ক’ফোঁটা চোখের জল
প্রকাশিত : ১৪:৪২, ২৬ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৪:৪৩, ২৬ জুলাই ২০২০
১৯৯২ সাল। হেমন্তের শেষ। কুয়াশাভেজা শীতের সকাল। প্রতিবেশীর বাড়িতে কান্না ও আহাজারির শব্দে ঘুম ভাঙে। গিয়ে দেখি, নাজিমদ্দিনের ঘরে সিঁধ কাটা। ভূমিহীন নাজিমদ্দিন অন্যের জমি চাষ করে যে কয় বস্তা ধান ঘরে তুলেছিলেন তা সবই নিয়ে গেছে চোর। সঙ্গে ঘরের থালাবাটিসহ সব। পরনের কাপড় ছাড়া একটি গামছাও রেখে যায়নি তারা।
চোর যে দিক দিয়ে ধানের বস্তা নিয়ে গেছে সে পথে ধান পড়ে আছে। ছেঁড়া বস্তা থেকে ধান পড়তে থাকায় চোর কোন দিকে গেছে তা স্পষ্ট। অনেকেই মরিচ ও মুলাক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পড়ে থাকা ধানের রেখা ও চোরের পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে করে এগিয়ে গেছে। কিন্তু যে বাড়িতে গিয়ে এই রেখা শেষ হয়েছে সে বাড়িতে চোর থাকলেও তাদেরকে চোর বলা গ্রামের কারও এমন সাহস নেই, প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হাতে নাতে না ধরা পর্যন্ত। আর নাজিমদ্দিন তো নিতান্ত গরীব ও নিরীহ মানুষ।
নাজিমদ্দিনের বউ ফাতেমা বিলাপ করে কাঁদছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর নিঃস্ব পরিবারটির কর্তা নাজিমদ্দিনের পলকহীন চাহনি জানান দিচ্ছে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে সামনের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা।
প্রথমটায় রাজি হয়নি তারা। অনেক করে বলায় ও সাহস দেওয়ায় এবং নিজে সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে দিলে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে লিখিতভাবে জানানো হয় বিষয়টি। নির্ধারিত দিনে বসে সালিশ-বৈঠক। দু’দফা সালিশে প্রমাণিত হয় ওই বাড়ির মন্তু (ছদ্মনাম) ও তার সঙ্গীরাই চুরি করেছে নাজিমের ঘরে। সালিশ রায় দেয় মাল ফেরত দিতে। খোয়া যাওয়া মালের বিবরণ লিখে নগদ অর্থমূল্যও নির্ধারণ করা হয়। চোর তার ইচ্ছেমত টাকা অথবা অক্ষত অবস্থায় মালামাল ফেরত দিবে।
নির্ধারিত সময় পার হয়ে যায়। মালামাল ফেরত দেয় না। কিছুদিন বাদে নাজিমদ্দিন তাগাদা দিতে গেলে উল্টো তাকে শাসায়। ভয়ে ফিরে আসে নাজিমদ্দিন। একদিন আমাকে বলে, তোমার কথায় সালিশ করতে গিয়ে এখন তো চুরি যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ার বদলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি!
শুনে খুবই খারাপ লাগল। থানা-পুলিশ করে লাভ হবে না। খরচাই বা কে যোগাবে? একটি দৈনিক পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করলেও তখন আমি কলেজে পড়ি। কী করা যায় ভাবছিলাম। ক্যামেরা নিয়ে গেলাম নাজিমদ্দিনের বাড়িতে। পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে করে একটি ছবি উঠালাম। অসহায় পরিবারের কষ্টগাঁথা নিয়ে প্রতিবেদন লিখে পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে। একই সঙ্গে অন্য পত্রিকার রিপোর্টাদেরও নিউজটা পাঠাতে অনুরোধ করলাম।
আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম তাতে অসহায় মানুষদের জীবন নিয়ে একটি কলাম ছাপা হতো নিয়মিত। বেশিরভাগ সময় শেষ পৃষ্ঠায় কলামটি ছাপা হতো। বিশেষ ক্ষেত্রে প্রথম পৃষ্ঠায়ও ছাপা হতো। বার্তা সম্পাদক আমার প্রতিবেদনটিকে বেশ গুরুত্ব দিলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় চার কলামের শিরোনামে ছাপা হলো নাজিমদ্দিনের কষ্টকথা। আরও দু’তিনটি পত্রিকায় ছাপা হলো খবরটি।
পরদিন উঠোনে বসে আছি। নাজিমদ্দিনের বাচ্চা ছেলে এসে বললো, ‘পুলিশ আইছে, আফনেরে আব্বা যাইতে কইছে!’
কী ব্যাপার বুঝতে না পারলেও হাঁটতে হাঁটতে গেলাম নাজিমদ্দিনের বাড়িতে। দেখি পুলিশ ধরে এনেছে মন্তু চোরকে। চোরের বাড়ির লোকজন মালামালের টাকা নিয়ে হাজির। নাজিমদ্দিনের সঙ্গে আপোসরফা করতে চায়। আমি না বলা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে রাজি নয় নাজিমদ্দিন। পুলিশ চাচ্ছিল মামলা নিয়ে মন্তুকে চালান করে দিতে।
সবাইকে নিয়ে বসলাম। আলোচনা করে ‘চুরি করা ছেড়ে দিবে এবং নাজিমদ্দিনকে আর হয়রানি বা শাসাবে না’ মর্মে পুলিশের কাছে মুচলেকা আদায় করে ছেড়ে দেয়া হলো মন্তুকে। মালামালের হিসাবের চেয়ে স্বেচ্ছায় আরও কিছু বেশি আদায় করে দেয়া হলো নাজিমদ্দিনকে। বিদায় হলো পুলিশ ও মন্তুর পরিবারের লোকজন। আমিও বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
চুরি যাওয়া মালামালের অর্থ বুঝে পেয়ে কতটা খুশি হয়েছিল নাজিমদ্দিন দম্পতি জানি না; কিন্তু কৃতজ্ঞতার আঁসুতে ভেজাচোখে আমার দিকে তাকিয়ে কী অনুভূতি যে তারা প্রকাশ করেছিল সে দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে।
তৃপ্তির জায়গাটা এখানেই। দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার আনন্দ অন্যরকম। অন্য যে কোনো পেশার তুলনায় পরিশ্রম ও মেধা একটু বেশিই খাটাতে হয় এখানে। অথচ সাংবাদিকের চেয়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা বোধকরি আর কোনো পেশায় নেই। আর মফস্বল সাংবাদিকের ক্ষেত্রে এ সত্যটা আরও বেশি কঠিন বাস্তব। দিনরাত পরিশ্রম, ক্ষমতাধরদের রক্তচক্ষু, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি, কপটতা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতার নাগপাশ মাড়িয়ে কাজ করার পর প্রাপ্তির ঝোলাটা ফাঁকাই থাকে। কোনো কোনো সময় তো অন্যায়ভাবে মামলা, হয়রানি ও হিংস্রতার শিকারও হতে হয়।
এই কঠিনেরে ভালোবেসে যারা মফস্বলে সাংবাদিকতা করেন তাদের কাজের কোনো অর্থমূল্য হতে পারে না। আমার মতো যারা নাজিমদ্দিন দম্পতির ক’ফোঁটা চোখের পানির গুরুত্ব হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন তাদের কাছে এই পেশা কত মহৎ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের স্যালুট, যারা নিজের চাওয়া পাওয়াকে উপেক্ষা করে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যান।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।