ভাদ্র মাসের কল্লোল
প্রকাশিত : ১৭:০৯, ৩০ আগস্ট ২০২০
ভাদ্র মাসে আমার মা-বাবার বিয়ে হয়েছে। আমার মা-বাবা প্রথম সন্তানের জনক-জননী হয়েছেন। আমার বিয়েও হয়েছে সেই ভাদ্র মাসেই। আমার এক কন্যা জন্মেছে ভাদ্র মাসে। আমার জামাই-এর জন্মও ভাদ্র মাসে। ভাদ্রমাস মানেই আমাদের জন্য আনন্দ। ২০০০-এর আগে পর্যন্ত আমরা ভাদ্র মাসে খুশিতে মাতোয়ারা থেকেছি। কিন্তু ২০০০ এর ভাদ্রের ১৫ তারিখ আগস্টের ৩০ তারিখ আমাদের সব আনন্দকে মাটিচাপা দিয়ে ভাদ্রমাস আমাদের জন্য দুঃখের মাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩০ আগস্ট, ২০০০। সেদিন ছিলো আমাদের বাবা-মা এর ৩৭তম বিবাহ বার্ষিকী। আব্বা সে বছরই মার্চে চাকুরী থেকে অবসরে গেছেন (LPR)। খুব সকালে বাজারে গেছেন, কারণ রাতে আমাদের সবার আব্বার বাসায় দাওয়াত। সেদিন ছিলো হরতাল। শুনশান শূন্যতা রাস্তাঘাটে। বাসায় বড় ভাইটা ঘুমিয়ে আছে। মেঝোভাই নতুন চাকরি নিয়ে ঢাকার বাইরে আছে, ছোট তিন ভাই ফজরের নামাজ পড়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছে ওদের বন্ধু সেতু, সাগর আর ড্রাইভার মঞ্জুকে নিয়ে কাছেই ইষ্টার্ন হাউজিং প্রজেক্টের মাঠে।
টাঙ্গাইলে কল্লোল
খেলা শেষ করে সবাই মিলে পাশেই বিশাল ঝিলে (বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর) গোসল করছিলো। কয়েকজন টিউব নিয়ে সাঁতার শেখার চেষ্টাও করছে সেখানে কল্লোলও ছিলো। কল্লোল আমার কনে ভাই (চতুর্থ)। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম বর্ষের ছাত্র। যার নামের অর্থ ঢেউ! যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি সে বছর (১৯৭৯) সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে কল্লোলের জন্ম। সে দিনের কথা আজও স্মৃতিতে অম্লান!
আম্মার ডেলিভারি পেইন। আমি আর আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই এপোলো নানুকে আনতে যাবো। কিন্তু হেঁটে গেলে দেরী হবে তাই একটা রিক্সার পিছনে বানরের মতো ঝুলে ঝুলে নানু বাসায় গিয়ে নানুকে এনেছিলাম। আমরা বাসায় পৌঁছানোর ১০ মিনিট আগেই কল্লোলের জন্ম হয়। নানুর দেয়া কল্লোল নামে জন্মের প্রথমক্ষণ থেকেই ওর পরিচিতি। কে জানতো যে কল্লোলই কল্লোলের শেষ নিঃশ্বাস!
লেখকের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কল্লোল (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)...
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এক ক্লাসমেটের সাথে প্রেমের সম্পর্কও হয়েছে। আমার অফিসে এসে প্রায়ই বাইরে খাবার জন্য টাকা নিয়ে যেতো। দূর থেকে দুইকান ধরে এমনভাবে সামনে এগিয়ে আসতো যে, টাকা যা চাইতো তার চাইতে বেশিই দিয়ে দিতাম! দিবো-ই বা না কেনো? আমি আর বড়বোন যে সন্তানের মতো ছোটো ভাইদের (৫ ভাই এক বোন) আর বোনকে লালনপালন করেছি।
আমার বিয়ের পর কল্লোল আরফানের কাছে প্রতি সপ্তাহে ১০০০ ট্রান্সলেশন, ন্যারেশন আর ভয়েস চেঞ্জ করে চেক করতে দিতো বিনিময়ে ওর দুলাভাই-এর ঘাড় বানায়ে দিতো। হাত পা চেপে দিতো। মেট্রিক পরীক্ষায় দুই ম্যাথ-এ ১০০ করে মার্কস পেয়েছিল। অসম্ভব নামাজী ছিলো। নিজের জীবনের সমস্ত ক্বাজা নামাজ গুণে গুণে যে শেষ করেছে তা না, ও অগ্রীম অনেক নামাজ পড়ে রাখতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো সময় আছে পড়ে রাখি!
লেখকের বিয়েতে বরের ছবি
আমার মেজো মেয়ে দিশাকে সুযোগ পেলেই দেখতে যেতো (তখন দিশা মাত্র জন্মেছে) আর আম্মু আম্মু বলে ডেকে অস্থির করতো, যে ভাই একসময় বলতো "বাচ্চাদেরকে কেন আব্বু আম্মু ডাকো? নিজের আম্মু আব্বু নেই"?
সেদিন সেই ঝিলে কল্লোল টিউবে সাতার শেখার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ করেই একটা বড় ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় যে গেলো সেটা কেউই বুঝতে পারেনি। মুহূর্তেই আমাদের সবার পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেলো। সকাল সাড়ে ৮টায় ছোট বোন খুকু ফোনে বললো "টপু, কল্লোল পানিতে ডুবে গেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না"! আমি বললাম "জলদি খুঁজে বের করতে বল, আব্বা খুব রাগ করবে"! (আমার মাথায় ঢুকেনি যে মারা যেতে পারে! আমরা আব্বাকে খুব ভয় পেতাম) হায়রে বোকা আমি! তখন কি আর জানি যে, আমার আদরের ভাই তখন আমাদেরকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে?
মেজো মেয়ে দিশার প্রথম জন্মদিনে ওর (কল্লোল) জীবনের শেষ ছবি...
কোনরকমে একটা জামা পড়েই বাবার বাসায় এসে দেখি সামনে এম্বুলেন্স। ভেবেছি ওকে হাসপাতাল থেকে সুস্থ করে এনেছে! গ্যারেজে চোখ যেতেই অন্যরকম দৃশ্য চোখে পড়লো। দেখি কল্লোলকে গ্যারেজে একটা লোহার খাটিয়ায় শুইয়ে রেখেছে। সাংবাদিক এসেছে। আর পাড়ার মানুষ বলছে, "আহা রে এতো তাজা ছেলেটা এভাবে চলে গেলো, বাবা-মা এই শোক কিভাবে সইবে"? আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়লাম খাটিয়ায় শোয়া কল্লোলকে দেখে। (ওর কপালে সেজদাহ এর কড় পরা দাগটা খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।) যখন হুঁশ হলো, তখন দেখি ওর সব বন্ধু আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই আম্মা আর আব্বাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু উনারা দুজনেই নির্বাক। বড় ভাইটা পাগলের মতো প্রলাপ বকছে আর নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে, কেন ওদের সাথে খেলতে গেলো না।
যখন কল্লোলকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন শেষবারের মতো আমাদেরকে দেখাতে নিয়ে গেল। আমার বাবা কোনো শব্দ করেননি, কিন্তু ছেলেকে কাঁধে নিয়ে সেই যে গেলেন আজও সেই ব্যাপারে কারো সাথেই কথা বলেন না। কিভাবে বলবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা বয়ে যে আব্বা ক্লান্ত এখন।
পারিবারিক শেষ ছবি...
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে খুব বড় একটা গুণ দিয়েছেন সেটা হলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। তা না হলে সন্তান হারিয়ে কিভাবে একজন বাবা-মা বেঁচে থাকেন? কল্লোল বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঘর সংসার করতো। হয়তো মিস্টি মেয়েটির স্বামী হয়ে দুটো মিস্টি বাচ্চাদের বাবা হতো! যেটা ওর সব বন্ধুদেরকে এখন দেখি আর আমরা সব ভাই বোন ওকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াই মনে মনে!
আজও মেয়েরা নানুবাসায় গেলে নীরবে কাঁদে ছোটবেলার কনে মামার সাথে তোলা ছবিকে আদর করে। কল্লোলের মেঝো দুলাভাই আরফান ও যেনো কার হাতের স্পর্শ খুঁজে ওর ঘাড়ে! বলে শ্বশুরবাড়িতে এসে এখন আর আগের আনন্দ পাই না। আর আমি খুঁজে বেড়াই একটি কন্ঠস্বর যে বলে উঠবে, "আরে মেজাপু, তুমি কি জানো যে... যে কথার শুরু হয়েছিল কিন্তু শেষ করতে পারেনি। কারণ কল্লোলেই যে কল্লোলের শেষ নিঃশ্বাসটা পড়ে আছে!
সবাই আমার ছোট ভাইটির জন্য দোয়া করো।
রব্বির হাম হুমা কামা রব্বা ইয়ানী সগীরা।
লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।