টাকার বিছানার চাদর ফেলে বিছানো হয়েছে হাজার টাকার চাদর। ঘুষ আর দুর্নীতির টাকা গুণতে গুণতে মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢালতে ১০/১৫ লাখ টাকায় কেনা হচ্ছে ফ্রিজ। যার কিনা বাজারমূল্য ১ লাখেরও কম। আর এসব যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাারা তো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। কোটি টাকার বাড়ির মালিক। হোক না সে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তাই বলে কি তার শখ আহ্লদা থাকতে পারে না!
আমরা কিন্তু সামাজিক সূচকে বেশ এগিয়ে। এবার আসুন, এটা নিয়ে ভাবি। সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে এখনো পাড়া মহল্লার মোড়ে আড্ডা দেয় ১০/১২ জন কিশোরের দল। কেউ কেউ আবার সিগারেটও শেয়ার করছেন নিদ্বির্ধায়। কিন্তু বাবার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে ডাস্টিবনে। করেনাক্রান্ত মাকে ফেলে আসা হচ্ছে গহীন জঙ্গলে। মৃত ব্যক্তির সৎকারে পাওয়া যায় না কোনো স্বজন। আপনি হয়তো বলবেন, এসব বিচ্ছিন ঘটনা।
আর্থিক সূচকটাও তো বেড়েছে অনেক। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এবার বাড়ুক মাথাপিছু ব্যাংকও। যেসব ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। সুইস ব্যাংকেও বাংলাদেশীদের টাকার পাহাড় জমছে। অথচ সুইস বাংকে কমেছে পাকিস্তান আর ভারতের আমানত। কিন্তু আমরা কত ধনী দেখুন, সেখানে আমাদের আমানত বাড়ছে। ঘরের মানুষের খাবার না থাকলে কি হবে? সুইস ব্যাংকে তো আমানত আছে! হ্যাঁ, সেটাই। সবাই শুধু ভবিষ্যতের কথা ভাবে।
আরে ভাই, বর্তমানে ফিরে আসেন। কাল যদি মরেই যান তো সুইস ব্যাংকের টাকাটা কী সাথে নিয়ে যাবেন? প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে ৩৪, ৩৮, ৪৩, ৪৫, ৫৩ জন করে। এটা কি কোন সংখ্যা হলো। ভারতে তো আজকেও মারা গেছে ১৯১ জন। আর পাকিস্তানে মরেছে ৭৩ জন। সে তুলনায় আমাদের মৃত্যু হার তো কমই তাই না? কিন্তু পয়সা উল্টো করে দেখুন তো! এপিঠ আর ওপিঠে কোন অমিল আছে কিনা? বিশ্বের অন্য কোন দেশে চিকিৎসা না পেয়ে কি কেউ মারা যাচ্ছে? আছে কোন উদাহরণ? সিঙ্গাপুরে একজন বাংলাদেশী প্রবাসীকে সুস্থ করতে সময় নিয়েছে তিন মাস। ঐ ব্যক্তি এ সময়ে ওজন হারিয়েছেন ২৪ কেজি। কিন্তু আমাদের এখানে কি হচ্ছে? সুস্থ মানুষ হাসপাতালে গিয়ে লাশ হয়ে বেরুচ্ছে। তফাৎ এটাই!
১ লাখ ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। সুস্থ হয়েছে ৫৪ হাজার। হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না রোগী। আবার বলা হচ্ছে, হাসপাতলের অর্ধেক শয্যাই খালি। হ্যাঁ খালিই তো থাকবে। সেবা দেয়ার মানসিকতা আর সক্ষমতা না থাকলে ভর্তি না করাই তো ভালো। মৃত্যু যেখানে শুধুই একটা সংখ্যা। সেখানে এর চেয়ে বেশি আবার কি?
আসুন, একটু হিসাব মিলাই অন্যখানে। আরেকটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ- বজ্রাপাত। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আর গত দু’মাসে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। এটাও একটা তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যেখানে মানুষের কোন হাত নেই। কে বলে হাত নেই? এই যে আপনার দুই হাত। আমাারও তো দুই হাত। এছাড়াও রয়েছে আরও একটা হাত, অজুহাত! হ্যাঁ যার কিছু করার ক্ষমতা নেই, তার শুধু অজুহাতটাই আছে। সাথে অন্য দুটো হাতও আছে। যেটার কোন কাজ নেই। থাকলেও সেটা চুরি চামারির জন্য।
বড় বড় আর পুরনো সব গাছ কেটে ফেলবেন। ইচ্ছামত শোবার ঘরের ছাদে বসাবেন মোবাইলের টাওয়ার। ঘুমানোর সময়ও বন্ধ করবেন না মুঠোফোনের ইন্টারনেট কানেকশন। বৃষ্টিতে ভিজে করবেন কাজ। খোলা আকাশে করবেন হাল চাষ। বীরের জাতি মনে করে মাথায় একটা ছাতা বা মাথাল লাগাবেন না। তো বজ্রপাত কোথায় পড়বে। বাড়ির ছাদে? নাকি আপনার টেকো মাথার ছাদে!
লেখকের মেইল- muntasirmanikbd@gmail.com
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।