ভারতবর্ষের স্বাধীনতা: বাঘা যতীনের অগ্নিস্পর্ধিত ভূমিকা
প্রকাশিত : ২০:৩৬, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২০:৩৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
আজ ১০ সেপ্টেম্বর বাঘা যতীনের ১০৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার অগ্নিস্পর্ধিত ভূমিকা ছিল অসামান্য। তার অবিশ্বাস্য দেশপ্রেমে ও হার না-মানা অসম সম্মুখ যুদ্ধে গোটা ভারতবর্ষে আন্দোলনের অগ্নিবারুদ সৃষ্টি হয়েছিল। অনুনয়-বিনয় নয়, যুদ্ধ করে নিজের দেশের মুক্তি অর্জনই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। তার তৈরি পথেই পরবর্তীতে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে বিখ্যাত এ বিপ্লবী ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের বালেশ্বরে বিশাল ব্রিটিশবাহিনীর সাথে মাত্র চারজন কিশোর সহযোদ্ধা নিয়ে অসম সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বগলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন। ১০ সেপ্টেম্বরও তিনি শরীরের সমস্ত ব্যান্ডেজ ছিঁড়ে আত্মাহুতি দেন। বুকের তাজা রক্ত দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র তিনি লিখে দেন। মহান এই বিপ্লবীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন, ৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫) স্বার্থ কখনো যাঁর অন্তর স্পর্শ করতে পারে নি। অবিশ্বাস্যরকম স্বদেশপ্রেম ও প্রাণে বিশাল উদারতা ধারণ করে তিনি সর্বজন-হিত-সাধনে ব্রতী মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছেড়ে স্বদেশের জন্য যেভাবে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তা কেবলি এক অপার বিস্ময়ের জন্ম দেয়। আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না তিনি কতো বড় আসক্তিশূন্য বীর ছিলেন। এ বীর-পুরুষ সম্পর্কে বলার আগে ভারতে কিভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সে বিষয়ে সামান্য দৃষ্টিপাত করা প্রাসঙ্গিক ও সঙ্গত মনে করি।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার (১৭৩০-১৭৫৮) পরাজয় ও নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁর (১৬৭৬-১৭৫৬) মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র হিসেবে তিনি মাত্র সতের বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তাঁর পরাজয় ও নিহত হওয়ার মূলে ছিল তাঁর সেনাপতি মীরজাফরের (?-১৭৬৫) চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এরপর থেকেই বাংলার আকাশে দুর্যোগের ভয়াবহ কালোমেঘ জমে ওঠে। পরাধীনতার শেকলে বন্দি হয়ে পড়ে বাংলা। মূলত তখন থেকেই ইংরেজ-শাসন শুরু হয়। তারপর ধারাবাহিক সংগ্রামের ফলে দীর্ঘ দু’শ বছর পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। এই স্বাধীনতা অর্জন করতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে অসংখ্য বীর-বাঙালিকে।
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ-শাসনকাল তিন বছর অতিক্রম না-করতেই ১৭৬০ সালে বাংলার কৃষকরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। এঁদের সঙ্গে বিহারের কৃষকরা যুক্ত হয়ে গণ-বিদ্রোহে রূপ দেয়। ১৭৬৩ সালে ঢাকায় ইংরেজদের কুঠি আক্রমণ। ১৭৬৪ সালে বিহারের সারন জেলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক ফকির মজনু শাহ (১৮শ’ শতাব্দী) ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন বাংলার ভবানী পাঠক, নুরুল মুহম্মদ, পীতম্বর, দেবী চৌধুরাণী প্রমুখ। ১৭৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রংপুরের কাছে জাফরগঞ্জে বিদ্রোহী ও ইংরেজদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি টমাস পরাজিত ও নিহত হন। এরপর নতুন সেনাপতি এডওয়ার্ডস-এর নেতৃত্বে ইংরেজরা আবার আক্রমণ করে। বিদ্রোহীরা এবার তাঁদের সমর কৌশল পরিবর্তন করে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করে। এতে ইংরেজবাহিনী আবার পরাজিত হয় ও এডওয়ার্ডস নিহত হন।
১৭৮৭ সালে মজনু শাহের মৃত্যু হলে তাঁর ভাই মুসা শাহ এবং পরে পুত্র চেরাগ আলী শাহ ফকিরদের নেতৃত্ব দেন। ফকির সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারবার আক্রমণ চালানোর কারণে ইংরেজরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফকিরসন্ন্যাসীদের দমন করার জন্য তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা থেকে শুরু করে ধরে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোাষণা, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায়। ফকির সন্ন্যাসীদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় টিপু গারো (?-১৮৫২)-এর নেতৃত্বে শেরপুরে ও গারো অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়।
১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা এক আইন জারির মাধ্যমে বাংলার কৃষিজমির ওপর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’ চালু করে। এতে বাংলার কৃষকরা তাঁদের জমির অধিকার হারায়। ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
১৭৯৯ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান হায়দার আলী এবং তাঁর পুত্র টিপু সুলতান। ফরাসীদের সহায়তায় টিপু সুলতান আধুনিক অর্থনীতি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। ফরাসীরা তখন ইংরেজদের প্রতিপক্ষ। সে কারণে ইংরেজরা সহজেই বুঝতে পারে টিপু সুলতানকে দ্রুত দমন না করতে পারলে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সেকারণে ওয়েলেসলি কালক্ষেপন না করে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে টিপু সুলতানকে আক্রমণ করে। কিন্তু টিপু সুলতানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তারই এক সেনাপতি। এর পরেও টিপু সুলতান পিছপা না হয়ে ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতেই রণক্ষেত্রে প্রাণ দেন। পলাশীর যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধ তুলনীয় হতে পারে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের মতোই প্রায় একই দৃশ্যপটের অবতারণা ঘটে টিপু সুলতানের ক্ষেত্রেও।
এই আন্দোলনের ধারাকে এগিয়ে নেন তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১)। ওয়াহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান কৃষকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তিনি। চব্বিশপরগনা জেলায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। এ আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিলে ইংরেজরা ১৮৩১ সালে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁর বাঁশের কেল্লায় আক্রমণ চালায়। বাংলার ভাটি অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুরের হাজি শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)। তিনি ‘ফরায়জী’ নামে কৃষকদের গোপন সংগঠন তৈরি করেন। এরপর এ আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর পুত্র দুদুমিয়া (১৮১৯-১৮৬০)।
১৭৯৯ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পলিগার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পলিগার বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন পাঞ্জালাল কুরিচির বীর পান্ডেয়ম কাট্রাবোম্মান। এ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।
১৮২৫ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বিধবা রাণী চান্নাম্মা। এ যুদ্ধ ছিল অসম। বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এ যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়। চান্নাম্মার মৃত্যুর পর এ বিদ্রোহকে এগিয়ে নেন সাঙ্গোলির চাষীর ছেলে বায়ান্না। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে ইংরেজ বাহিনী ১৮৩০ সালে এপ্রিল মাসে চরম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে এ প্রতিরোধ সংগ্রামকে থামিয়ে দেয়।
ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮২৪-২৫ সালে মধ্যভারতের বুন্দেখন্ডে হিন্দু-মুসলমান গরিব চাষিরা বিদ্রোহ করে। জাঠ চাষিরা বিদ্রোহ করে ১৮২৪ সালে। গুজরাটে কোল বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ১৮৩৯-১৮৪৫ পর্যন্ত। মহারাষ্ট্রের সামন্তওয়ারি ও কোলাপুরে বিদ্রোহ হয় ১৮৪৫ সালে। ১৮২৯-৩৩ সালে মেঘালয়ের অধিবাসিরা সংঘটিত করে খাসিয়া বিদ্রোহ।
সাঁওতালরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৮৪ সালে সাঁওতালরা প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সাঁওতাল নেতা তিলকা মানঝির গুলতির আঘাতে ইংরেজ কালেক্টর ক্লিভল্যান্ড মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিলকা মনাঝি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়। এরপর মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর এলাকায় ইংরেজদের অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। ফলে সিধু, কানু, ভৈরব ও চাঁদ-চার ভাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করতে থাকেন। এঁদের নেতৃত্বে ‘দামিনইকো’ শহরের নিকটস্থ ভাগনাহাটি গ্রামে বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সভায় ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমণ চালালে বিদ্রোহীরা দারোগা ও তার পুলিশকে হত্যা করে বন্দুকগুলো নিজেদের দখলে নেন। এরপর এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে সাঁওতাল দ্রুত সময়ে বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ ও বিহারের বড় একটি অংশের দখল গ্রহণ করেন। এরপর এ-চার ভাইয়ের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ দমনের জন্য কলকাতা থেকে ১৬ জুলাই বিরাট এক পুলিশ বাহিনী এসে আক্রমণ শুরু করে। এতে সিধু-কানুর নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহের দমন ঘটে।
১৮৩০ সালে ছোট নাগপুরের উপজাতি অঞ্চলে শুরু হয় আদিবাসী বিদ্রোহ। রাচী থেকে মানভূমি পর্যন্ত লাখ লাখ মুন্ডা ও হো এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। এ বিদ্রোহ চলে ১৮৩৩ পর্যন্ত।
লর্ড-ক্যানিং ভারতে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হওয়ার পর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ও নানাকারণে এ বিপ্লবের জন্ম হয়। এ বিপ্লব প্রথম শুরু হয় ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে। পরবর্তীতে এ বিপ্লব মীরাট, দিল্লী, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যভারতসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীগণ দিল্লীকে মুক্ত করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। বিদ্রোহীদের প্রধানকেন্দ্র ছিল দিল্লী, মীরাট, লক্ষৌ, কানপুর, কেরালা ও ঝাঁসী। কানপুরে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন নানাসাহেব। তিনি কানপুরে সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। অযোধ্যার প্রাক্তন রাজার স্ত্রী বেগম হযরত মহল অযোধ্যার বিপ্লব পরিচালনা করেন। আহাম্মদউল্লাহ ছিলেন অযোধ্যার বিপ্লবীদের সুবিদিত নেতা। বেরিলীতে হাফিজ রহমত খানের বংশধর খান বাহাদুর খান নিজেকে দিল্লীর সম্রাটের স্থানীয় প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেন। এলাহাবাদে মৌলভী লিয়াকত আলী শাসনভার গ্রহণ করেন। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ স্বাধীনভাবে ঝাঁসি শাসন করেন। এসব নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। সিপাহী বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ইংরেজ শাসনের ভিত কেঁপে ওঠে। এই বিপ্লবকে দমন করতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে শিখ, নেপালী ও ব্রিটিশ সৈন্যরা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়।
চারমাস অবরোধের পর ব্রিটিশ সৈন্যরা দিল্লী উদ্ধার করে বাহাদুর শাহকে বন্দি করে রেঙ্গুন নির্বাসন দেয়। নির্বাসনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কানপুর উদ্ধার করে স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে ব্যাপক অত্যাচার চালায়। নানাসাহেব নেপালের জঙ্গলে আশ্রয় নেন, এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অযোধ্যার এক বিশ্বাসঘাতকের গুলিতে নিহত হন দেশপ্রেমিক আহমদউল্লাহ। বেরিলীতে এক বছর বিদ্রোহ চলার পর দখল করে ক্যাম্বেল সাহেব। নানাসাহেবের সেনাপতি তাঁতিয়া তোপী ইংরেজদের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ করা অবস্থায় নিহত হন ঝাঁসির রানী। সিপাহী বিদ্রোহ স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই স্বীকৃত।
ইংরেজদের নীলচাষের বিরুদ্ধে যশোরের চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংগঠিত হতে থাকে। ১৮৫৯ সালে ইংরেজ সৈন্যরা চৌগাছায় বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণের কারণে নীলচাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আগুন আরো ব্যাপকতা লাভ করে এবং সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা ১৮৬১ সালে বাংলায় নীলচাষ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে। ১৮৯৯ সালে দুর্ভিক্ষ হয়। এসময় ইংরেজরা খাজনা আদায়ে ভয়াবহ নির্মম হয়ে ওঠে। গরীব কৃষকদের ওপর অন্যায়ভাবে নানারকম অত্যাচার চালায়। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বীরসা মুন্ডা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯০০ সালের ৯ জানুয়ারি পুলিশের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে বীরসা মুন্ডার বাহিনীর যুদ্ধ সংঘঠিত হলে বীরসা মুন্ডা পরাজিত হন। তাঁকে গ্রেফতার করে রাঁচি জেলে বন্দি রাখা হয়। এ জেলে বন্দি অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতকে স্বাধীন করার জন্য বাঙালি বিপ্লবীরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যেই ১৯০২ সালে গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি এবং ১৯০৬ সালে গড়ে ওঠে যুগান্তর সমিতি। এসব আন্দোলনে যুক্ত বিপ্লবীদের প্রধান কর্মই ছিল দেশ-মাতৃকার জন্য আত্মদান। এ আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯০৮ সালে প্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮) ও ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮) মি. কিংসফোর্ড-এর গাড়িতে বোমা মারেন। কিন্তু ভুলক্রমে বোমা লাগে কেনেডির গাড়িতে। এতে মিসেস কেনেডি ও মিস কেনেডি নিহত হন। তৎক্ষণাৎ প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে ক্ষুদিরাম গ্রেফতার হন এবং তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। প্রফুল্ল চাকী পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ধরা পড়ার সময় বাঙালি এ পুলিশ কর্মকর্তাকে ধিক্কার জানিয়ে নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য এ সময় গড়ে ওঠে বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায় (বিপিন গাঙ্গুলী, ১৮৮৭-১৯৫৪)-এর আত্মোন্নতি সমিতি (১৮৯৭), হরিকুমার চক্রবর্তী (১৮৮২-১৯৬৩)-এর চব্বিশপরগনার চিংড়িপোতা দল (১৯০৬), যতীন রায় (১৮৮৯-১৯৭২)-এর উত্তরবঙ্গ দল, প্রজ্ঞানন্দের বরিশাল দল, হেমেন্দ্রকিশোর আচার্য (১৮৮১-১৯৩৮)-এর মৈমনসিংহ দল ও পূর্ণদাস (১৮৮৯-১৯৫৬)-এর অধীনস্থ ফরিদপুরের মাদারিপুর দল। এরা পরবর্তীতে যুগান্তর সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৃহৎভাবে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম.এন.রায়, ১৮৮৭-১৯৫৪) সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য দেশে-বিদেশে নিরন্তর পরিশ্রম করেন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তৈরি করে অস্ত্র সংগ্রহ করে তিনি বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু তথ্য ফাঁস হওয়ায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়। পরে তিনি বিদেশে গিয়ে বিপ্লব সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। রাসবিহারী বসু (১৮৮৫-১৯৪৫) বিদেশি শক্তির সহায়তায় দেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ১৯১৫ সালে ছদ্মবেশে বিদেশে যান এবং ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ‘আজাদ হিন্দ্ ফৌজ’ গড়ে তোলেন।
একক বা ব্যক্তিউদ্যোগে নয় সংগঠিতভাবে সংঘবদ্ধ উপায়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করে ভারতকে স্বাধীন করার মূলমন্ত্রের প্রবক্তা বাঘা যতীন। যুগান্তর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাঘা যতীনই প্রথম সঙ্গীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে বালেশ্বরের চাষাখন্ডে যুদ্ধ করে আত্মাহুতি দেন। ১৯৩০ সালে সূর্যসেন (১৮৯৪-১৯৩৪)-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করা হয় এবং বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। তবে এ সরকার স্বল্পায়ু ছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর সরকারের পতন ঘটে। সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত হয় নারীরাও। আন্দোলনে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২), শান্তি, সুনীতি, বীণা দাস সশস্ত্র সংগ্রামে নারী নেতৃত্বের পথিকৃৎ। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের পরে বিজয়িনীর বেশে ফেরার পথে আত্মগোপনকারী ইংরেজ যুবকের গুলিতে আহত হয়ে প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকারের আস্তানা রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন বিনয় (বিনয়কৃষ্ণ বসু, ১৯০৮-১৯৩০), বাদল (বাদল গুপ্ত, ১৯১২-১৯৩০) ও দীনেশ (দীনেশ চন্দ্র গুপ্ত, ১৯১১-১৯৩১)। আক্রমণে কারাধ্যক্ষ কর্নেল সিম্পসন নিহত হয়। ফলে ইংরেজদের মনে ব্যাপক ভীতি তৈরি হয়।
ইংরেজদের শোষণ ও উৎপীড়নের প্রতিবাদে চল্লিশের দশকে হাজং চাষীরা বিদ্রোহ করেন। এতে মুসলমান চাষীরাও যুক্ত হন। হাজংদের এই বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন রাসমণি নামের এক বিধবা মহিলা। ১৯৪৬ সালে সোমেশ্বরী নদীর তীরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাসমণি মারা যান।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন হয়। এ আন্দোলন ‘স্বদেশী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও এই আন্দোলন অব্যাহত থাকে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫) হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করে বাঙালির প্রধান সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে অভূতপূর্ব এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দেশমুক্তির লক্ষ্যে এই ঐক্য গঠন ছিল জরুরি। এটি সম্পন্ন করেই তিনি ‘স্বরাজ দল’ গঠন করেন। অনেক মুসলমান নেতা তাঁর দলে যোগ দেন। কিন্তু ১৯২৫ সালে ১৬ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁর গঠিত ‘স্বরাজ দল’ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫?) বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি বিদেশে বিপ্লব সংগঠিত করে দেশের মধ্যে সে বিপ্লবের স্রোত তৈরি করে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। তিনি ১৯৩৮ ও ১৯৩৯-এ পরপর দু’বার সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। শেষেরবার তিনি গান্ধি-সমর্থিত শক্ত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করেন। দলের ভেতর থেকেই ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ (১৯৩৯) গঠন করার কারণে তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’কে তিনি আপোষবিরোধীদের প্লাটফরমে পরিণত করার চেষ্টা করেন। তাঁকে দেশের ভেতরে ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীÑ এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৪১ সালে ২৬ জানুয়ারি তিনি গৃহে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় কৌশলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশত্যাগ করেন। মূলত জার্মানি ও জাপান এবং প্রবাসী ভারতীয়দের সহায়তায় ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু প্রতিষ্ঠিত ‘আজাদ হিন্দ্ ফৌজ’কে পুনর্গঠিত করেন এবং পাশাপাশি ১৯৪৩-এ স্বাধীন সরকার গড়ে তোলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘আজাদ হিন্দ্ ফৌজ’ উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেলেও শেষপর্যন্ত জাপানের আত্মসমর্পণের পর তার কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে। ফরমোজার তাইহোকু বিমান বন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর কথিত মুত্যুর কথা প্রচার করা হয়। আসলে তাঁর মৃত্যু বা অন্তর্ধানের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
এভাবে ধারাবাহিক বিদ্রোহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যা ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি পরিবর্তনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। যার পরিণতিতে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে বাধ্য হয়।
বাঘা যতীন সর্বভারতীয় এক মহান নেতা। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক। তৎকালে সারা ভারতের রাজনীতি ছিল আবেদন-নিবেদনে বন্দি। সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল কল্পনারও অতীত। ইংরেজরা তখন ধরেই নিয়েছে ভারতে তারা স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। তারা জানতো তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বা সংগঠিতভাবে বিদ্রোহ করার শক্তি বা সাহসের জন্ম হবে না। কারণ অঙ্কুরেই তা সমূল উৎপাটন করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো ব্রিটিশরা। এ কারণে তাদের ক্ষমতার দাপট ও দম্ভ ছিল আকাশ সমান। কিন্তু ব্রিটিশদের এসব ধারণা একদিন মিথ্যে করে দেয় বাঘা যতীন। তিনিই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপকার। নিজে সঙ্গীদের নিয়ে বিশাল ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে অসম শক্তিতে যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে তার প্রয়োগ ঘটান। ব্রিটিশরা বুঝতে পারে তাদের মসনদ ভেঙে পড়ার আর খুব বেশি দেরি নেই।
বালেশ্বরের (কাপ্তিপোদার যুদ্ধ, ১৯১৫) এই যুদ্ধ যদি ব্যর্থ না হতো, তাহলে ভারতের ইতিহাস লেখা হতে পারতো অন্যভাবে। যে ইতিহাস হয়ে যেতে পারতো বাঘা যতীন-নির্ভর। অদম্য স্বাধীনতাকামী এই বিপ্লবী নেতা ভারত-স্বাধীনতা সংগ্রামে মহানায়ক হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
বালেশ্বরের যুদ্ধে অসম সাহসিকতা এবং ভারত স্বাধীনতার নতুন মন্ত্র বুনে দেয়া বীর বাঘা যতীনের মৃত্যুতে একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটলেওÑ পরবর্তীতে সেই আন্দোলন ও বিপ্লবের পথ ধরেই অর্জিত হয় ভারতের স্বাধীনতা। বাঘা যতীন সেখানে হয়তো আড়ালে পড়ে গেছেন, মূল আলো থেকে খানিকটা সরে গেছেন। একটি পর্বের প্রধান পুরুষ হিসেবে তিনি বিবেচিত ও মূল্যায়িত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ছড়িয়ে দেয়া আলোতেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতমুক্তির যে আন্দোলন করলেন, বিশ্বকে বিস্মিত করে ভারতকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত করার যে দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করলেনÑতার মূলে ছিল পূর্বসূরি বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মসূচি।
ভারতের সর্বপ্রথম আধুনিক জাতীয়তাবাদী নেতা বাঘা যতীন মাত্র চারজন সহযোগী নিয়ে ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য যে অগ্নিরক্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, ভারত-স্বাধীনের জন্য পরবর্তীতে সেই অগ্নিরক্তই একমাত্র আদর্শ হয়ে উঠেছিল এবং সেই অগ্নিরক্ত জ্বালিয়েই পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ভারতের মুক্তি ঘটে।
বালেশ্বরের যুদ্ধের এই মহানায়ক আমাদের এই মাটির বীর সন্তান। খাঁটি বাঙালি। সারা পৃথিবীতে যে ক’জন বাঙালির জন্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়, বুক উঁচিয়ে গর্ব করা যায়, বাঘা যতীন তাঁদের মধ্যে প্রধানতম একজন। অথচ এই বাঙালির নাম এপার বাংলায় প্রায় অনুচ্চারিত, তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিতে আমাদের কার্পণ্য অনেক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) বাঘা যতীন সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাঁর দেখানো আলোতে আমরা এতোটা পথ এসেছি।’ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম. এন. রায়, ১৮৮৭-১৯৫৪) বাঘা যতীনকে লেনিনের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৯৬১) বাঘা যতীনের মৃত্যুতে শোকার্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, ‘এতোকালের পরাধীন দেশে এ মৃত্যুও ছোট নয়।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাঘা যতীনকে সম্রাট নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ব্রিটিশবাহিনীর প্রধান টেগার্ট বলতে পারেন, ‘বাঘা যতীন যদি ইংলিশম্যান হতেন তাঁর স্ট্যাচু তৈরি করে রাখা হতো তাঁর উত্তরসূরিদের জন্যÑযুগ যুগ ধরে তাদের উজ্জীবিত করার জন্যÑঅনুপ্রাণিত করার জন্য।’ অথচ আমরা আমাদের এই ঘরের ছেলেকে দিতে পারিনি যোগ্য সম্মান। আমরা কি একবারও ভেবেছি, তাবৎ বাঙালির ললাটে তিনি কী অমোঘ সম্মানতিলক এঁকে দিয়েছেন? একথা ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালির ‘বাঘা যতীন’ একজনই। অন্যায়-অত্যাচার, ভয়, পরাধীনতা এসবের বিরুদ্ধে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর স্পর্ধিত চেতনার নাম বাঘা যতীন।
ভারতকে স্বাধীনভূমিতে পরিণত করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ। এই সংগ্রামে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করে মুক্তিকামী মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন তিনি মহানায়ক। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তাতে কেঁপে উঠেছিল তাদের শক্ত ভিত। তাদের মূর্তিমান আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এভাবে বুক উঁচিয়ে দাঁড়ানো, প্রতিবাদের আগুন জ্বালানো এবং সংঘবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে জীবন-দান অবিশ্বাস্য ছিল। বাঘা যতীনই প্রথম শেখালেন বিচ্ছিন্নভাবে নয় সংগঠিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, জীবন দিতে হবে। এছাড়া ভারতমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা যাবে না। এটা কতো বড় সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ সে-সময়ে তা চিন্তা করাও কঠিন ছিল। কারণ হিংস্র ব্রিটিশদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার খবর পৌঁছানো মানেই বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি তৈরি হতো, যেখানে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও মৃত্যু অবধারিত ছিল। সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা বাঘা যতীন ভালো করেই জানতেন। কিন্তু তিনি তা পরোয়া না করে মুক্তিকামী সঙ্গীদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং সঙ্ঘবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে মুক্তির পথ রচনা করেছিলেন।
মাত্র ৩৬ বছরের জীবন ছিল মুক্তিকামী এই যোদ্ধার। স্বল্পায়ু জীবনে তিনি যা করলেন, তাতে পরাধীন ভারতবাসী পেলেন মুক্তির মন্ত্রবীজ। এক সাধারণ বাঙালি সন্তান গোটা ভারতবর্ষকে শিখিয়ে গেলেন স্বাধীনতা কিভাবে অর্জন করে নিতে হয়, কিভাবে বিপ্লব সংঘটিত করতে হয়। বিচ্ছিন্নভাবে নয় দলগতভাবে বিপ্লব করেÑ মরণযুদ্ধ করেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়, বালেশ্বরের যুদ্ধে শিখিয়ে দিলেন তিনি।
বর্তমার প্রজন্মের কাছে বাঘা যতীন বিস্মৃত প্রায়। কিন্তু তার মহান আত্মত্যাগের ভেতর দিয়েই স্বাধীনতার সুর্য উদিত হয়েছিল। বাঘা যতীন বর্তমানে চরমভাবে অবহেলিত। তাকে শ্রদ্ধা-সম্মানে স্মরণে আনতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের অপরাধী করে দেয়।
(ড. রকিবুল হাসান: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।)
আরকে//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।