করোনাকালে প্রবীণ ভাবনা
প্রকাশিত : ০৯:৪৭, ১২ জুলাই ২০২০
মোঃ আবদুল করিম
২০০২ সালের বিশ্ব প্রবীণ সম্মেলনে গৃহীত “মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা” অনুযায়ী নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার । বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ প্রবীণ রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে এ জনসংখ্যা ছিল ৫.৭ শতাংশ যা ২০৫০ সালে শতকরা প্রায় ২০ ভাগে উন্নীত হয়ে ৪ কোটি ৩০ লক্ষে পৌঁছবে। ২০৩১ সালের দিকে বাংলাদেশের জনমিতিক সুবিধা (demographic dividend) শেষ হবার পর প্রবীণ জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকবে। প্রবীণদের দারিদ্রমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত কল্পে “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩” এবং “পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩” প্রণীত হলেও তাঁদের বাস্তব অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস জাতীয় রোগে ইউরোপ ও জাপানে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রায় ৯৫ শতাংশের বয়স ৬০ বৎসরের বেশী, ৫০ শতাংশের বয়স ৮০ বৎসর বা তার বেশী। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু সংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষিত না থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবীণ ব্যাক্তি ইতোমধ্যেই করোনায় পরলোকগমন করেছেন। ইউরোপ–আমেরিকার প্রবীণ নিবাসগুলোতে অবজ্ঞা, অবহেলায় প্রবীণদের মৃত্যুর খবর প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে সরকারী পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবীণ সেবার পরিধি অত্যন্ত সীমিত, বেসরকারী প্রবীণ নিবাসগুলোর অধিকাংশই শোচনীয় অবস্থায়। বৈশ্বিক মহামারি দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।
প্রবীণদের জন্য প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্য সেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির সময় তাঁদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহয়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য । বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি বিরক্তিসূচক “উহ্” শব্দটিও উচ্চারণ না করার ব্যাপারে পবিত্র কোরানের সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং তাঁদের যথাযথ ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান আইনে কারা/ অর্থ দণ্ডের বিধান থাকলেও বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ নিজেদের সন্তান-সন্ততি কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও পাঠানো যাবেনা মর্মে আইনের বিধানটিও লংঘিত হচ্ছে।
ভারতের ১০ কোটি প্রবীণের মধ্যে প্রায় ৯ কোটিকে এখনো তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন না কোন ধরনের কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। সাড়ে পাঁচ কোটি ভারতীয় প্রবীণকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিদ্রায় যেতে হয় । তাঁদের প্রায় অর্ধেকেই কোন না কোন প্রকারের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অথচ “ভারতীয় জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ১৯৯৯” এবং “পিতা-মাতা ও সিনিয়র নাগরিকদের ভরণ-পোষণ এবং কল্যাণ আইন,২০০৭” এর শাস্তির বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না । প্রতি বৎসর প্রায় ২১ লক্ষ মার্কিন প্রবীণ নানা ধরণের উপেক্ষা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন । বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ১.১৬ কোটি লোক এবং মৃত্যু বরণকারী ৫ লক্ষ ৩৮ হাজার ব্যক্তির মধ্যে বিশাল সংখ্যক প্রবীণ এ ধরণের অবজ্ঞা, অবহেলা ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ সহ বিভিন্ন সংগঠন করোনা দুর্যোগকালীন সময়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিস্তারিত নিয়ম/নির্দেশনা জারী করেছে যা অবশ্যই পালনীয়। মহামারি আক্রান্ত প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবীণের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। যথাযথ স্বাস্থ্য নির্দেশনা পালন করেই মসজিদ/মন্দিরে যেতে হবে। ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এজমা ও ক্যান্সার রোগীদেরকে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। করোনা আক্রান্ত অনেক প্রবীণ ব্যক্তিকে চিকিৎসার অভাবে অবেহেলিত ও পরিত্যাক্ত অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। করোনা আক্রান্তদেরকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা মানবতার অবমাননার শামিল। এ ধরণের রোগীদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে উন্নত দেশের হাসপাতালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজন কর্তৃক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রবীণদের খোঁজ-খবর নেয়া হলেও তাঁদের মনোবল চাঙ্গা থাকে। করোনা রোগে মৃত্যু হলে দেশের বিভিন্নস্থানে কবরস্থানে দাফন করতে দেয়া হচ্ছে না, এমনকি জানাজাও পড়া হচ্ছেনা। অথচ স্বাস্থ্য বিধি মেনে এদের ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন/সৎকার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাছাড়া মহামারিতে মৃত ব্যক্তিগণ শহীদের মর্যাদা পাবেন মর্মে পবিত্র হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
করোনা প্রতিরোধে ছুটি/লক ডাউন ঘোষণা, ত্বরিত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়/সিদ্ধান্তহীনতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ এ বছর যুক্তিসঙ্গতভাবে বাড়ানো হয়েছে যা দ্রুত ব্যয় করা প্রয়োজন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় “প্রবীণদের জন্য সমন্বিত পেনশন পদ্ধতি” চালুর বিষয়টি বিবেচিত হয়েছে যার আওতায় রয়েছে ষাট বছর বা তদূর্ধ্বে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বয়স্ক ভাতার প্রচলন, জাতীয় সামাজিক বীমা কর্মসূচি চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই, “বেসরকারী ভলান্টারী পেনশন” ব্যবস্থা চালুর বিষয় রিভিউ করা ইত্যাদি। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কর্মসূচিতে অনেক প্রবীণ ইতোমধ্যেই কিছুটা আর্থিক স্বস্তি পাচ্ছেন।
পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে প্রবীণদের সেবায় পল্লী অঞ্চলে সীমিত আকারে ফিজিওথেরাপী সেবা এবং ছাতা, লাঠি, কম্বল, চেয়ার কমোড বিতরণ সহ আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গঠিত প্রবীণ কমিটির সদস্যরা প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রে খেলাধুলাসহ বিনোদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। “রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও“ নামক পিকেএসএফ-এর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচীতে শ্রেষ্ঠ প্রবীণদের স্বীকৃতি দেয়া সহ তাঁদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় স্কিম, ঋণ সুবিধা, সক্ষম প্রবীণদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচী, অসহায় প্রবীণদের ভরণপোষণ সহ বিভিন্ন ধরণের সেবা দেয়া হচ্ছে। ডঃ কাজী খলীকুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত “বাংলাদেশ জাতীয় প্রবীণ মঞ্চে” প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, রাশেদ খান মেনন এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান সহ প্রথিতযশা প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ যুক্ত হয়েছেন। ব্র্যাক, আশা এর মত বৃহৎ এনজিও গুলো প্রবীণ বান্ধব কর্মসূচীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলে এ কার্যক্রম আরো বেগবান হবে।
সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ নিজ পরিবারেই তাঁদের সম্মান ও ক্ষমতা হারাচ্ছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদের ধারণা। সে ক্ষেত্রে অস্বচ্ছল ও রোগাক্রান্ত প্রবীণেরা মারাত্মক অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন। তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্রমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং অন্যান্য নীতিমালা (স্বাস্থ্যনীতি, গৃহায়ন, নারী উন্নয়ন, প্রতিবন্ধি নীতি) সমূহের বাস্তবায়ন এবং যানবাহন, আবাসন ও অন্যান্য সকল ভৌত অবকাঠামোর প্রবীণবান্ধব করণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারী রোধে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে সরকার ঘোষিত আর্থিক সহায়তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবীণদের চিকিৎসা ও কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে অন্ততঃ ৭০ বৎসর বা তদুর্দ্ধ বয়সী নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন অপ্রদায়ক পেনশন (universal non-contributory pension) তহবিল গঠন করলে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা খাত থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা সম্ভবপর হবে।
বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশে এ ধরণের তহবিল আছে। অস্বচ্ছল প্রবীণদের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ সক্ষম প্রবীণদের উপযুক্ত ঋণ ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা জরুরী। করোনায় আক্রান্ত ও নিহত প্রবীণদের ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকল্পে পত্রিকা/টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন । প্রবীণ কল্যাণের লক্ষ্যে বিশেষ তহবিল গঠন করে তাতে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা ফান্ড (CSR fund) -এর অর্থ জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া যায়। ব্যক্তিগতভাবে এ ফান্ডে কেউ অর্থ প্রদান করলে তা করমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
আন্তঃ প্রজন্ম যোগাযোগ ও সংহতি সংরক্ষণ সহ বার্ধক্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে প্রবীণদের জ্ঞান ও মেধাকে প্রজন্মান্তরে চলমান করার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা-১ (No Poverty), লক্ষ্যমাত্রা-২ (Zero hunger), লক্ষ্যমাত্রা-৩ (Good health and well-being) এবং লক্ষ্যমাত্রা-১০ (Reduced inequality) প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ করোনার প্রভাব যথাযথভাবে মোকাবিলা করে প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব
এমবি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।