দেশজুড়ের জন্মদিন ও স্মৃতিকথা
প্রকাশিত : ১৮:২১, ১ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৯:০৫, ১ জুলাই ২০২০
১৪০৭ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ, ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল। বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। দেশ প্রথম বেসরকারী টেরিসট্ররিয়াল টেলিভিশন একুশে টেলিভিশনের উদ্বোধন করেন সেই সময়ের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একুশে পর্দা উন্মোচনের সাথে সাথে দেশের সংবাদ ও বিনোদন জগতে এক শুভ্র বার্তা নিয়ে আসে। পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে নব শতকের পাল তুলে এগিয়ে যায় একুশে। সম্প্রচারের শুরু থেকেই দর্শকনন্দিত এই টেলিভিশন প্রতিনিয়ত তথ্যসেবা দিতে কাজ করে এক ঝাঁক নিবেদিত কর্মী।
২০০১ সালের ১লা জুলাই। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অগ্রপথিক একুশে টেলিভিশনের অন্যতম একটি অনুষ্ঠান দেশজুড়ের যাত্রা শুরু হয়। গণমানুষের অধিকার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, কৃষি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন করে দেশজুড়ের একঝাঁক নিবেদিত কর্মী। ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট কালো ছায়া নেমে আসে এই প্রতিষ্ঠানের উপর। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের রোষানলে পড়ে এই প্রতিষ্ঠান। একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এই অনুষ্ঠানের শতাধিক পর্ব প্রচার হয়। শহর ছেড়ে জেলা, জেলা ছেড়ে উপজেলা, উপজেলা ছেড়ে ইউনিয়ন এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ মানুষের গল্প-গাঁথা তুলে ধরে দেশজুড়ে। দীর্ঘ ৫ বছর আইনি লড়াই শেষে আবারো অনুমোদন পায় একুশে টেলিভিশন। টেরিষ্ট্ররিয়াল সুবিধা না থাকলেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আবারো সম্প্রচারে আসে একুশে।
একুশে টেলিভিশন পুনরায় চালু হওয়ার পর ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারী যুক্ত হই একুশে টেলিভিশনের পথ চলায়। তৎকালনীল অনুষ্ঠান প্রধান আমিনুল ইসলাম খোকন দেশজুড়ে দলের কর্মী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটানা কাজ করে প্রায় হাজার খানেক পর্ব নির্মাণের সাথে আমরা জড়িত ছিলাম! কর্মচাঞ্চল্য, আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এই দেশজুড়ে সাথে। দেশজুড়ের সাথে জড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি যা অল্পকথায় লেখা সম্ভব নয় ১০ বছর একটানা একটি অনুষ্ঠানের সাথে কাজ করা একটি বিরল অভিজ্ঞতা। যদিও দেশজুড়ের পাশাপাশি নির্মাণ করেছি তৃণমুল একুশে সংলাপ, শিশুতোষ অনুষ্ঠান ওয়ান্স আপন এ টাইম, নাচের অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। কিন্তু দেশজুড়ে ছিল আমাদের প্রধান কাজ প্রাণের কাজ।
কাজ করতে গিয়ে গিয়ে আমরা ছুটে গিয়েছি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। যেখানে কোনদিন ক্যামেরা বা মোটরগাড়ি পৌছায়নি সেইসব এলাকায়ও গিয়েছি। আমাদের প্রতিবেদন কয়েকটি সেগমেন্ট-এ ভাগ করে কাজ করতাম।
মুল প্রতিবেদন- স্থানীয় পর্যায়ে নানা অনিয়ম, দূর্ভোগ ও জনগুরুত্বর্পূণ বিষয়। আমাদের প্রতিবেদনের পর অনেক স্থানে হয়েছে রাস্তাঘাট, হয়েছে স্কুল সংস্কার, কোথাও হয়েছে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। যখন সংবাদ দেশজুড়ে’তে প্রচার হতো সেই বিষয় নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতো এবং কাজ হওয়ার পর এলাকার মানুষ যখন আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখত তখন কিযে আনন্দ লাগতো। একটা সময় সারা দেশে এবং আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে একটি ইস্যু নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছিল টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এই রির্পোট প্রথম তুলে আনে ‘দেশজুড়ে’। এরপর একুশের সংবাদে প্রচার হয় পর্যায়ক্রমে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাট ইস্যুতে পরিনত হয়। এরকম অনেক কাজ করেছিলে দেশজুড়ে দল।
আমার অধিকার- দেশজুড়ে অনুষ্ঠানের আরো একটি গুরুত্বর্পূণ সেগমেন্ট আমার অধিকার। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ যেসব মানুষ শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থানসহ নানাধরনের অধিকার বঞ্চিত মানুষের প্লাটফম ছিল এই সেগমেন্ট। প্রতিবেদন তৈরী করে প্রচার করতাম তারপর সেই বিষয় নিয়ে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠা হতো দেশজুড়ে সংলাপ নামে।
সাফল্যগাঁথা – এই পর্বে থাকতো খেটে খাওয়া মানুষের জীবনসংগ্রাম ও তাদের সাফল্যগাঁথা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। কৃষি ক্ষেত্রে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে তরুণদের নানা ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরী করা হতো।পরিবেশ বান্ধব চুলা, উভয়চর পরিবহন, ব্যাতিক্রমী উদ্যোগও থাকতো এই পর্বে। এই সেগমেন্টের প্রতিবেদন প্রচারের পরপর আমরা সারাদেশ থেকে ব্যপক সাড়া পেতাম।
কৃষি – বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী, অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তিও কৃষি। কৃষির নানা বিষয় তুলে ধরা হতো এই পর্বে। জীবন জীবিকা – জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বিচিত্র পেশার সাথে জড়িত। কেউ আবার বংশপরম্পরায় বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছে। সেইসব পেশাজীবিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য – হাজার বছরের নানা ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো এই পর্বে।
মুক্তিযুদ্ধ – সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ, অবহেলিত বধ্যভূমি, স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা তুলে ধরা হতো এই পর্বে।
এছাড়া আমার গ্রাম, আনন্দ আসর, চলতি পথেসহ আরো নানা ধরনের সেগমেন্ট ছিল। দেশজুড়ের প্রতিবেদন আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্য ডয়চে ভেলে (DWtv) তে প্রচার হতো। প্রতিবছর আমাদেরর ঝুলিতে জমা হতো মিনা এওর্য়াড, কৃষিকাজে অবদান রাখার জন্য সম্মাননা
এখন নানা কারণে দেশজুড়ে হয়না। কিন্তু দেশজুড়ে অনুষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি। অনেক দিয়েছে দেশজুড়ে, অনেক পেয়েছি, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয়েছে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শুভ জন্মদিন দেশজুড়ে।
একটি ভালো টিম ছিল, চিন্তার অনৈক্য থাকলেও ভালো কাজের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। এমন একটা টিম তৈরি করেছিলেন আমাদের গুরু আমিনুল ইসলাম খোকন। আজকের এই দিনে স্যারকে জানাই শ্রদ্ধা।
এই অনুষ্ঠানের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, পৃষ্ঠপোষক, প্রযোজক, গবেষক, উপস্থাপক ও বিভিন্ন সময়ে কলাকুশলী হিসেবে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেককে গভীরভাবে স্মরণ করি। আর দর্শক শুভানুধ্যায়ী সহ সকলকে জানাই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
লেখক: সাবেক প্রযোজক, দেশজুড়ে, একুশে টেলিভিশন।
এসি/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।