বিবেকের দংশন করোনার চেয়েও ভয়ংকর
প্রকাশিত : ২৩:২৯, ১৪ জুলাই ২০২০

আবেদা সুলতানা
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং সঙ্ঘবদ্ধ প্রজাতি। কথায় আছে- Man Cannot live alone, So he need accompany. মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ, সু-শৃঙ্খল ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণী। বুদ্ধির বলেই মানুষ প্রকৃতিকে জয় করছে এবং সৃষ্টিশীলতার দিকে ছুটছে। মুখের আহার সংগ্রহ থেকে শুরু করে সামাজিক উপায়ে বৈধ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সন্তান উৎপাদন, পরিবার গঠন, সামাজিক সু-সম্পর্কসহ নানাবিধ অগ্রযাত্রায় একমাত্র মানুষই স্রষ্টার সৃষ্টি জগতে উত্তম। Man is the best creature and rational being of god. মানুষ অজেয়কে জয় করতে এবং অজানাকে জানতে উদ্গ্রীব ছিল, আছে এবং থাকবে।
জীব বৈচিত্রের প্রকৃতির রাজ্যে মেধা-শ্রম ও সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষ সমুদ্র বিজয় থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজয়েও সফলতা অর্জন করছে। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির ও ডিজিটাল সম্পন্ন। মানব প্রেমের পাশাপাশি যন্ত্রপ্রেমী, কর্মমুখী ও উপার্জনমুখী হয়ে উঠছে মানুষ। সময় গতিশীল মানুষ পরিবর্তনশীল। উন্নয়নকামীতা মানুষের সহজাত প্রবৃদ্ধির অন্তর্গত। তবে উন্নয়ন ও সভ্যতার নামে মানবপ্রেম, মূল্যবোধ দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার থেকে দূরে সরলে কী মনুষ্যত্ববোধ চর্চা হবে?
মান-হুঁশে মানুষ। কথায় আছে- লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। তাই বলে কী মানুষ উন্নয়নের ও সভ্যতার নামে যন্ত্রপ্রেমী, কর্মমুখী, আত্মকেন্দ্রিক এবং দিন দিন স্বার্থপর হয়ে উঠবে? প্রত্যেকেই তার মূলের দিকে তাকায়, এটাই তো নিয়ম।
আবর্তে উন্নতির কথা ও সুবিধার দিক মনে করে মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন কিংবা স্বাধীনতাকামী এবং শৃঙ্খলিত সর্বত্র। আজকাল মানুষ নিজের উন্নতির কথা ভেবে বর্তমানকে রেখে ভবিষ্যৎকে নিয়ে হতাশায় ভোগে এবং অতীতকে ভুলে যায়, এমনকি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে ওঠে। স্বার্থান্বেষী, আত্মকেন্দ্রিকরা ভুলে যায় অতীত থেকেই বর্তমান এবং বর্তমান থেকেই ভবিষ্যতের জয়গান।
আজকাল রক্তের বন্ধন ও মানবিকতার আদি প্রতিষ্ঠানের বেহাল অবস্থা। অপরদিকে সামাজিক মূল্যবোধ থেকেও মানুষ সরে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক ও সমাজের শৃঙ্খলাবোধ নষ্ট করছে। Man is born free but everywhere he is in chaine. শান্তি, শৃঙ্খলাসহ সুন্দর সমাজ ব্যবস্থায় এগিয়ে যাবে মানবজাতি। ইতিহাস-ঐতিহ্য, অতীত ও পূর্বতনকে নিয়েই সমাজ ব্যবস্থা, এমনকি মানব সভ্যতা। মানব সভ্যতা টিকে আছে সমাজ ব্যবস্থার জন্যই।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল সমাজে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে তার বেশিরভাগই অমানবিক ও সমাজগর্হিত। যেমন- খুন, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, জবরদখল, ছিনতাই, ঘুষ, দুর্নীতি, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ, সু-শিক্ষা ও সু-চিকিৎসার অভাব ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবে পরখ করলেই দেখা মিলবে। মানুষ কি-না করতে পারে।
প্রিয়জনের কাছ থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সেই বিচ্ছেদজনিত কষ্টে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ জাতীয় মৃত্যুর ঐতিহাসিক সাক্ষী রয়েছে জগদ্বিখ্যাত অভিযাত্রী ডক্টর লিভিংস্টোন এর লেখায়। আফ্রিকায় ক্রীতদাসের এভাবেই মারতে দেখেছেন তিনি এবং লিপিবদ্ধ করে গেছেন এই মর্মান্তিক তথ্য। ‘সবচেয়ে অদ্ভুত যে অসুখটি আমি আফ্রিকাতে দেখেছি সেটি হলো- বস্তুত পক্ষে ভগ্নহৃদয়ের অসুখ, এই অসুখে সেই মানুষ আক্রান্ত হয়। যে স্বাধীন ছিলো তাকে ক্রীতদাস করা হয়েছে। সব ক্রীতদাসের শিকল পরানো বহু মানুষ শুধু অবোধ জন্তুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাস প্রভুদের খোয়াড়ে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যায়’ -এমনই ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি।
এই অসুখে আক্রান্ত অনেক ক্রীতদাসদের সংগে লিভিংস্টোন কথা বলেছেন এবং লিখেছেন তাদের একমাত্র ব্যথা হৃদয়ে। তারা এই কথায় বলতে এবং হাত দিয়ে বুকের সঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দিতো।
আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক ডাক্তারদের অবহেলা আর জালিয়াতির কারণে এখন মানুষকে এভাবেই মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। মানুষ এখন ডাক্তারদের ক্রীতদাস হয়ে গেছে। অগ্যতা, বিষন্নতার ক্রীতদাস আমি সত্যের খাতিরে নিজের ডেথ সার্টিফিকেট নিজেই লিখে যাওয়ার চেষ্টা করছি, সব আধুনিক ডাক্তার ও হাসপাতাল কে ফাঁকি দিয়ে। কিছু সংখ্যক ডাক্তার এখানেই আধুনিকতার নিরব সন্ত্রাস।
আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন কাজে লাগানোর জন্য। আর চিকিৎসা পেশায় যারা আসেন, তারা তাদের তীক্ষ্ণ জ্ঞান আর উদার মনোভাব নিয়ে এই পেশায় নিয়োজিত হোন। নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন সাধারণ মানুষের সেবায়। আত্মনিবেদিত বিবেক নিয়ে মানুষের কঠিন থেকে কঠিনতর রোগ ভালো করে তোলেন। এমনও ডাক্তার আছেন যিনি রোগীকে ভালো করতে গিয়ে নিজের জীবনও বিপন্ন করেছেন। করোনার মতো কঠিন রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন রাত-দিন পরিশ্রম করে। অপরদিকে, স্বার্থপর কিছু ডাক্তার আজ তাদের বিবেককে বিকিয়ে দিচ্ছেন। নিজের অজান্তেই করে যাচ্ছেন নির্মম ভুল।
অর্থনৈতিক শোষণ আর রাজনৈতিক শাসন মানুষের মনোজগতে যে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই আবহমান ব্যথার চালচিত্র ফুঁটে উঠেছে মানুষের হৃদয়ে। সময় যতই এগিয়ে চলেছে ততই মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে জটিল বিভক্ত আর কুটিল আর্বত। আমরা এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি যখন ভোগবাদ মানুষকে করে তুলেছে প্রচন্ড স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রীক। মানুষের আবহমান অনুভূতিকে ভোতা করে দিতে দিতে মানুষের চৈতণ্যে নেমে এসেছে বিধ্বংসী পক্ষাঘাতগ্রস্ততা। অতীতের সব মূল্যবোধ ভাবার্দশ এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন আর মানুষের জন্য কাঁদে না, জীবন এখন আর জীবনের জন্য নয় যেন। মানুষের দুঃখে মানুষ আর ব্যথিত হয় না। আধুনিক চিন্তাবৃত্তে মানুষের হৃদয়, অনুভূতি, আবেগসহ সমস্ত সুকুমার বৃত্তি অস্বীকৃত হয়ে পড়ছে।
আমার জ্ঞান, প্রজ্ঞায় তাদেরও অংশ আছে- এসব অর্জনে যাদের সামর্থ্য সীমিত। আমাদের সম্পদ, বিলাসিতা, সৌন্দর্য– দিনশেষে এগুলো মূল্যহীন! সবকিছুই আমাদের মহাপ্রয়াণে ধুলোয় মিশে যায়। বেঁচে থাকে কেবল আমাদের কর্ম। যা আমাদের করার কথা ছিলো, আমাদের সবারই নিজস্ব নিয়তি আছে। কেউ লড়ে যায়, কেউবা ভুলে যায়।
লেখিকা- শিক্ষিকা, কবি ও সাংবাদিক।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।