ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড এবং এক শিশু কন্যার গল্প

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৬:৫১, ৩ অক্টোবর ২০২০ | আপডেট: ১৮:৫৩, ৩ অক্টোবর ২০২০

সময়টা ১৯৯১ সাল। মধ্য ফেব্রুয়ারি। খালী পায়ে হিম শীতল হাঁটু পানিতে হেঁটে চলছি। শীতের রাতে চারটি পেট্রোলের এক বিশাল বহর নিয়ে যাচ্ছি এম্বুশে। মহালছড়ি জোন আর মাইনীমুখ জোনের মাঝামাঝি একটা জায়গায় রাতের আধাঁরেই বসতে হবে যার যার টার্গেট এলাকায়। সবার জঙ্গল বুট কাঁধের উপর ঝুলছে। জঙ্গল বুটের এই হঠাৎ কাঁধে সওয়ার হওয়ার কারণ- ওটা পায়ে পরে হাঁটলে মাটির উপর যে কলঙ্ক চিহ্ন রেখে যায়, তা সকালে পাহাড়ীদের চোখ এড়ায় না। জঙ্গল বুটের এই ট্রেডমার্ক আশেপাশে আমাদের অবস্থানের কথা সকলকে জানিয়ে দেবে। এম্বুশের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেলে লক্ষ্য অর্জন তো সম্ভব নয়ই, বরং ফেরার পথে কাউন্টার এম্বুশে পড়ে মার খাওয়ার অনেক নজির আছে।

পেট্রোল কমান্ডার ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক মেজর হান্নান শরীফের সঙ্গে আমরা তিন জন। মেজর লুৎফর, ক্যাপ্টেন ইকবাল ও আমি। দুই রাতের জন্য এম্বুশ অর্থাৎ একই জায়গায় নিশ্চল অজগরের মতো শুয়ে থাকতে হবে। দেড় কেজি চিড়া আর আধা পোয়া আখের গুড় আর এক মুঠো লবন নিয়ে বসতে হবে আটচল্লিশ ঘণ্টার এক ধ্যানে। লক্ষ্য- এ পথে যাতায়াতকারী শান্তি বাহিনীর কিলো কোম্পানির একটি দলকে ‘বক্স এম্বুশে’ ফেলা।

কাউন্টার ইনসারজেন্সী (সশস্ত্র বিদ্রোহ) অপারেশনে বক্স এম্বুশ একটি ভয়ংকর ধারণা। সংকীর্ণ ভ্যালিতে টার্গেট প্রবেশের পর এর দুই দিকের পলায়ন পথ রুদ্ধ করে শত্রুকে কচুকাটা করার নাম বক্স এম্বুশ। সফল বক্স এম্বুশে ফেলতে পারলে শত্রুপক্ষের শতভাগ নিধন নিশ্চিত করা যায়। বক্স এম্বুশের জন্য আমাদের নির্ধারিত স্থানের দুই পাশের টিলার উচ্চতা দেড়শ ফিটের মতো হবে। দুই পাশের টিলার মাঝের প্রায় সমতল ভূমির প্রস্থ গড়পড়তায় একশ গজ। রাত এগারোটায় বামে লংগদু থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রা ভোর রাতে এসে থামলো টার্গেট এলাকায়। স্থানটি জনবিরল, দুই পাশের টিলাগুলো ফসল শূন্য। জুমের ফসল তোলার পর এ জায়গাগুলোতে আর স্থানীয়রা আসে না। জুমের টিলাগুলোর স্থানে স্থানে এখনও কিছু পরিত্যক্ত মাচাং ঘর, মৃত ভুট্টার গাছ, ধানের শীষহীন মৃত কান্ড ও অনান্য লতাগুল্ম। লুকিয়ে থাকার জন্য মোটামুটি ভালো জায়গা। শুয়ে বসে থাকলে  নিচ দিয়ে চলাচলকারী কোন মানুষ উপরে কে আছে তা টের পাবে না।

প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভোরের আলো ফোটার আগে আমরা অবস্থান নিলাম। পাহাড়ের গোড়ায় এসে সবাই জঙ্গল বুট পরে নিলো। শীতের রাত বলেই বোধহয় কোন কাল নাগিনীর দেখা মেলেনি। সবাই অক্ষত। টিলার উপরে উঠে শুরু হলো শত্রুর আগমনের প্রহর গোনা। টানা দুই রাত এম্বুশ। শিকার শেষে অজগর যেমন লম্বা হয়ে নিশ্চল এক জায়গায় শুয়ে থাকে, আমরাও টিলার সরু পিঠের উপর লম্বালম্বি শুয়ে আছি। নিজেদের শব্দ যন্ত্র ‘Mute’ করা আছে। তাই কোন অপ্রয়োজনীয় শব্দও কেউ করছে না। বন্যাদূর্গত যেমন টিনের চালের উপর শুয়ে বসে চিড়াগুড়ের ওপর নির্ভর করে প্রহর গুণে, আমরাও তাই। জলত্যাগের জন্যও কারও স্থান ত্যাগের অনুমতি নেই। সবাই পাশ ফিরে পাহাড়ের ঢালে ঐ কম্মোটি করে। সারাদিন শুকনো চিড়া-গুড়ের উপর নির্ভর করে দিনটি পার করলাম। কোথাও কিলো কোম্পানির টিকিটির দেখাও মিললো না। তবে সারাক্ষণ কেটেছে এ আশংকায় যে- কেউ না আবার আমাদের অবস্থান দেখে ফেলে। কোন রকম কথা না বলে, কোন রকমের নড়াচড়া না করে ঠায় এক জায়গায় বসে থাকা এ আরেক রকম শারীরিক ও মানসিক কষ্ট।

বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে সাংকেতিক যোগাযোগ ছাড়া অপরাপর পেট্রোল কোথায় বসেছে, কি করছে- তা জানার কোন উপায় নেই। প্রথম রাতে পেট্রোল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ টিলার নীচে, আরেক ভাগ টিলার উপরে অবস্থান নিয়ে রাত পার করলাম। রাতে টিলার নীচে কিছু বুনো শূকরের উৎপাত ছাড়া নির্বিঘ্নেই কাটলো। দ্বিতীয় দিনে সবার মধ্যেই ‘কিছুই মিলবে না’ -এ রকম একটা গা ছাড়া মনোভাব এসে গেল। আর ঐ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শুকনো চিড়া-গুড়ের উপর চলা ভেতো বাঙ্গালির সামরিক শৃঙ্খলার উপর আঘাত হানতে লাগলো। কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে জুম ক্ষেত থেকে পেঁপে, শসা, মরিচ দিয়ে বিকল্প রেসিপি তৈরী করে ক্ষুধার শ্রাদ্ধ করছে। স্পষ্টতই ধৈর্যের শক্ত গেরোটা আস্তে আস্তে আলগা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এম্বুশে ধৈর্য যে কি অপরিহার্য উপাদান তা বোঝা গেছিলো আরও আধা বেলার পর। দুই রাত টিলার উপর পার করে তৃতীয় দিন সকালে এম্বুশ শেষ ঘোষণা পেয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। তবে ফেরার পথটা ইউ টার্ন হবে না। সামনে এগিয়ে ঘুর পথে যেতে হবে। একই রাস্তায় ফেরত যেতে গিয়ে কিছুদিন আগেই আমাদের একটা পেট্রোল শান্তি বাহিনীর গুলির মুখে পড়েছিলো।

সকাল সাড়ে আটটায় একটা স্কুলের দেখা পেয়ে আমাদের মেজর হান্নান রেস্ট এন্ড রিগ্রুপিং’র আদেশ দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রওনা হবো। স্কুলকে কেন্দ্র করে একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে শুরু হলো রান্নার আয়োজন। ইতিপূর্বে ভাগ করে দেওয়া সবার ব্যাক প্যাক থেকে বের হলো চাল, ডাল, মশলা, তৈল। ৭/৮ জনের একটি দল চলে গেল চিকেন হান্টিং-এ। চাল ডাল খিচুরির মধ্যে একটু চিকেন ফ্লেভার যেন একটি বেহেস্তী খাবার।

রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ গোসলও সেরে নিলো। তা দুপুর একটার মধ্যে রান্না-খাওয়া পর্ব শেষ করে ফেরার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে সবাই লাইন আপ হলো। ফিরতি যাত্রায় আমার পেট্রোল লিড করবে। মহালছড়ির এই অংশে শান্তি বাহিনী অত্যন্ত তৎপর। আমরা যে গোপনীয়তা ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে এসেছি- ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে এ খবর তাদের কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে। অতএব মুখোমুখি সংঘর্ষ বা অতর্কিত আক্রমনের সম্ভাবনা শতভাগ- এটা ধরে নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম।

আমি উপ-অধিনায়ককে শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণের আশংকাকে মিনিমাইজ করার জন্য ‘স্পেকুলেটিভ ফায়ার’ বা অনুমানমূলক গুলি চালানোর অনুমতি চাইলাম। অর্থাৎ আমার চলার পথে যেখানে যেখানে শত্রু লুকিয়ে থাকতে পারে বলে মনে হবে; সেটা হোক কোন টিলার বাঁক বা মোটা গাছের আড়াল বা কোন ঝোপঝাড়, আমি সেখানে এক থেকে দুই রাউন্ড ফায়ার করব। আমি শত্রুর ফায়ারে হতভম্ব না হয়ে শত্রুকেই আগে শঙ্কাগ্রস্ত করে পথ চলবো।

পুরো পেট্রোলকেই এই স্পেকুলেটিভ ফায়ারের কথা জানানো হলো। ১ বা ২ রাউন্ড সিংগেল ফায়ার। বাস্ট ফায়ার নয়। স্কুলের প্রাঙ্গণ ছেড়ে আমার পেট্রোল পথ চলা শুরু করলো ছড়ার ডান প্রান্ত ধরে। এই ছড়াটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সামনে মানে দক্ষিণে চলেছে। তো একটি ছড়াতেই বার বার পা ভেঁজাতে হয়। খুবই বিরক্তিকর। ভেজা জঙ্গল বুটের ভিতর ছপ্ ছপ্ পানি নিয়ে পাহাড়ে পথ হাঁটা সবচেয়ে কষ্টকর। ছড়ার প্রস্থ যদি লাফিয়ে পার হবার মতো না হয় তখনই মনটা চুপসে যায় ভেজা বেড়ালের মত। ছড়ার ঠাণ্ডা পানিতে মোজাসহ বুটটি যখন ডুবে যায় তার শীতল অনুভূতি একেবারে মস্তকে গিয়ে আঘাত করে। তখন শুরু হয় কোন কাঠ-বাঁশের খোঁজ, যার উপর পা রেখে পায়ের উষ্ণতাটুকু ধরে রাখা যায়।

আমার পেট্রোল বাডি (সঙ্গী) সিপাহি আলীম, যে কিনা ইউনিটে ধূতরা আলীম নামে পরিচিত, তার বিশাল শরীরটা আমাকে ছড়ার ওপর পারে ফেরী করার জন্য প্রস্তুত থাকতো। আলীম রিকোয়েলেস রাইফেল (আর আর) ডিটাচমেন্টের ক্রু। আমার ১২২ পাউন্ডের শরীরটা ওর কাছে আর আর-এর ব্যারেল ছাড়া আর কিছুই না। প্রতিবার ছড়ার প্রান্তে এসে থামলেই পিছন থেকে আলীম এসে ঝুকে পরতো সামনে, রো রো ফেরীর মতো আমি ওর পিঠে চেপে বসতেই ও এক পলকায় আমাকে ওপারে নামিয়ে দিতো। তা এক ধরনের ছেলে মানুষী করতে করতেই যাত্রা শুরু। মাত্র শুরু হওয়া যাত্রায় সবগুলো পেট্রোল তখনও স্কুল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেনি। আমিও সর্ব সাকুল্যে আমার অনুমানে ২/৩ শত গজ এগিয়েছি। তা এতো কাছে তো আর শান্তিবাহিনী বসে নেই। তাই আলীমকে রো রো ফেরী বানিয়ে আমার সুখ বিলাস চলছিলো।

এই সুখ বিলাসের জন্য স্কাউট আমার দৃষ্টির আড়ালে পড়ে যায়। দূরত্ব তৈরী হয় হাত পঞ্চাশের। এখনও ছড়ার পাড়ের পাহাড়ী ঘরের মাঝের আঁকা বাঁকা পথ ধরেই চলছি। তখনো মনের মধ্যে ‘Danger Instinct’ বা বিপদ অনুধাবনের সফটওয়ার কাজ শুরু করেনি। মনের মধ্যে অজান্তে কাজ করছে ‘আরে এতো কাছে কি আর শান্তিবাহিনী আছে!’ সদ্য খিচুড়ি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পথ চলতে থাকা স্কাউটের মনেও হয়তো সে রকম ভাবনা কাজ করছিল। শেষবারের মতো রো রো ফেরীর পিঠ থেকে নামতেই, ঠাস ঠাস দুটো গুলির আওয়াজ পেলাম। গা করলাম না। ভাবলাম ওটা সতর্কতামূলক ফায়ার হবে হয়তো। ন্যানো সেকেন্ড পার হতেই লম্বা বাস্ট ফায়ার। এবার এন্টেনা সজাগ হয়ে গেল। না এটা সতর্কতামূলক ফায়ার নয়। দৌড়ে সামনে যেতেই দেখলাম আমার সামনে সরু এক লাইনে তিনজন সৈনিক শোয়া। ওরা সামনের ছোট টিলার দিকে ফায়ার করছে। 

বাঁশের ফালি দিয়ে দুই পাশ থেকে ঘিরে থাকা পথ। ছড়ার পাশের খোলা জায়গাটি নানা রকম সবজীর বাগান। শূকর/ ছাগলের হাত থেকে বাঁচাতে বাঁশের ঘের দেওয়া। এক দৌড়ে ঐ টিলায় চার্জ করে উঠার উপায় নেই। বাঁশের ঘেরগুলোকে হার্ডেলসের মতো অনেকবার পার হতে হবে। আমি আর আলীম বাম দিক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রথম স্কাউটের প্রায় সমান্তরালে আসলে ও ছড়ার গভীরে ইঙ্গিত করে জানালো- দুজন ছড়ার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রথম স্কাউট একটা গ্রেনেড ছড়ার মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। দূর্ভাগ্য যে ওটা বিস্ফোরিত হলো না। সামনের টিলার উপর একটা ঘরের আড়াল থেকে শান্তিবাহিনীর দুই জন এবং বাম পাশের আরেকটি উঁচু টিলা থেকে ফায়ার দিচ্ছিলো। ওরা আসলে ফায়ার করছিলো ছড়ার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া দুজনকে কাভার করার জন্য। আমাদের ফায়ারে টিলার উপরে থাকা ঘরটি ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিলো- তা আমরা বুঝতে পারছিলাম। স্কাউটসহ আমরা ৫ জন চার্জ করে দ্রুত ঐ টিলায় চড়াও হতে পারছিলাম না, আমাদের নিজস্ব টহল দলের পিছন থেকে করা গুলির কারণে। পিছনে থাকা সদস্যরা না দেখেই পেনিকড হয়ে বেপরোয়া ফায়ার করছিলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে।

বেশ কিছুক্ষণ চিৎকার করে ডাকাডাকির পর মেজর হান্নান স্যারের সাথে যোগাযোগ হয়। তারা ফায়ার বন্ধ করার পর আমরা যার যার আড় ভেঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়া ডিঙ্গিয়ে সামনে এগুতে থাকি। পাচঁটি এসএমজি’র (সাব-মেশিনগান) মুখে কি আর ওরা থাকে। টিলার ঘর বরাবর আসতেই দেখি সবুজ ইউনিফর্মধারী দুজন দৌড়ে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে পালাচ্ছে। ইতোমধ্যে শত গজ দূরুত্ব অর্জন করে ফেলেছে। হাঁপরের মতো শ্বাস নিতে থাকা বুকের ওঠানামার মধ্যে ওদের দিকে একটা এইম ফায়ার নেওয়ার চেষ্টা করলাম। লক্ষ্যভেদ হলো না। ‘এক শত্রু এক বুলেট’ সেনাবাহিনীর ট্রেনিং-এর মূলমন্ত্র অর্জন করতে পারলাম না। কপাল গুণে বেচেঁ গেল।

হ্যাঁ, কপালগুণেই হোক আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় হোক বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেল প্রায় দশ মাস বয়সের এক শিশু। ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে পলায়নরত সবুজ ইউনিফরমধারীর পিছু নিলো আমাদের কয়েকজন। আমার হাঁটুতে বাঁশের খোঁচা লেগে বেশ একটা ক্ষত হয়। আমি টিলার উপর একটা ঘরের দিকে এগিয়ে যাই একটা শিশুর কান্না শুনে। এ ঘরের ঢালুতে একটা গাছের কাটা গোড়ার আড়াল নিয়ে ওরা আমাদের উপর ফায়ার করছিলো। আমাদের পাল্টা ফায়ারে ঘরের বেড়া, বাঁশের খুটি, বারান্দায় রাখা তৈজসপত্র সর্বত্র গুলির ছাপ স্পষ্ট। এ ঘরেরই বারান্দায় একটা দোলনায় চিৎকার করে কেঁদে চলেছে ওই শিশুটি। কপালে তার কাজলের ফোঁটা। কতক্ষণ ধরে সে কাঁদছিল- তা সংঘাতের উন্মাদনায় আমাদের কারও নজরে আসেনি। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।

আমি শিশুটিকে কোলে তুলে নেই। নাদুসনুদুস এক কন্যা শিশু। কিছুক্ষণ পিঠ চাপড়ে দিলে ওর ভয় আর অস্থিরতা কেটে যায়। একটা গোঙানীর মতো শব্দ করতে করতে নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত চুসতে থাকে ও। মনে হলো- ও ভীষণ তৃষ্ণাকাতর। তা ওর মা কই?  এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখি- এ টিলার উপর যে কয়টা বাড়ি আছে তার একটিতেও কেউ উপস্থিত নেই। প্রথম গুলির শব্দে সবাই যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। আমাদের পিছনে থাকা সব টহল দল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো খোঁজা-খুঁজির মিশনে। অবশেষে পাওয়া গেল ঘরের দাওয়ায় ঝুলানো দোলনায় একলা ঘুম পাড়িয়ে রাখা শিশু কন্যাটির মাকে। পাশের ঝাড় জঙ্গলে গিয়েছিল শাক তুলতে। উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো হাতে পায়ে কাদা মাখা অবস্থায়। কাছে এসে এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে একরকম কেড়েই নিলো তার হৃদ-স্পন্দনকে।

তারপর আমাদের সকলের উপস্থিতিকে কোন আমলে না নিয়ে তার ঘরের দাওয়ায় বসেই স্তন্যপান করাতে লাগলো। নিমিষে যেন থেমে গেল পৃথিবীর সব সংঘাত, মাতৃদুধের অমিয় ধারায় সিক্ত হলো শিশুর তৃষাকাতর মুখ। আমাদের খোঁজা খুঁজিতে মিললো শান্তিবাহিনীর ফেলে যাওয়া দুটি প্যাক জিরো এইট। তার ভিতর ছোট অস্ত্র, গুলি, ঔষধ, ছোটখাটো অস্ত্রপাচার উপযোগী নানাবিধ দ্রব্যাদি। স্কাউটের কাছ থেকে জানা গেল- প্রথম সংঘাতের মুহূর্তটি: ছড়াটি শেষবার অতিক্রম করে স্কাউট দুজন এগিয়ে যায়। আমি তখনও রো রো ফেরীতে। এমন সময় প্রথম স্কাউট ছড়ার বিপরীত প্রান্তের টিলা বেয়ে দু্ই জন শান্তিবাহিনীর সদস্যকে নিচে নামতে দেখে। ও প্রথমেই থতমত খেয়ে যায়, গুলি করবে নাকি হ্যান্ডস আপ করাবে- এই দোটানায় পড়ে মুহূর্ত দেরি করে ফেলে। তারই জেরে প্রথম দুজন ছড়ার মধ্যে ঝাঁপিয়ে আত্মরক্ষার সুযোগ পায়। আর ওর নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড বিস্ফোরিত না হওয়া তো আরও মিরাকল।

এরপর একের পর এক মিরাকল ঘটে। প্রথম স্কাউট তার শোয়া অবস্থায় পোচ থেকে তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি বের করতে পারেনি। কারণ পোচের মুখটি এমনভাবে তার দিয়ে বন্ধ করাছিল যে সে উপুর হয়ে ফায়ার করতে করতে তার শরীরের নিচে চাপা পড়া পোচ থেকে গ্রেনেড বের করার জন্য টানাটানি করতে করতে শত্রু নিধনের মোক্ষম ক্ষণটি হারিয়ে ফেলে। ইতিপূর্বে অন্য এক অপারেশনে তার একটি গ্রেনেড পানিতে পড়ে হারিয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে পোচের মুখ তার দিয়ে পেঁচিয়েছিল।

স্কাউট নজরুলের বোকামিতে সাক্ষাত বেঁচে যায় ওরা। সবই বিধাতার লিখন। বিধাতার কৃপার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ঐ দশ মাসের কন্যা শিশু। আমাদের নিক্ষিপ্ত এতো গুলির একটিও ওর গায়ে লাগেনি। বিধাতা বোধহয় আমাদেরও কৃপা করেছেন ঐ শিশু হত্যার কারণ না হওয়ার দায় মুক্তি দিয়ে।

আজ কন্যা দিবসে (গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০) অনেকেই নিজ কন্যার ছবিসহ নানা আনন্দঘন মুহূর্তের ছবি পোস্ট করছেন সামাজক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর কোনও কন্যা না থাকায় স্মৃতির ভেলায় ভর করে সেই কন্যা শিশুর কথাই মনে করছি আমি। আজ না জানি সে কত বড় হয়েছে! প্রায় ত্রিশ বয়স হবে তার। সেও হয়তো মা হয়েছে। তবে তার হয়তো মনে নেই, সে দিন আমাদের বেপরোয়া গুলির মাঝে আল্লাহ তাকে কিভাবে রক্ষা করেছেন। আসলে আল্লাহ যাকে রক্ষা করতে চান, মৃত্যু তাকে গ্রাস করতে পারে না। যাদের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দুই দিন পাহাড়ে ধ্যানমগ্ন ছিলাম, তারাই কিনা হাতের মুঠোর ভিতর এসেও বেঁচে ফিরেছে সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। 

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি