করোনাকালে ধরে রাখতে হবে শিক্ষার মান
প্রকাশিত : ২২:০০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
করোনাকালে দেশের বিভিন্ন খাত ও শ্রেণীর মতোই ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ঘাত-প্রতিঘাত মারাত্মকভাবে লেগেছে। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে ভর করেছে। যেখানে তরতর করে বন্ধুত্ব-পাঠ ও গঠনের মাধ্যমে নিজের সৃজনশীলতা ও ধীশক্তির বিকাশ ঘটানোর কথা, সেখানে আবদ্ধ অবস্থায় তাদের থাকতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশকে দেশে দেশে প্রলম্বিত করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তারপরও আমাদের শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যে ভরপুর ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন চারদেয়ালের প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে উঠেছে।
করোনাভাইরাসের পাশাপাশি বাংলাদেশে আম্ফান এবং ১৬ বছর পর বন্যায় প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এই এক কোটি ভানভাসি মানুষের মধ্যে বিশ লাখ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রাইমারী শিক্ষার্থী থেকে আরম্ভ করে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। বন্যার কারণে ৩৮টির মতো বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; প্রায় পাঁচ হাজারের মতো বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে প্রায় বিশ লাখ ছাত্র-ছাত্রী প্রাকৃতিক বন্যায় মারাত্মকভাবে পড়াশোনা থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। করোনার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিছুদিন আগে দেখলাম এমবিবিএসের কিছু ছাত্র-ছাত্রী ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিতে চাচ্ছে। তারা অনলাইনে ক্লাস করলেও প্র্যাকটিক্যাল করতে পেরেছে কি? আসলে একদিকে করোনা, অন্যদিকে বন্যা- দু’য়ের কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনিতেই আমাদের দেশে প্রি-প্রাইমারী থেকে আরম্ভ করে টারসিয়ারী লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার কোটি ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করে থাকে, যা কানাডার মতো একটি উন্নত দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। একটি উচ্চমাত্রার ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের বাংলাদেশ। শিক্ষা সম্পর্কে ১৯৫৪ সালে হান্নাহ আরইনডিট মন্তব্য করছিলেন যে, শিক্ষা এমন একটি ব্যাপার যা আমরা বিশ্বকে ভালবাসি কিনা তার বহির্প্রকাশ ঘটায়; তার লক্ষ্য থাকে ধ্বংস থেকে পরিত্রাণ করার, বারংবার পুনর্সংঘটিত করা, নতুন থেকে যুব সমাজকে বলিষ্ঠ প্রতিদান দেয়ার। কিন্তু ইদানীং কিছু ব্যবসায়ী শিক্ষার মূল অভীষ্ট সিদ্ধকে নষ্ট করে ফন্দি-ফিকিরের হাতিয়ার করতে চাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে বেড়ে ওঠার মধ্যে নিহিত রয়েছে দেশের ভবিষ্যত।
বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল শিক্ষানীতি ২০১০। অসাম্প্রদায়িক চেতনাপুষ্ট, লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছিল। দুর্ভাগ্য যে, শিক্ষানীতিটি আইন হিসেবে প্রণীত না হওয়ায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আবার আমাদের দেশের এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে যারা মনে করেন শিক্ষক হোন, চিকিৎসক হোন, প্রকৌশলী হোন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হোন- যার যার অবস্থানে থেকে ক্ষমতা জাহির করবেন। এই ক্ষমতা দেখতে গিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদনস্বরূপ। শিক্ষানীতিতে যেখানে পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা পিইসি না রাখার সুপারিশ করেছে গোপনে সেটিকে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী ক্ষমতা জাহিরের জন্য বজায় রাখার স্বার্থে কোমর বেঁধে লেগেছেন। এ বছর অবশ্য সরকার প্রাথমিক শিক্ষা এবং সমতুল্য পর্যায়ের এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা করোনার কারণে বন্ধ ঘোষণা করেছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। এদিকে তলে তলে কিছু অসাধু শিক্ষক কর্মকর্তা সঙ্গোপনে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ গঠনের প্রক্রিয়া চালু করেছেন বলে জাগো নিউজের একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। অবস্থা দাঁড়িয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাষায় : ‘তোরা যে যাই বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই/’। যত বেশি শিক্ষা বোর্ড তৈরি করতে পারবে তত ক্ষমতা দেখাতে পারবে এবং জনগণের ট্যাক্সের থেকে খরচও বৃদ্ধি পাবে।
এতদিন অবশ্য পিইসি পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আওতায় প্রচলিত ছিল। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ হ্রাসের কথা মোটেই ভাবেনি। আসলে আমাদের দেশে এত বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াস প্রতিটি স্তরে পরিলক্ষিত হয় যে, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে একদল শিক্ষক কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের কাজ করে পরে এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যায়ে সৃজনশীল পরীক্ষার নামে ছাত্র-ছাত্রীদের গিনিপিগ বানাতে প্রয়াস নিয়েছিলেন। আমার বাবা প্রফেসর মোবাশ্বের আলী সাহেব সব সময় বলতেন, কখনও বিদ্যা জাহিরের নামে ছাত্র-ছাত্রীদের গিনিপিগ বানাবে না, বরং বিদ্যা জাহির করতে গেলে সমানে সমানে করতে হয়। অথচ আমাদের এক শ্রেণীর শিক্ষক এ ধরনের কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো ক্ষমতা জাহিরে ব্যস্ত থাকেন। এটি ভুলবার নয়, দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের পদমর্যাদা এবং বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধিকল্পে সরকারপ্রধান অনেক করেছেন। সকল ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিন্ন করে প্রথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান বৃদ্ধিকল্পে নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছেন। জরুরী ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের প্রয়াস বন্ধ করা দরকার। অনেকেই সরকারপ্রধানের মূল্যবান নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের সময় জুনিয়র লেভেল ম্যানেজমেন্ট এবং মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টে যারা থাকেন, তারা তাদের কার্যক্রমে সরকারের নির্দেশনার উল্টো ঘটনা ঘটান।
বল্গাহীন দুর্নীতির মাফিয়া নেক্সাস মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত। যারা অন্যায় করেন তাদের কোন দল নেই। দুর্নীতি করা লোকেরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করছে। এরা আসলে গিরগিটির মতো রং পাল্টায় এবং তারা যে এক সময় ছাত্র-ছাত্রী ছিল এটি ভুলে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষায় উন্নতি ও মানসম্পন্ন করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের অভিমত গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। টিভিতে যেভাবে অনাকর্ষণীয়ভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় পাঠদান করা হচ্ছে তা কিভাবে উন্নত করা যায় সেদিকে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখা বাঞ্ছনীয়। সরকারপ্রধানের ইচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিয়ে মোবাইল ফোন কেনা এবং টেলিটকের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের উচিত ছিল স্ব-উদ্যোগে ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তায় এগিয়ে আসা সিএসআর-এর আওতায়।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্নেহ করেন বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীদের এক হাজার টাকা করে দেবেন, যাতে তারা তাদের কাপড়-চোপড়, টিফিন বক্স ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক সমাপনী অধিবেশনে আরও বলেন যে, করোনা চলাকালেই এলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। তারপর এলো দীর্ঘমেয়াদী বন্যা। তিনি আরও বলেন যে, মানুষ যেন কোন দুর্ভোগ না পোহায়। প্রধানমন্ত্রী সব সময় জনগণের পাশে থেকে জনগণকে সঠিক মাত্রায় নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। যারা শিক্ষিত বেকার তাদের জন্যও কিছু টাকা করে দেয়া যায় কিনা সেটি বিবেচনা করা দরকার। কেননা শিক্ষিত বেকাররা অনেক বেশি নিউ নর্মাল সিচুয়েশনে হতাশ হয়ে পড়েছে এবং এই টাকা তাদের মানসিক মনোবল চাঙ্গা করতে সহায়তা করবে বলে বিশ্বাস করি। জরিপ করে দেখেছি, অনেক যোগ্য শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের করোনার কারণে চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় মানসিক মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে এবং নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করছে।
এমনিতেই এদেশে যোগ্য লোককে অনেক ক্ষেত্রেই তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়া হয় না। সুযোগ না দিলে এক ধরনের অন্তরায় থেকে যাবে। জাতিকে অযোগ্যদের বোঝা নিয়ে চলতে হবে, এই সিস্টেমটি অবশ্যই ভাঙতে হবে। জনকণ্ঠে সুপারিশ করেছিলাম, বাংলা এবং ইংরেজী মিডিয়ামের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা প্রশ্নের আওতায় পিএসসিতে বিসিএস পরীক্ষা নেয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে অধিকাংশ ইংরেজী মিডিয়ামের স্টুডেন্ট বিদেশে চলে যাবে। এতে আখেরে দেশের ক্ষতি হবে। যারা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন তারা যেন তাদের নৈতিক বলে উন্নীত হন। পরস্পর পরস্পরকে সম্মান করার মতো শিক্ষাটি হয় পরিবার অথবা বিদ্যানিকেতন থেকে। নচেৎ বৃদ্ধকে কানে উঠবস করার মতো দৃশ্য দেখতে হবে। আসলে শিক্ষকদের মধ্যেও একটি দল আজ লুম্পেন বুর্জোয়া হয়ে গেছেন। স্বাভাবিক বোধশূন্য হয়ে অর্থ বানানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন।
গবেষণা না করে বরং তৈলমর্দন করে সামাজিক অসঙ্গতি সৃষ্টি করা এবং নানাভাবে বেসরকারী খাত হলে ন্যূনতম সততা দেখানোর সুযোগ দেখি না। পত্রিকান্তরে যে ধরনের বক্তব্য কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্কে প্রকাশিত হয় তাতে নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। সমাজে অনেক বিত্তশালী নিজেকে জাহির করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত থাকেন অথচ কোন ধরনের অনুদান দেন না। কৈর তেলে কৈ মাছ ভাজেন। পারলে প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে যান। আসলে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পরিবার ও বিদ্যানিকেতনে গুরুজনদের সম্মান করতে শেখানো হতো। কিন্তু এখন সে ধরনের শিক্ষা বিদ্যানিকেতনে দেয়া হয় না। বাঙালী কৃষ্টি-সংস্কৃতি সব আজ ভুলতে বসেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুজনকে শ্রদ্ধা করা, সৎ থাকা এবং মানুষকে মর্যাদা দিতে শিক্ষা দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ আগস্ট, ১৯৭৩ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘বাবারা একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ কর, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোন লাভ নেই। লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে বাপ-মাকে সাহায্য কর। লেখাপড়া শিখছ বলে বাবার সঙ্গে হাল ধরতে লজ্জা করো না।...শুধু বিএ, এমএ পাস করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, কলেজ ও স্কুল- যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানি পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে দিয়ে গেছে দেশটা।’ বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের বক্তৃতার অংশবিশেষ উদ্ধৃতি দিলাম এ কারণে যে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বাস্তবায়নযোগ্য। আসলে কর্মমুখী শিক্ষার কথা সেই আটচল্লিশ বছর আগে জাতির পিতা বলেছিলেন। বস্তুত শিক্ষা হবে মানুষকে আলোকিত করা এবং বেসরকারী ও সরকারী উভয় খাতের শিক্ষার্থীকে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেবে, আলোর স্ফূরণ ঘটাবে, মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ উন্মোচিত করবে।
সময়ের বিবর্তনে জননেত্রী দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। দেশের মানুষকে আর্থিক মুক্তি দিতে সচেষ্ট আছেন। শিক্ষা যেহেতু মানুষের চরিত্র গঠনের হাতিয়ার, সেজন্য বুনিয়াদি শিক্ষা পেতে হলে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রচলন বাধ্যতামূলকভাবে করা উচিত। দুর্ভাগ্য যে, বিজ্ঞান ও কৃষি ক্ষেত্রে এবং চিকিৎসা ও প্রকৌশলে ব্যবহারিক শিক্ষা এদেশে থাকলেও কিন্তু বাণিজ্যিক ও কলা শিক্ষায় ব্যবহারিক শিক্ষার প্রচলন নেই।
দেশে ঊনষাটটি বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তা শিক্ষায় হাতে-কলমে বিভিন্ন প্রকল্পে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠাচ্ছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা অর্থনীতির জন্য একটি ইনকিউরেটর এবং উদ্যোক্তা তথ্যভা-ারের জন্য সিএসআরের আওতায় ল্যাব প্রতিষ্ঠায় স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানালেও কেউ সাড়া দেয়নি। এটি আসলে দেশের সীমাবদ্ধতা। ব্যাংকক ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি, তারা হসপিটালিটি এ্যান্ড ট্যুরিজম প্রোগ্রামের জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অর্থায়নে বিমান ক্রু এবং ক্যাটারিং, ফ্রন্ট ডেস্কের শিক্ষা এবং বিমানবালাদের আচার-আচরণ প্র্যাকটিক্যালি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আসলে সিএসআরের আওতায় বাস্তবমুখী শিক্ষা দেয়ার প্রয়াসে দেশের সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে কাজ করতে হবে।
নচেৎ এ ধরনের সিএসআর আসলে শিক্ষা কার্যক্রমে কোন ফল বয়ে আনবে না। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের নমনীয় ও ভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর একটি সুন্দর উক্তি রয়েছে : তোমার কাছে কেউ কোন সেবা গ্রহণের জন্য এলে তাকে তুমি সেবা দিয়ে নিজেকে খুশী মনে করো না, বরং সে যে তোমার কাছে সেবা গ্রহণের জন্য এসেছে এবং সেবা করার সুযোগ দিয়েছে তাতে তোমাকে ধন্য করেছে। আমাদের যারা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত হোন, কেন জানি বিশ্বায়নের এ যুগে প্রাচ্যের ভাল দিকগুলো হারিয়ে বরং পাশ্চাত্যের উদ্ধত স্বভাব তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে। এটি উপযুক্ত শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আয়ত্ত করা উচিত। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার কারণে জিয়া, এরশাদ ও খালেদার শাসনামলে দেশের মানুষের শিক্ষায় দুর্নীতি, লোভ-লালসা উচ্চ মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের একটি গবেষণায় প-িতেরা দেখিয়েছেন যে, নিউ নর্মাল সিচুয়েশনে যতই অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হোক, সেটি অবশ্যই একটি সীমাবদ্ধতা। বিশেষত যেখানে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজন সেখানে অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা নিতে হবে ভার্চুয়াল শিক্ষার পাশাপাশি। তবে তারা পিএইচডির ক্ষেত্রে তিন বছরে তিনটি স্কুপাস ইনডেক্স জার্নালে প্রকাশনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ইউজিসি বাংলাদেশ, এ্যাক্রেডেশান কাউন্সিলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যারা শিক্ষার উন্নতিতে কাজ করবেন তাদের অবশ্যই সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত থেকে জননেত্রীর নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
এদিকে কলকাতার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল ইউজিসি, ভারত আটকে দিয়েছে। কারণ হচ্ছে পরীক্ষার এ্যাসেসমেন্টের নানা রুব্রিক্স (Rubrics) আছে। তবে একটি ছাড়া অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় নানা রুব্রিক্স ব্যবহার করলেও পরীক্ষা নেয়নি। একটি অবশ্য ওপেন বুক এক্সাম নিয়েছে। আমাদের দেশে পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ডিভাইস ব্যবহার করে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা দরকার। নচেৎ ওপেন বুক এক্সামের ব্যবস্থাও করা যায়, যাতে একজনের পরীক্ষা অন্যজন দিতে না পারে কিংবা ওপেন বুক এক্সামে নিজের মেধা ও মনন প্রয়োগ করতে পারে।
হার্ভার্ডে কেইস স্টাডি সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি যথার্থ অর্থেই শিক্ষানীতিতে অনলাইন বা ভার্চুয়াল শিক্ষার অন্তর্ভুক্তকরণের ওপর, গুরুত্বারোপ করেছেন। এটি অন্তর্ভুক্তকরণের পাশাপাশি যদি অনলাইন পরীক্ষা হয়, তবে তা নকলমুক্ত রাখার জন্য ডিভাইস ব্যবহার কিংবা ওপেন বুক এক্সাম ব্যবস্থার সুযোগ রাখা দরকার। এইচএসসি পরীক্ষার জন্য যে বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো ২০০ মার্কের বদলে ১০০ মার্কের এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণগুলো পূর্ণ মার্কের গ্যাপ না দিয়ে পরীক্ষা নিয়ে, যেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর নম্বর অপশনাল হিসেবে প্রয়োজনে আইন করে কলেজ থেকে দেয়া যেতে পারে। তবে যেগুলোর পরীক্ষা নেবে তার ভিত্তিতে ফল দেয়া যেতে পারে।
লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং আইটি বিশেষজ্ঞ
pipulbd@gmail.com
আরকে//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।