ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

একদিন বৃষ্টিতে...

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২১:৩৭, ১৩ জুলাই ২০২০

চিত্র- ফারাহ্ নাজ

চিত্র- ফারাহ্ নাজ

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

ক’দিন ধরে গানটি করোটিতে অনবরত বাজছে। মস্তিকে খেলা করছে গানটির কথাগুলো। অঞ্জন দত্তের ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’। আমার খুব প্রিয় গান। এ ক’দিন যে কতবার বাজিয়েছি। আমার এমনটাই হয়। কোন গান চেতনার মধ্যে ঢুকে গেলে বারবার শোনা ছাড়া মুক্তি নেই। এর জন্যে কত যে বকা খেয়েছি কত জনার কাছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ রকম অবস্হায় এ সব গানের কোন একটা জায়গায় এসে আমার মনটা থমকে দাঁড়ায়, যেন আটকে পড়ে ওই পিন আটকে যাওয়া রেকর্ডের মতো। এই যেমন- মৌসুমী ভৌমিকের ‘এখনো গল্প লেখো’ গানটির এক জায়গায় এসে শিল্পী যখন গেয়ে ওঠেন, ‘আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়?’, তখন কেন যেন মনটা হু হু করে ওঠে। কেন কে জানে?

ঠিক তেমনি অঞ্জনের গানটির এক জায়গায় এসে মনটা কেমন যেন করে ওঠে। ঐ যে যেখানে অঞ্জন দত্ত উদাস সুরে বলে ওঠেন, ‘একদিন....বৃষ্টিতে একদিন...বৃষ্টিতে বিকেলে ...। আমি যেন ঐ বৃষ্টির শব্দ শুনি, মনে হয় আমি খোলা মাথায় ঐ বৃষ্টির মাঝ দিয়ে হাঁটছি। ঝম ঝম বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার সারাটা শরীর, টুপ টুপ জল গড়াচ্ছে আমার কপাল আর কপোল ঘিরে, পায়ের চটির নীচে ছপ ছপ করছে জল। মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়’ ঐ পংক্তিগুলো - ‘একদিন ... বৃষ্টিতে একদিন - বৃষ্টিতে বিকেলে’।

সেদিনও অঝোরধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রায় ৬৫ বছর আগে একটি ঝম ঝম বৃষ্টির বিকেল। স্লেটের মতো ধূসর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে একটা নরম বিষন্নতা। পিচঢালা পথটার ওপরে ল্যাল ব্যালে জল গড়াচ্ছে গা মোচড়ানো ময়াল সাপের মতো। ইলেকট্রিক তারের ওপরে একটা ঝোড়ো কাক বসে ঝিমুচ্ছে। হুস হুস করে দু’টো একটা রিক্সা সর্ সর্ করে জল ছিটিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশ দিয়ে ছাতার নীচে চলেছেন এক তরুণ পিতা আর তাঁর শিশুপুত্র। মনে হয়, স্কুল শেষে পুত্রটিকে নিয়ে পিতা বাড়ী ফিরছেন। সাদা শার্ট আর শর্টস পরা শিশুটির পায়ে সেকালের বাটার নটি-বয় শু, পিঠে স্কুলের ব্যাগ।

দেখেই বোঝা যাচ্ছে তরুণ পিতাটি প্রাণপনে চেষ্টা করছেন পুত্রটিকে ছাতার নীচে রাখতে - যাতে সে ভিজে না যায়। তাই এক হাতে ছাতা ধরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্য হাতে শিশুটির কচি হাতটি ধরে রেখেছেন। কিন্তু দূরন্ত শিশু কি সেই বাঁধ মানে? সুযোগ পেলেই বাবার হাত ছাড়িয়ে জলধারায় ভিজতে ছুটে যায়। চলতে চলতেই দেখা যায় একটি জলভরা গর্ত। শিশুটি মনে করে, এ এক মোক্ষম সুযোগ। তাই বাবা কিছু করার আগেই সে এক দৌড়ে তার নটি-বয় শু’সহ পা ডুবিয়ে দেয় ঐ জলকুন্ডলীতে, ছপ ছপ করে দাপাতে থাকে তার পা, নোংরা জল ছিটকে পড়ে চারদিক। তারপরই ভীত দৃষ্টিতে সে তাকায় বাবার দিকে। বাবার মুখটা গম্ভীর। তারপর কেমন করে সে শক্ত মুখরেখা নরম হয়ে আসে, হাসিতে ভরে যায় সারা মুখ, জেগে ওঠে একটা স্নেহময় প্রশ্রয়ের অবয়ব। শিশুটিও খল খল করে এসে পিতার হাত ধরে।

ষাটের দশকে এক বিকেল বেলায় খেলা শেষে হৈ চৈ করে ক’টি কিশোর ফিরছিল ফুটবল খেলার মাঠ থেকে। সবার পরনে খেলার পোশাক, পায়ে বুট জুতো। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে কিশোর ক’টিকে। কিন্তু তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। যে কিশোরটির হাতে বল সে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলটিকে তালে তালে মাটিতে ঠুকছিল। হঠাৎ করে সেই কিশোরটির দৃষ্টি পড়ে পথের পাশে হলুদ বাড়ীটির একতলার একটি জানালার দিকে।

সেখানে জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে একটি কিশোরী। কেমন উদাস তার সেই চাওয়া। বৃষ্টির ছাঁট তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তার সুডৌল চিবুকের বিন্দু বিন্দু জলকণা চিক চিক করছে। কি এক নিমগ্নতা ছিল সে ছবিটিতে - ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘কি হলো রে?’, বন্ধুরা অবাক চেখে জানতে চায়। ছেলেটি সচেতন হয়ে বলে, ‘কিছুই না’। তারপর সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে, শেষবারের মতো আড়চোখে বাতায়নবর্তিনীর দিকে তাকায়, তারপর বিড় বিড় করে বলে, ‘চেয়ে আছে সে একজন বিষন্ন প্রতিমার মতো’।

এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলো ছেলেটি ও মেয়েটি। সতীর্থ তারা, কিন্তু ভিন্ন বিভাগের- তবে পরিচয় আছে ঐচ্ছিক বিষয়ের অভিন্নতার জন্যে। বৃত্তি তুলতে এসেছে তারা, সেই দপ্তরের ওখানে দেখা দু’জনার। টাকা তোলার পরে এলোমেলো টুকরো হাসি-ঠাট্টা। ‘শাড়ীর আঁচলে বেঁধে নিন টাকাটা, হারিয়ে যেতে পারে’, স্মিত হেসে বলে ছেলেটি। ‘হারিয়ে গেলে আপনার পকেট কাটব’, চটুল গলায় মেয়েটি বলে। হো হো করে হেসে ওঠে ছেলেটি।

প্রশাসন ভবনের বাইরে এসে দেখা যায় কখন যেন আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। ঠান্ডা একটা হাওয়া বইছে। আর তার মাঝেই শুরু হয়েছে ঝির্ ঝিরে্ বৃষ্টি। ‘দেখেছেন কাণ্ড’, বিরক্তির সঙ্গে ছেলেটি বলে মেয়েটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে। মেয়েটি কিছু বলে না, মুখ টিপে হাসে, তারপর শাড়ীর আঁচল টেনে ঘোমটা তুলে পা বাড়ায়। ‘বাহ্’ সপ্রশংস কণ্ঠে ছেলেটি বলে, ‘আপনাকে কি সুন্দর বৌ বৌ লাগছে।’ তারপর ঠাট্টার সুর তার গলায়, ‘লোকে আমাদের দেখলে ভাববে, আপনি আমার বৌ’। হঠাৎ মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ে। স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। তারপর আস্তে আস্তে তার বড় বড় দু’চোখ জলে ভরে যায়। ভাঙ্গা কণ্ঠে সে বলে, ‘ও রকম সৌভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাই নি’। তারপরই বৃষ্টির মধ্যে নেমে দ্রুত চলতে থাকে। পেছনে ছেলেটি স্হাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আস্তে আস্তে মেয়েটি দূর থেকে দূরে চলে যেতে থাকে।

‘চলো, তোমাদের মা আসার আগেই আমরা বৃষ্টিতে ভিজে আসি। বিকেলের ঝম ঝম বৃষ্টিভেজা চারপাশের দিকে চোখ রেখে তরুণ বাবাটি তার শিশু কন্যা দু’টোকে বলে। আহ্, কি সুন্দর বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবার কথায় নেচে ওঠে শিশুদুটো। তারপর যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। তিনজনকেই কিছু পরে দেখা যায় বাড়ীর ছাদে। তারপর শুরু হয়ে যায় বাবা-কন্যাদের স্ফূর্তির লহরী। বাবার চারপাশে ঘুরে ঘুরে শিশুদুটি নাচতে থাকে। জলে ভিজে যাচ্ছে তারা। পালাক্রমে তারা উঠছে বাবার কোলে। একজন উঠলেই আরেকজন জানান দেয়, ‘এরপর কিন্তু আমি’। মাঝে মাঝে তারা আকাশের দিকে হাঁ করে বলে, ‘আমি বৃষ্টি খাচ্ছি’।

কিছুক্ষণ পরেই বাবাটির খেয়াল হয়, এবার নামতে হবে ছাদ থেকে। শিশু দু’টোর মাতার ফেরার সময় হয়ে এসেছে। মেয়ে দু’টোরও ঠাণ্ডা লাগছে। ‘চলো, চলো’ বলে দুড় দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে তিনজন। ঠিক সেই সময়েই দেখা যায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন শিশুদের মা। দু’পক্ষই থমকে দাঁড়ায় মাঝ সিঁড়িতে। মা স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন হাতেনাতে ধরা পড়া অপরাধীত্রয়ের দিকে। 
ষড়যন্ত্রকারী বাবা ভাবেন, ভদ্রমহিলাটি যে আজকে আগেই অফিস থেকে ফিরবেন, তা কে ভেবেছিল। একটা ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা, বাবাটি বেশ বিব্রত, বাচ্চা দুটোর চোখে উৎকণ্ঠা। কি হয় এখন? হঠাৎ মা’র মুখটা একটা নরম মায়াময় হাসিতে ভরে যায়। বাচ্চাদের দিকে চোখ টিপে বলে, ‘চলো, আমরা চারজনে আবার ভিজি’। শিশুদু’টো হাত তালি দিয়ে ওঠে, বাবাটি মায়ের হাতটি ধরে। তারপর চারজনেই ওপরে দিকে উঠতে থাকে।

শেষবারের মতো গানটি বাজাতে দিয়ে বাইরে তাকাই। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ফিকে আঁধার নেমে আসছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও নেমেছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া ভাব চারদিকে। সে আবছায়ায় মনে হল হঠাৎ মনে হল, মিষ্টি করে মাথায় একটু ঘোমটা তোলা কে যেন এক মায়ামায় হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন বয়স-অনপেক্ষ সনাতন এক নারী, যার কপালে ছোট একটি টিপ, নাকে ঝিলিক দিয়ে ওঠা এক নাকফুল, মুখে দুষ্টু দুষ্টু মিষ্টি এক হাসি। কতক্ষণ এভাবে মগ্ন ছিলাম, মনে নেই। সম্বিত ফিরে এলো যখন টের পেলাম, কখন যেন ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ গানটি শেষ হয়ে গেছে, শুরু হয়েছে অন্য এক গান -

‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ,
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম,
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু
তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি