ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ফ্লয়েডের জন্য কান্না ফাহিমের জন্য আফসোস! 

মানিক মুনতাসির

প্রকাশিত : ১৪:৪৮, ১৬ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৪:৫২, ১৬ জুলাই ২০২০

কথায় বলে- ‘নদীর জল ঘোলা ভালো জাতের মেয়ে কালোই ভালো’। আর কবি বলেছেন- ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা’। নিশ্চয়ই জর্জ ফ্লয়েড আর ফাহিম সালেহর রক্তের রংও ছিল একই রকম। দু’জনকে একই দেশে হত্যা করা হয়েছে। একজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে আর ফাহিমকে তার নিজ ঘরে। যেটা কিনা আরো অনেক বেশি নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা ছিল। আমেরিকার মতো দেশে এমন রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে! যারা কিনা বিশ্বকে জ্ঞান দেয় সময়ে অসময়ে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের চিত্র অবশ্য দু’রকম। কেননা একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। আরেকজন জন্মগতই আমেরিকান।

মার্কিন কৃষাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে মে মাসের শেষদিকে প্রকাশ্য দিবালোকে খোদ মিউনিসিপ্যাল পুলিশ হাটু গেড়ে গলা চেপে হত্যা করে। এ ঘটনার পর নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, মিনেসোটাসহ আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেখানে হত্যাকারী পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তির দাবিতে পুরো আমেরিকাজুড়ে রীতিমত তাণ্ডব চালায় কৃষাঙ্গরা। পরে বাধ্য হয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে।

আর পাঠাও-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার কোন প্রতিবাদ এখনো চোখে পড়েনি। সেটা না আমেরিকাতে, না বাংলাদেশে। বরং মহামারী করোনার ভয়ে পালিয়ে আছে সবাই। আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটিও নির্বিকার। বরং তারা ভীত সন্ত্রস্ত।

অবশ্য আমরা ব্যস্ত রয়েছি- সাহেদ আর সাবরিনা নামক মুখোশধারী কীটদের নিয়ে। যারা কিনা মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে নির্মম খেলা। ফাহিম হত্যায় বাংলাদেশী গণমাধ্যমগুলোর নিউজ কভারেজও বেদনাদায়ক। নিউজের ট্রিটমেন্ট খেয়ে ফেলেছে সাহেদ, সাবরিনারা। যারা কিনা মাত্র ত্রিশোর্ধ বয়সেই মাল্টিমিলিয়নিয়ার হয়ে গেছেন নিজ নিজ উদ্ভাবনীতে। ব্যাংকের টাকা মেরে, করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে, গরীবের হক মেরে যারা ধনী হয়েছেন, তারাই আজ মহাগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

অন্যদিকে, মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিজ দেশের পাশাপাশি নাইজেরিয়া, কলম্বিয়া আর আমেরিকার মতো দেশে শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হবার দাপট দেখাচ্ছিলেন সালেহ। হয়তো হয়েও যেতেন খুব কম সময়ের ব্যবধানে। ম্যানহাটানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ২২ লাখ ডলার দিয়ে কেনা অ্যাপার্টমেন্টে জীবন আর স্বপ্ন সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতক তা হতে দেয়নি। তাকে শেষ করে দিয়েছে। কিন্ত এ হত্যাকারী শুধু একজন ফাহিমকেই খুন করেনি। বরং খুন করেছে ভবিষ্যতের হাজারো নতুন উদ্যোক্তাকে। পুরো বাংলাদেশের অদ্ভুত সম্ভাবনাকে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। যার মাধ্যমে শুধু ফাহিম সালেহকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে অযুত সম্ভাবনার এক অদূর ভবিষ্যতের কাণ্ডারীকে। 

গত অক্টোবরে আমেরিকায় গিয়ে ম্যানহাটানের রাস্তায় দেখেছি কতো বাঙালি ছোট ছোট ব্যবসায়ীকে। চিড় ধরানো হলো তাদেরও আত্মবিশ্বাসে। হয়তো আর কেউ সাহস করবে না ফাহিম সালেহ হওয়ার। নিউ ইয়র্ক পুলিশ বলছে- ঘাতক তার সাথেই লিফটে প্রবেশ করেছে। হয়তো তার ঘরেও। আহা! কতটা নির্মমতা! হোক না সে পেশাদার কিংবা অপেশাদার খুনী। হয়তো ধরাও পড়বে সেই খুনী। 

জর্জ ফ্লয়েডের খুনীকে বরখাস্ত করেছে সে দেশের সরকার। মার্কিন প্রশাসন ফাহিমের খুনীকেও হয়তো ধরে ফেলবে। হয়তো তার শাস্তিও হবো। কিন্তু একজন ফাহিম সালেহ আর ফ্লয়েডরা কি ফিরে আসবে? কেউ কি আর কখনো একজন সালেহ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তারা ঘাতকের ভয়ে নিশ্চয়ই ভীতই থাকবে না। বরং আরো অসংখ্য ফাহিমদের জন্ম দেবে প্রিয় বাংলাদেশ।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পুরো নিউইয়র্কে আইন শৃংখলার চরম অবনতি হয়েছে। শুধুমাত্র জুলাই মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত নিউইয়র্কের ৪৫টি স্থানে বেশ কয়েক দফা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সহিংসতায় ১১ জন নিহত হয়েছে। সর্বশেষ দুর্বৃত্তের অস্ত্রের আঘাতে ফাহিম সালেহ খুন হন।

এ ঘটনার পর থেকেই ম্যানহাটন এলাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আগে ৭ জুলাই ব্রঙ্কসের ইস্ট ১৭০ স্ট্রিটে অ্যান্থনি রবিনসন নামক এক ব্যক্তি তার ৬ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় একটি কালো গাড়ি থেকে অ্যান্থনিকে গুলি করে গাড়িটি দ্রুত পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই অ্যান্থনির মৃত্যু হয়। তবে অ্যান্থনির মেয়ের কোনো ক্ষতি হয়নি।

সারাবিশ্ব যখন করোনা ভাইরাস দিশেহারা ঠিক তখনই আততায়ী, ঘাতক, খুনী আর সাহেদ ও সাবরিনারা কেন বসে থাকবে? প্রত্যেকেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছে। এখানে ভাইরাস লড়ছে মানুষের বিরুদ্ধে। মানুষ লড়ছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। আর ঘাতক, আততায়ী, খুনী ও প্রতারক-ধান্দাবাজরাও লড়ছে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে। এ যুদ্ধে যারা জয়ী হবে তারাই হয়তো আগামীর বিশ্বকে শাসন করবে।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি