ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

একুশে টেলিভিশনের ‘দেশজুড়ে’ অনুষ্ঠান আর একদল স্বপ্নবাজ

শতরূপা দত্ত

প্রকাশিত : ১০:৩৭, ২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৩:১৮, ২ জুলাই ২০২০

২০১০ সালের জানুয়ারির ২ তারিখ আমার কর্মজীবন শুরু হলো একুশে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের ছোট্ট একটা পদে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান সেদিন বলেছিলেন, তোমাকে ‘দেশজুড়ে’তে দিলাম। যাও, ওখানে কাজ শিখতে পারবে।

দেশজুড়ে কী সেটা না বুঝেই চললাম একুশে টেলিভিশনের ৬ তলায়, দেশজুড়ের রুমে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো এমন একদল সিনিয়রদের সাথে, যারা মিডিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতায় আমার থেকে অনেক অনেক দূর এগিয়ে। তাদের কাজের তালিকার কাছে আমি একটা চুনোপুটিই বলতে গেলে। 

কিন্তু কী আশ্চর্য!! এই সিনিয়ররা মোটেই সিনিয়রের মতো ব্যবহার করলেন না! প্রথম পরিচয়ে তাদের প্রথম দিনের ব্যবহারে মনে হয়েছিল তারা আমার অনেক দিনের চেনা। দিনে দিনে তারাই আমার বন্ধু হলেন, বড় ভাই-বোন হলেন, আপনজন হলেন। দেশজুড়ে’র সিনিয়ররা শুধু সিনিয়র হয়ে দূরে থাকেননি, হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। আমার মতো কিছু না জানা জুনিয়রের উপর ভরসা রেখেছেন। আমাকে নিজেকে প্রমাণ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আজ আমি যতটুকুই কাজ শিখেছি, তার ভিত তৈরি করে দিয়েছে দেশজুড়ে।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে গিয়ে সেখানকার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা, সেখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তুলে এনে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অগ্রপথিক, দেশের জনপ্রিয় চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের পর্দায় প্রচার করাই ছিল দেশজুড়ে অনুষ্ঠানের মূল কাজ। ২০০১ সালের ১লা জুলাই একুশে টেলিভিশনের অন্যতম একটি অনুষ্ঠান দেশজুড়ের যাত্রা শুরু হয়। ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে এই অনুষ্ঠানের প্রায় শতাধিক পর্ব প্রচার হয়। ২০০৭ সালে একুশে টেলিভিশন পুনরায় চালু হওয়ার শুরু থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশজুড়ের প্রায় হাজারখানেক পর্ব নির্মিত হয়েছে।

এই অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমি নিজের দেশটাকে আরো ভালভাবে চিনতে শিখেছি। কোনো জেলায় শুটিং করতে যাওয়ার আগে দেশজুড়ে দলের একজন গবেষককে আগেই সেখানে চলে যেতে হতো। তার কাজ ছিল সেই জেলার কোন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করা যায়, তা খুঁজে বের করে তালিকাবদ্ধ করা, এবং সেই তালিকা থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, অধিক আকর্ষণীয় বিষয়গুলোকে আলাদা করে শুটিং সিডিউল তৈরি করা। দেশজুড়ের একজন গবেষক হিসেবে আমি টিম যাওয়ার দুদিন আগে একাই চলে যেতাম অজানা-অচেনা জেলাগুলোতে। একুশে টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধিরা তাদের সাধ্যমতো আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তারপরও এই একা অচেনা জায়গায় চলে যাওয়ার সাহস আমার আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করেছে, পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনতে শিখিয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে কাজ বের করে আনতে শিখিয়েছে।

শুটিং টিমের সাথে যাওয়া ক্যামেরাপারসন আর ড্রাইভারদেরও দেশজুড়ের প্রতি আলাদা ভালোবাসা দেখেছি। যতই চাপ নিয়ে কাজ করতে হোক না কেন, তারা দেশজুড়ে দলকে সব সময় সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন।


শতরূপা দত্ত

প্রযোজনা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমার মতো নবীন কর্মীকে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিখিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি দলের সিনিয়র সদস্যরা। সাখাওয়াৎ লিটন, মানিক শিকদার, আবু হাসনাত মনি- এ তিন জনের নাম বিশেষভাবে বলতেই হবে, কারণ তারা শুটিং স্পটে ক্যামেরা ধরে আমাকে ফ্রেম শিখিয়েছেন, লাইট বুঝিয়েছেন, স্ক্রিপ্ট বুঝিয়েছেন, আবার কখনো আমার কোনো মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে নিজেদের কাজে পরিবর্তন এনেছেন। কখনো বা শুটিংয়ের পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়ে আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন নিজের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর। 

এ বছর দেশজুড়ে অনুষ্ঠানের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনলাইন লাইভ আড্ডার আয়োজন করা হয়। বুধবার (১ জুলাই) রাত ১০টায় শুরু হওয়া আড্ডায় অংশ নেন বিভিন্ন সময় দেশজুড়ে সাথে যুক্ত থাকা মানুষজন। আড্ডায় ছিলেন ২০০১ সালে দেশজুড়ে শুরুর সময়কার কর্মী সারোয়ার মহসিন, খালেদুর রহমান জুয়েল, পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে দেশজুড়ের দায়িত্ব নেয়া মানিক শিকদার, সাখাওয়াৎ লিটন, মাসুমা লিসা ও শতরূপা দত্ত। এছাড়াও ছিলেন দেশজুড়ের বিভিন্ন সময়ের দুই উপস্থাপক তামান্না তিথি ও জুলিয়া ইসলাম।

এই আড্ডায় খালেদুর রহমান জুয়েল নিঃসঙ্কচে বলেছেন, তার আরো অনেক পরিচয় আছে, কিন্তু দেশজুড়ের একজন সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি গর্ববোধ করেন। 

দেশজুড়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন মানিক শিকদার। তিনি লিখেছেন, দেশজুড়ে একটি ভালো টিম ছিল, চিন্তার অনৈক্য থাকলেও ভালো কাজের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। 

সাখাওয়াৎ লিটন নিজের ফেসবুকে দেশজুড়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, কেবলই স্মৃতি নয়, জীবনের অনেক বড় একটি পাওয়ার নাম ইটিভি ও দেশজুড়ে।

এটাই ‘দেশজুড়ে’। একটি অনুষ্ঠানের নামে নাম হলেও দেশজুড়ে আসলে একটা পরিবার। দেশজুড়ে আসলে একগোছা ভালোবাসা। সহকর্মীরা যখন বন্ধু হয়ে যান, কর্মক্ষেত্র তখন খেলাঘরে পরিণত হয়। দেশজুড়ে দলের সদস্যদের জীবনে, আমাদের জীবনে আসলে এটাই ঘটেছিল। আমাদের কাজ কোনোদিন আমাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, কখনো মনে হয়নি ‘উফ আজকে যদি এ কাজটা না করতে হতো, আরাম পেতাম’। বরং কাজের মধ্যেই আমরা আনন্দ খুঁজে পেয়েছি। পরস্পরের সাহচর্যে আমরা শান্তি এবং স্বস্তি খুঁজে পেয়েছি। তাই হয়তো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আমাদের বাসায় ফেরার তাড়া ছিল না, ইটিভির নিচের বিখ্যাত গলিতে আরো ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে গেছে আড্ডায় আড্ডায়।

এখন নানা কারণে একুশে টেলিভিশনে আর দেশজুড়ে প্রচারিত হয় না। আমিও আর একুশে টেলিভিশনে নেই। জীবিকার টানে পরিস্থিতির চাপে দেশজুড়ে দলের সদস্যরা ছিটকে গেছেন পরস্পরের থেকে, ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু দেশজুড়ের প্রতি ভালোবাসা কারো একটুও কমেনি। এ ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র স্বার্থ মেশেনি, মেশেনি কোনো চাওয়া পাওয়ার হিসেব। তাই তো ভালোবাসার টানে, দেশজুড়ের নামে আজো আমরা এক হতে পারি।

লেখক: সাংবাদিক

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি