ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

এরই নাম ভালোবাসা

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ১৭:৩৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

কেন তুমি এভাবে আমাকে বিরক্ত করছো পৃথ্বী? আমি তো অনেক আগেই তোমাকে বলেছি যে, আমি আমার আত্মসম্মান নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই। কারো অনুকম্পা, অনুগ্রহ বা দয়া আমার প্রয়োজন নেই। দয়া-দাক্ষিণ্য করে আর যাই হোক, অন্তত ভালোবাসা যে হয় না! অযথা আমাকে এই ব্যাপারে জোর করো না। তারচেয়ে এই তো বেশ আছি আমরা বন্ধু হয়ে।

পিউ-এর এই কথাগুলো পৃথ্বীর বুকের মাঝে হাতুড়ির মতো আঘাত করে। চোখের কোন ভিজে উঠলো পৃথ্বীর। মনে মনে বললো, "একদিন তুমি আমাকে বুঝতে পারবে পিউ। আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে এভাবে পাশ কাটিয়ে যাও কেন? একদিন তোমার এই ভুল ভাঙবে জানি! আমি সেইদিনের অপেক্ষায় রইলাম"!

পিউ পৃথ্বীর সহপাঠী। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। দু’জনেই তুখোড় বিতার্কিক। চমৎকার আবৃত্তির কারণে বন্ধুমহলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তথা টিএসসিতে সবার কাছেই ওরা খুব পরিচিত এবং জনপ্রিয়। 

পৃথ্বী খুবই সুদর্শন দেখতে। ক্যাডেট কলেজের খুব নামকরা ছাত্র ছিলো। ছিলো দুর্দান্ত খেলোয়াড়। ইনডোর অথবা আউটডোর, সব খেলাতেই চ্যাম্পিয়ন ছিলো সে। কবিতা লেখা, আবৃত্তি, গান গাওয়া সব কিছুতেই ওর জুড়ি মেলা ভার।

চমৎকার একটা নীল রং-এর ইয়ামাহা বাইক নিয়ে পৃথ্বী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, যে কোনো মেয়েই ওর দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখে! এ যে স্বপ্নের মানুষ! কিন্তু ও তো শুধু পিউকেই পছন্দ করে। মনে মনে ভালোবাসে আর অপেক্ষায় দিন গুণে যায়! আজ দু’বছর হলো পৃথ্বী ওর ভালোবাসার কথা পিউকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পিউ-এর একটাই কথা, ওর এই পঙ্গু জীবনের সঙ্গে কাউকে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করতে চায় না।

পিউ নিজে খুব ভালো একজন মেয়ে এবং দেখতেও নজরকাড়া সুন্দরী। টোল পড়া গালের হাসি দেখে যে কেউ প্রথম দেখাতেই ওর মতো মেয়েকে ভালোবাসতে পারে। ওর রেশমের মতো নরম ঘন দীঘল কালো চুলের মধ্যে সাঁতার কেটে যে কোন ছেলেই জীবন পার করে দিতে পারে। অসম্ভব বন্ধু বৎসল। চমৎকার গলার স্বরে আবৃত্তি করলে মনে হয় যেন, এই আবৃত্তি ওকেই কেবল মানায়। হাতের লেখা তো মুক্তার মতো। যে কোনো বিষয়ে বলতে ও লিখতে পারে অনর্গল। 

ছ’বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে পিউ-এর বাম পায়ের নীচের অংশ বোধহীন হয়ে গেছে, তাই দুটো ক্র‍্যাচ ওর নিত্যসঙ্গী! পৃথ্বী ওকে সবসময় বলে "যদি কখনো আমারো এমন হয়, তখন কি তুমি আমাকে একটু অনুকম্পা দেখাবে পিউ? আমি তোমার ভালোবাসার করুণা চাই"!

সেদিন ছিলো ওদের দুজনের দ্বৈত আবৃত্তির রিহার্সেলের শেষ দিন। মাত্র দু’দিন পরেই প্রথম বর্ষের নবীনবরণ। তাই আজকে রিহার্সেল না করলেই নয়। পিউ অপেক্ষায় আছে কিন্তু গত দুইদিন পৃথ্বীর দেখা নেই। কোথায় যে গেলো? বাসার ফোন ও নষ্ট। যাক আজকে আসুক তো! বকা খাবে।

কথা ছিলো সকাল দশটায় টিএসসিতে একসঙ্গে রিহার্সেলটা শেষ করতে হবে। পিউ-এর সারাদিন অপেক্ষায় কেটে গেল। বিকেল চারটা বেজে গেলো কিন্তু পৃথ্বী এখনো এসে পৌঁছায়নি। বিষয়টা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। এই ছেলে সবচেয়ে বেশি সময়ানুবর্তী, তাই ওর এই আচরণ কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিলো না। বিকেল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে খুব বিরক্ত হয়ে শাহান, পিয়াল আর বেবীর সঙ্গে চলে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে বের হচ্ছিলো।

বিকেল পাঁচটার কিছু আগে হঠাৎ করেই তিনটি ছেলে টিএসসির ক্যাফেতে এসে জানতে চাইলো "পিউ কার নাম? আমাদেরকে পৃথ্বী পাঠিয়েছে। আমরা পৃথ্বীর পাড়ার বন্ধু। আপনাকে পৃথ্বী একটু দেখতে চায়। এখনি আমাদের সাথে চলেন"। পিউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পিউ, শাহান, পিয়াল আর বেবিকে নিয়ে ওদের সাথে আসা মাইক্রোবাসটি সোজা শেরে বাংলা নগর পঙ্গু হাসপাতালের গেটে এসে থামলো। পথিমধ্যে পিউকে কোনো কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। কিন্তু ইশারায় বাকি তিন বন্ধু যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। পিউ ভেবেছে হয়তো পৃথ্বীর কোনো কঠিন অসুখ করেছে।

হাসপাতালের ৪০৫ নম্বর কেবিনে ঢুকে পিউ যা দেখতে পেলো সেটার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। পৃথ্বী লম্বা হয়ে বেডে শুয়ে। কোমর পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। দেখে কারো বোঝার উপায় নেই যে, দুর্ঘটনায় পৃথ্বী ডান পা হারিয়েছে। হাত ইশারায় পিউকে কাছে ডেকে আস্তে করে বললো, "তোমার ডান হাতটা আমার বাঁ'পাশের কাঁধে রেখে ডান হাতের ক্র‍্যাচটা আমায় দিবে? আমার বাঁ হাতটা না হয় তোমার ডান পাশের কাঁধকে ধরে আগলে রাখবে! আমরা সারাজীবন এভাবেই না হয় থাকবো একজন আরেকজনের ক্র‍্যাচ হয়ে"!

পিউর চোখে তখন বাঁধ ভাঙা অশ্রু। এখন আর ওদের দু’জনার এক হতে কোনো বাধাই রইলো না। নাহ! করুণা, অনুকম্পা বা দয়া দিয়ে নয়। ভালোবেসে একজন আরেকজনের পরিপূরক হয়ে থাকবে। ভরা বর্ষার সবটুকু বৃষ্টিকে চোখের জলে নিয়ে এসে পিউ কোন কথা বলতে পারলো না।

স্বপ্নের জীবন কেমন হতে পারে, কেউই হয়ত জানতো না। কিন্তু জীবন স্বপ্নের সঙ্গে মাঝে মাঝে এক হয়ে দশদিক আলো করে বলে, আমরা দু’জন দু’জনার। সে আলোর ঝলকে মন ব্যাকুল হয়ে চেপে রাখা কথাকে মুখে নিয়ে আসে, আমি তোমার সাথে থাকব, তুমিই আমার সব, তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না। এ জীবন শুধু নয়, যদি পরজনম থাকে, সে জনমেও তোমাকে ভালবেসে থাকতে চাই।

ক্রাচকে ছাড়িয়ে গেছে নির্ভরতা, 
বিস্মৃত করুণার অজুহাত।
চীরবসন্তের দিন এনে দিলো 
আস্থার স্পর্শের দুই জোড়া হাত।
পৃথিবীতে ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায় সকল যূগলে। 
ভালোবাসার চেয়ে বড় ক্রাচ আর নাই এই ভূগোলে।

(লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা)

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি