ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রিন্স মাহমুদ নামের সমুদ্রে এক পর্যটক মাত্র

লুৎফর হাসান

প্রকাশিত : ১৫:৩৬, ১৭ জুলাই ২০২০

প্রিন্স মাহমুদ

প্রিন্স মাহমুদ

তখন আমাদের তারুণ্যের ডালপালায় নতুন পাতার দিন। পাতায় পাতায় হাওয়ার কোরাস। বাউন্ডুলে পাখির ঝাঁকের সাথে আমরা তখন আকাশের নীলাভ সীমান্ত খুঁজতে মরিয়া। যেকোনো নতুন কিছুর প্রতি দুর্বার আকর্ষণ। আমরা তখন গ্রামের ছেলে। সে এক নিঝুম গ্রাম। ঝিনাই নদীর দেশ। 

হেলেঞ্চাবতীর দেশ। নবগ্রাম। এই রাজধানী থেকে অনেক দূরে। একদম যমুনার ঢেউ ঘেঁষে আমাদের দিনযাপন। আমাদের সেই গ্রামে একদিন পৌঁছে গেল একটা ক্যাসেট। নিয়ে গেলেন আমার মামুন মামা। মামুন মামা আমাদের আধুনিক হতে শিখিয়েছিলেন বাংলা গানের সর্বশেষ জোয়ারে ভাসাতে। সেদিনের সেই অ্যালবামের নাম ছিল ‘শক্তি’। প্রিন্স মাহমুদের গান। গেয়েছেন বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষেরা।

‘শক্তি’ অ্যালবামের শুরুতেই পার্থ বড়ুয়ার কণ্ঠে ‘কেন সেই হৃদয়হীনা ভেঙ্গেছে হৃদয় আমার’, আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান ‘যদি তুমি ভালোবাসো আমায়, শুধু একারণে পালাতে চাই’ গুরু আজম খানের কণ্ঠে ‘মনকে বোঝাই তুমি কেঁদো না, দুঃখ নদী বয়ে গেলে’, নকীব খানের মিষ্টি কণ্ঠে ‘মেঘটাকে দেখেছ, নীল আকাশ কখনো দেখোনি’ আমাদের ঠোঁটের বারান্দায় গেঁথে গেল চিরকালীন আবেদন নিয়ে।

ঢাকায় গিয়ে মামুন মামা নিয়ে এলেন আরেক অ্যালবাম। ওরা এগারোজন। সেই অ্যালবামের একটা গান এখনো একটা রিদমের মধ্যে ফেলে দেয়। অবসকিউর ব্যান্ডের টিপুর গাওয়া ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু হব, চলার পথে সাথী হব’। আরো একটা গান ছিল এই অ্যালবামে ‘ভয় ভয় হারাবার ভয়, তোমাকে আমার শুধু হারাবার ভয়’। বিপ্লব গেয়েছিলেন গানটি। এই গানের কাছে আমরা ঋণী হয়ে আছি। সেই জীবনে এই গান কত গেয়েছি, হিসেব নেই। প্রিন্স মাহমুদ আমাদের জীবন ও হৃদয়ের সবখানে স্থায়ী আসন করে নিলেন।

এরপর আমাদের জীবনে শুরু হয় প্রিন্স মাহমুদের রাজত্ব। সেই অ্যালবামের নাম ‘ক্ষমা’। ততদিনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে। সে এক অনন্য জীবনের গল্প। তুমুল প্রেমে পড়েছিলাম, চোখের সামনে শুনেছিলাম বিয়ের বাদ্যি, চেনা পথের রেখায় হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রিয় প্রেমিকার মুখ। সেই সময়ে খালিদের এই গান ‘আবার দেখা হবে, এখনই শেষ দেখা নয়’। এই গানের আঁচে কলিজা পোড়াতে পোড়াতে একই অ্যালবামের গান, গেয়েছিলেন অবসকিউর ব্যান্ডের টিপু ‘চাঁদ জাগা এই রাতে, দুচোখের বর্ষায় ভিজে, ভাবছি তোমায় জেগে জেগে রাত, তুমিও কি ভাবছো আমায়’। এই গানটা একাকিত্বের এক হাজার রাত আমাদের মতো পোড় খাওয়ায় প্রেমিকের বালিশ ভিজিয়ে দিয়েছিল গোপন কান্নায়।

হাতে চলে এলো প্রিন্স মাহমুদের আরেক অ্যালবাম ‘ঘৃণা’। সেই অ্যালবামের এক গান ছিল আশিকুজ্জামান টুলুর কণ্ঠে ‘অভিমানিনি ভুলে আছো, কীভাবে এতদিন ভুলে আছো’। এই গানটা হারানো প্রেমিকার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে অসংখ্যবার গেয়েছি বাইসাইকেলের রিংটোন মিশিয়ে।

হুট করে প্রিন্স মাহমুদ কিছুটা ভাঙচুর করলেন আমাদের। হাতে এলো ‘ব্যবধান’ নামের অ্যালবাম। কুমার বিশ্বজিৎ-এর কণ্ঠে ‘বড় বেশি ক্ষতি হয়ে গেলো, ভালোবেসে তোমায়’, খালিদ হাসান মিলুর কণ্ঠে ‘তুমি বুঝলে না, তুমি খুঁজলে না, এ আমি কতটা অসহায়’ আমাদের চেনালো বিরহের সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া নতুন গানের কথকতা।

অপেক্ষা করতে করতে এক ফাঁকে একটা একক অ্যালবামের খোঁজ পাই আমরা। সেটার শিল্পী কামাল আহমেদ। প্রিন্স মাহমুদের সব গান। শুনতে হয় তো। শুনলাম। আবার একটা গান আমাদের আঁকড়ে ধরল ‘প্রতিটি মানুষই একবার সত্যিকার ভালোবাসে, স্বপ্ন সুখের বসবাস, তার চোখে যে ভাসে’। আমি কেন জানি এখনো ওই গানটা গুনগুন করি।

তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকি। লোডশেডিং হতেই ঝাঁক বেঁধে দৌড়ে চলে যাই মেয়েদের হলের সেই ভালোবাসার অরণ্য পশ্চিম পাড়ায়। বেগম রোকেয়া হল, তাপসী রাবেয়া হলের উত্তর পাশের পুকুর পাড়। সেখানে যেন জোছনার বিছানা। সেই রুপালী আলোয় গলা ছেড়ে গাইতে থাকলাম একেকটা গান। প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবাম ‘শেষ দেখা’। আমাদের যৌবনের প্রথম স্বর্ণখচিত সেই অ্যালবাম। বুকের ব্যথা কণ্ঠের হাহাকারে গাইতাম আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গান ‘আমার সমাধির পর আমি চাই না তোমার উপহার, নিষ্প্রাণ দেহের কাছে তুমি রেখো না তোমার অধিকার’। ধোঁয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে সে এক জীবনের দিন। জেমসের ঝাঁঝালো কণ্ঠে ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা, হতেও পারে এই গানই শেষ গান’।

গানের মাঝখান দিয়ে বুকে করাত চালানো ভায়োলিন। সব মনে আছে এখনো। সবকিছু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসানের গানের বিকল্প কণ্ঠ হিসেবে তুমুল খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলাম ‘সানাইয়ের সুর নিয়ে যাবে দূর, একটু একটু করে তোমায়, আজকে রাতেই তুমি অন্যের হবে, ভাবতেই জলে চোখ ভিজে যায়, এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’ কণ্ঠে নিয়ে। নিশ্চয়ই সেই নব্বই দশকের শেষদিকে যারা রাজশাহী ক্যাম্পাসে ছিল, তাদের মনে আছে আজও।

মায়ের কথা বাংলা গানে এমনভাবে গেঁথে দেয়া যায়, এত সুনিপুণ কথা আর সুরে পাঠিয়ে দেয়া যায় তারার দেশে, সেকথার প্রমাণ পেলাম আমরা জেমসের কণ্ঠে ‘রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস, কোথায় আছে, কেমন আছে মা’। মাকে ছেড়ে আমরা যারা দূরের এক ক্যাম্পাসে দিন কাটাই, রাত কাটাই, আমাদের জন্য মহৌষধ হয়ে আসে প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবাম ‘এখনও দুচোখে বন্যা’। একই অ্যালবামে আমাদের জন্য আরেক গান, সেটা হাসানের গাওয়া ‘এতদিন পরে প্রশ্ন জাগে শুধুই কি হেরেছি আমি’। খালিদের কণ্ঠে এমন গান ভেসে এলো, যে গান আমাদের বিরহের পথে ছড়ালো বিষাদ শিউলি, আমাদের বেদনার আকাশে ভাসালো অগণন দুঃখতারা।

বুকের উত্তাপে ভালোবাসার ঘ্রাণ ছড়াতে আমাদের প্লে লিস্টে যখন প্রিন্স মাহমুদের আধিপত্য, তখন তিনি বাতাসে ভাসালেন ‘দাগ থেকে যায়’ শিরোনামের এক অ্যালবাম। সেই অ্যালবামের শুরুই হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গান ‘বেলা শেষে ফিরে এসে পাইনি তোমায়’। এই গানটা বাংলা গানের মানচিত্রে একটা আলাদা জায়গা করে নিলো সেদিন থেকেই। শাফিন আহমেদের কণ্ঠে প্রিন্স মাহমুদ তুলে দিলেন আপামর বাঙালির জন্মদিনের উৎসবের চিরকালের একমাত্র থিমসং। আজ জন্মদিন তোমার। এই গানের পর আর কোনো গান এই উৎসবে আসেনি, আসবেও না।

‘যদি স্বীকার করতে বন্ধু তুমি হতে জয়ী, আমি পরাজয় মেনে নিয়ে ভাবতাম তুমিই জয়ী’। জেমসের কণ্ঠে এই গান আমাদের পথভ্রষ্ট করে দিয়েছিল প্রায়। আমরা উদ্ভ্রান্ত রাতের পথ ধরে কতদূর গিয়েছিলাম সে কথা জানে গগন শিরিষের ছায়ায় ঢাকা প্রিয় প্যারিস রোড। এই অ্যালবাম থেকে একটা গান নিয়ে নিলাম বুকপকেটে। যেখানে বেদনা রাখি, দুঃখ রাখি। খালিদের কণ্ঠে ‘হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সবকিছু শেষ করে কেন চলে গ্যাছো’। প্রিন্স মাহমুদের এই অ্যালবামের গানগুলো সত্যিই দাগ রেখে গেল জীবনে। সে দাগ প্রেমের অথবা বিরহের।

আমরা একদিন ক্যাসেটের দোকানে লম্বা সিরিয়াল দিয়ে এক অ্যালবাম কিনেছিলাম। সেটা প্রিন্স মাহমুদের ‘স্রোত’। আইয়ুব বাচ্চুর ‘অভিমান নিয়ে’, জেমসের ‘পাপী’ আর পিয়াসের কণ্ঠে ‘মন শত পাহারায়, মন যত বেঁধে রাখো, মন তবু হারিয়ে যাবে’। আমাদের ঝাঁকি মেরে গেল আরো একবার।

ধারাবাহিকতায় আচ্ছন্ন আমরা তখনো। প্রিন্স মাহমুদের নতুন নতুন গানের দারুণ অপেক্ষার চাষবাস। হাতে এলো ‘দেয়াল’। দেয়ালের সেই জেমসের গান ‘ফুল নেবে না, অশ্রু নেবে বন্ধু’ আর আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘জীবনানন্দের কবিতায়’, আমাদের শেখালো ভালোবাসার নতুন মানে।

একদিন আমরা বুঝিনি সেদিনের মানে, যেদিন আমাদের হাতে আসে প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবাম ‘হারজিৎ’। যেখানে জেমসের কণ্ঠে তিনি তুলে দিলেন বাবা হারানো অসংখ্য সন্তানের হাহাকার নিয়ে এক গান, বাবাকে দূরে রেখে জীবন যুদ্ধে নেমে যাওয়া সন্তানদের আশ্রয়ের এক গান ‘বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়’। বাংলা গানে বাবা নিয়ে এ রকম আর একটি গানও নেই।

প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবামগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল অ্যালবাম না শুধু, বাংলা গানের ইতিহাসেই ‘পিয়ানো’ এক জ্বলজ্বলে ইতিহাস। বাংলা ব্যান্ডের দুই দিকপাল আইয়ুব বাচ্চু ও জেমসের গাওয়া প্রতিটা গান গানপ্রেমিক প্রতিটা বাঙালির হৃদয়ে প্রতিদিন নতুন। জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গান এদেশের তারুণ্যকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এক অনন্য গান হয়ে যুক্ত আছে। আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘তাজমহল’, ‘ও দুনিয়ার মানুষ’, আমাদের প্রাণে সৌরভ ছড়াবে সমগ্র জীবন, এতে সন্দেহ নেই।

আমাদের সময়ের সৈকতে নৌকো ভেড়ে জীবন জীবিকার। আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই নিজেকে নিয়ে। অনেকটা না হলেও কিছুটা দূরে সরে থাকি গানের মিছিল থেকে। বয়স বাড়তে থাকে। অনেকদিন পর সে একদিন। প্রিন্স ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। প্রথম দিনেই তিনি আমাকে বুকে টেনে নেন। সেই থেকে এখনো আমি আছি প্রিন্স ভাইয়ের ভালোবাসার মেঘময় আশ্রয়ে। দেখা হতেই বলি, ‘প্রিন্স ভাই, এতদিনে খালিদ ভাইকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘যদি হিমালয়’, মাহাদীকে দিয়ে গাওয়ালেন আসিফ ইকবালের লেখা ‘সুনীল বরুণা’ আর রুমীকে ‘মাটি’ ও ‘বোকা’।

আরো কতজনকে কত গান, আমি কবে গাইব?’ প্রিন্স ভাই এক গাল হেসে উত্তর দেন ‘তোমার ঘুড়ি তো অসাধারণ গান, অলি ভালো লিখেছে, তুমিও গেয়েছো দারুণ’, তোমার জন্য গান করব না, তা তো বলি নাই, আমার যখন মনে হবে, ঠিক তখন তোমাকে ডাক দেব’। আমি প্রিন্স ভাইয়ের সেই ডাকের অপেক্ষায় দিন কাটাই, রাত কাটাই, আর অজান্তে গেয়ে ফেলি তার সুরের একেকটা বুক ভাঙচুর গান।

আজ প্রিন্স ভাইয়ের জন্মদিন। শুভেচ্ছা প্রিয় দিকপাল। বাংলা গানের বাঁক বদলের গল্প আপনিই লিখেছেন। আপনার কাছে আমি, আমরা, সে, তারা, এবং সকলেই ঋণী। দীর্ঘ আয়ু পান। প্রার্থনা।

লেখক: গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি