ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

কোন চরিত্রই কাল্পনিক নয়

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৬:৩৬, ১৪ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫২, ১৪ জুলাই ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

‘মাঝের মেয়েটি?’ ফলসা রঙা শাড়ী পরা ভারী মিষ্টি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাই আমি। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, চাপা উত্তেজিত একটু অধৈর্য্য কণ্ঠে বলে সতীর্থবন্ধু অসীম। ঐ মেয়েটির পরম অনুরক্ত সে। ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা - আমরা সবাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বসে আছি লাইব্রেরীর ভবনের চত্বরের চাতালে। আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অন্য বিভাগের তিনজন সহপাঠিনী। ঠিক সামনা সামনি এলে তারা মৃদু হাসে, চকিতে তাকায় অসীমের দিকে, তারপর কিছু দূর গিয়ে হাসির তরঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে। চিনি তিনজনকেই, মাঝের ছিপছিপে লাবন্যময়ীর নাম রাত্রি।

খিল খিল সেই হাসির শব্দে অসীম কিছুটা বিব্রত, কিছুটা হতভম্ব। আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। তারপর মৃদু হেসে বলি, ‘ওখানে কিছু হবে না’। ‘কেন?’, চোখটা সরু করে শুধোয় অসীম। ‘বাহ্, ওর সঙ্গে তো সমীরের ভাব’। ‘বলেছে তোকে?’ চোখমুখ লাল করে, তেরিয়া হয়ে বলে সে আমাকে। উঠে দাঁড়ায় অসীম। ওর আশাহত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয় আমার। ‘সত্যি বলছি তোকে’, নরম গলায় বলি আমি। তারপর হাত ধরে বসাই তাকে আবার। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে অসীম। আমি ওর পিঠে হাত রাখি - টের পাই, প্রাণপনে আবেগ চাপছে সে। ওর আশাভঙ্গের বেদনা বুঝি আমি।

নব্বই দশকের প্রথম দিকের কথা। বসেছিলাম প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমান বন্দরের লাউঞ্জে - হাতে সেদিনের খবরের কাগজ। পাশে এসে দাঁড়ালেন একজন। তাকিয়ে দেখি, স্মিতহাস্য সুবেশ এক ভদ্রলোক। এক মুহূর্ত বাদেই লাফিয়ে উঠলাম। আশেপাশের সব ভব্যতা ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘অসীম’! তারপরই জড়িয়ে ধরলাম ওকে। পঁচিশ বছর পরে দেখা। ‘চিনলি কি করে?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘বদলাসনি তো’, মৃদু হেসে অসীম বলল। ‘তুইও না’। আমার গাঢ় স্বর। আজও হাত ধরে বসালাম ওকে।

তারপর খুলে গেল গল্পের ঝাঁপি। নতুন গল্প, পুরোনো গল্প; অর্থবহ গল্প, অর্থহীন গল্প; বন্ধুদের গল্প, অন্যদের গল্প। ‘মনে আছে তোর রাত্রির কথা? মনে আছে সে ঘটনার দিন - লাইব্রেরীর চাতালে’? স্মরণ করিয়ে দেই অসীমকে। ছাদ ফাটিয়ে হেসে ওঠে সে, ‘কি ছেলেমানুষই না ছিলাম!’ আমিও হাসি। অসীম একটু আনমনা হয়ে পড়ে - হয়তো পুরোনো দিনের কথা ভাবে। ‘দেখা হয়েছে আর’?, শুধোই আমি। ‘না’, উদাস গলায় বলল অসীম। তারপর চলে একরাশ স্মৃতির চলচ্চিত্র, যার প্রত্যেকটির শুরু দু’টো শব্দ দিয়ে - ‘মনে আছে?’

‘আরে, তুই এখানে? কবে এসেছিস দেশে? আছিস কেমন? বাড়ীর কি খবর?’ - তার প্রশ্নের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি। কার আবার? অসীমের। বছর পনের আগে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে, ঢাকায়। সেখানেই দেখা অসীমের সঙ্গে। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই দেখা হয়েছে বেশ ক’জন সতীর্থ বন্ধুর সঙ্গে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা, রাত্রিও এসেছে এ বিয়েতে।

একটু আগেই ওর সঙ্গে কথা বলেছি। মুঠোফোনের নম্বরও বিনিময় করেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে সেদিনের সে তরুণীটি এতই বদলে গেছে যে, আমি প্রথমে চিনতেই পারি নি। অসীম আর আমি গল্প করার কালে পাশ দিয়ে রাত্রি চলে গেল ছেলের হাত ধরে। ‘চিনতে পেরেছিস?’, আমার জিজ্ঞাসা অসীমের কাছে। ‘নাহ্’, একটু বিস্ময় ওর গলায়। ‘রাত্রি’, জানাই ওকে। ‘বিশ্বাস করি না’, তেরিয়া কণ্ঠ ওর, সেই ৩৫ বছর আগের মতো। ‘উনি রাত্রি হতেই পারেন না। উনি তো এক বৃদ্ধা’ আমি চুপ করে যাই।

চিত্র কৃতজ্ঞতা: লেখকের সতীর্থ বন্ধু শেলী মীর্জা।

‘এই পালাচ্ছিস কেন?’ দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলাম লণ্ডনে কমনওয়েলথ ভবনের বারান্দা ধরে। দেরী হয়ে গেছে একটি সাক্ষাৎকারে যেতে। পেছনে চেনাকণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালাম। আরে এ যে অসীম! জড়িয়ে ধরলাম সব সময়ের মতো। শুনলাম কমনওয়েলথ কার্যালয়ে এক সভায় সে এসেছে। তারপর খবর বিনিময় বন্ধুদের বিষয়ে - কে অসুস্হ, কার পুত্র-কন্যা খুব ভালো করছে, কে কে পিতামহ, মাতামহ হয়েছে। এক পর্যায়ে আলোচনা কেমন করে যেন ঘুরে গেল, যে সব বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাদের ওপর।

অসীম চলে গেলে অবাক হয়ে ভাবলাম, গত পাঁচ দশকে আমার এই পঞ্চাশ বছরব্যাপী বন্ধুটির সঙ্গে আমার আলাপের বিষয়, ভঙ্গি, ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে বদলে গেছে। আমাদের বন্ধুত্বের আলাপ কবে যেন বর্তমানের সরাসরি ‘কি হয়েছে জানিস্’ থেকে অতীতের স্মৃতি রোমণ্হনের ‘মনে আছে’ তে চলে গেছে। তারপর কেমন করে যেন আমাদের কথার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েছে তারুন্যের বন্ধুদের ‘না চেনা’ পর্ব, তাদের অসুখ-বিসুখ আর তাদের কারো কারো চলে যাওয়া।

বছর দু’য়েক আগে কোন এক খুব ভোরে বেজে উঠল আমার মুঠোফোন। ওপারে একটি নারীকণ্ঠ। চিনতে পারলাম না। ‘আমি রাত্রি’- ওপার থেকে একটি গলা ভেসে এলো। ‘কেমন আছেন আপনি?’, উচ্ছসিত গলায় বলি আমি।

মুঠোফোনের ও প্রান্তে তার কোন প্রত্যুত্তর নেই। তারপর বহুদূর থেকে ভেসে এলো একটা বাক্য - ‘আপনি কি জানেন, গতরাতে অসীম চলে গেছে’? চারদিক কেমন যেন আঁধার হয়ে এলো আমার কাছে। আমি পাশের কৌচে বসে পড়লাম। কানে শুধু বাজতে থাকল, ‘গতরাতে অসীম চলে গেছে’, ‘অসীম চলে গেছে’, ‘চলে গেছে’।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি