ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

আজ বিদ্যাসাগরের শিক্ষা সংস্কার বড় প্রয়োজন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:০২, ৩ অক্টোবর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষা সংস্কারক। বিধবা বিবাহ প্রচলন কিংবা বাল্যবিবাহ রোধে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা যতটা জ্ঞাত, শিক্ষা সংস্কারে তাঁর অবদান অনেক সময়েই ততটা পরিচিতি লাভ করে নি। আসলে, এ দেশে আধুনিক সমাজ নির্মাণে রাজা রামমোহন রায়ের যে ভূমিকা ছিল, ঠিক একইভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে বিদ্যাসাগরকে পথিকৃৎ বলা চলে।

বিদ্যাসাগরের শিক্ষা সংস্কারকে তিনটি ভাগ করা চলে। এক, পাঠ্যপুস্তকের আধুনিকীকরণ ও সময়োপযোগী করা। দুই, শিক্ষা কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষতা সুনিশ্চিত করা এবং তিন- শিক্ষা, বিশেষত: নারী শিক্ষার প্রসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিস্তার।

পাঠ্যপুস্তকের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় কথা হলো যে- বিদ্যাসাগর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলাভাষার অন্তর্নিহিত শক্তিতে ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস এবং সে বিশ্বাসকেই সামনে রেখে তিনি বাংলাভাষাকে সময়োপোযোগী করতে চেয়েছিলেন।

বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের জটিল নিয়ম-কানুন থেকে মুক্ত করে আধুনিকীকরণ করার জন্যে তিনি প্রয়াসী হয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত টোল পন্ডিতেরা জিম্মি করে রেখেছিল। সেই জটাজাল থেকে মুক্ত করে তিনি বাংলাকে একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ভাষায় রূপান্তরিত করেন। তাঁর রচিত ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’ বিদ্যাসাগরের এ প্রচেষ্টার স্বাক্ষর বহন করে।

একইভাবে বাংলা লিপির সংস্কারে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘বর্ণপরিচয়’। এ বইয়ে যে লিপিসংস্কার তিনি করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে সেটাই বাংলা লিপির আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। ঐ বইটি সার্ধবছর পরে এখনও সমান জনপ্রিয় এবং আজ পর্যন্ত এই লিপিই বাংলায় প্রচলিত। 

দ্বিতীয়ত: শিক্ষাকে তিনি ধর্মের কূটজাল থেকে মুক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানসম্মত করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর হিন্দুশাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। কিন্তু তবু তিনি শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ধর্মকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি। 

সংস্কৃত কলেজ শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পরে তিনি কলেজের দ্বার শূদ্রদের জন্যেও খুলে দিলেন। ‘বেদান্ত’ ও ‘সাংখ্যকে’’ ভ্রান্তদর্শন বলে অভিহিত করার মতো সাহস তাঁর ছিল। অষ্টমী ও প্রতিপদকে বাদ দিয়ে রোববার সাপ্তাহিক ছুটি শুরু করাও তাঁর অবদান।
 
শিক্ষার ব্যাপারে তিনি সব সময় ছিলেন সংস্কারকের ভূমিকায়। একটি আধুনিক মানসিকতা নিয়ে তিনি শিক্ষা কাঠামোকে ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থি ভূমির ওপরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় শিক্ষার খোলস থেকে মুক্ত করে পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে তিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। 

বিদ্যাসাগরের চিন্তাধারা এক উদার ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদর্শের সূচনা ঘটায়। তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকগুলোও তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চেতনার উজ্জ্বল নিদর্শন। চিন্তা-চেতনায় বিদ্যাসাগর ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। তাই বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রবর্তনেও তিনি ছিলেন বিশেষভাবে আগ্রহী। তাঁর রচনা ও কাজে তাঁর বিজ্ঞান প্রীতির নিদর্শন পরিস্ফুট। নানান রকমের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আবিষ্কারে তাঁর পরম উৎসাহ ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে ৪০৮টি শ্লোকবিশিষ্ট তাঁর ‘ভূগোল খগোল বর্ণনম’ গ্রন্থটির প্রকাশও বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান-প্রীতি ও জ্ঞানের নিদর্শন।

তৃতীয়ত: বিদ্যাসাগর সব সময়েই চাইতেন যে- শিক্ষার বিপুল বিস্তার ঘটুক এবং বাংলার প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠুক। তাই গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন উদ্যোগী পুরুষ। দরিদ্র ছাত্রেরা যাতে বিনা বেতনে পড়তে পারে, সে জন্যে নানান জায়গায় স্থাপন করলেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। উচ্চ শিক্ষার্থে স্থপিত হলো মহাবিদ্যালয়। মূল উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষা যাতে শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত সমাজেই সীমাবদ্ধ না থাকে, তার সুফল যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছেও পৌঁছোয়।

তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে- উচ্চমানের শিক্ষা শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের একচেটিয়া ব্যাপার নয়, শুধুমাত্র ভারতীয় শিক্ষকদের দ্বারাও মানসম্পন্ন শিক্ষা সম্ভব। ১৯৭২ সালে তাঁর স্থপিত মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট এর বড় প্রমাণ। যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ।

শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের অন্যতম কাজ হচ্ছে- নারী শিক্ষার বিস্তার। তিনি বিশ্বাস করতেন যে- নারীদের উন্নতি ভিন্ন দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন সূদূর পরাহত। তাঁরই উদ্যোগেই স্থাপিত হয় কলকাতা হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়- ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে এটিই বেথুন স্কুল বলে পরিচিত হয়।

গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রী শিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। প্রায় ১ হাজার ৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করত। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টি।

দু’শো বছর বাদেও বিদ্যাসাগরের শিক্ষা-চিন্তা ও সংস্কার আজকের বাংলাদেশের জন্যে প্রাসঙ্গিক। বাংলাভাষাকে নানান ভাষাগত জটিলতা থেকে মুক্ত করে একে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বেগবান করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, বিজ্ঞান এ সমাজবিজ্ঞানের নানান বিষয়ে আরও বাংলা প্রতিশব্দ ও প্রতিভাষা বার করা যেতে পারে। বাক্য গঠন ও বিন্যাসের ক্ষেত্রে আরও বিজ্ঞানমনস্ক প্রচেষ্টা থাকা দরকার। অন্যান্য ভাষার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে এ ভাষার পুষ্টি বিধান করা যেতে পারে। 

তবে মনে রাখতে হবে যে- অতীতের আরবী হরফে বাংলা লেখার অপপ্রয়াসের ভূত যেন আমাদের কাঁধে আবার না চাপে, কিংবা সহজীকরণের নামে বাংলা ভাষার ধর্ষণ যেন না চলে।

আজ বাংলাদেশে ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান- বিত্তবান্ধব শিক্ষা, সাধারণ মানুষের জন্যে শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা। শিক্ষাকে বিত্ত-ভিত্তি থেকে মুক্ত করতে হবে। মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষারও। পাঠ্যক্রমে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সুনিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার মান এ তিন ব্যবস্থায় তিন রকমের। মানের উন্নতিকরণ ও সমতা একান্ত প্রয়োজন। মোদ্দা কথা হচ্ছে- এ ত্রিধারার বিলুপ্তি ঘটিয়ে একক ও অভিন্ন গণমুখী শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।
 
নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় যতটা উন্নতি হয়েছে, উচ্চস্তরের শিক্ষায় সেটা ঘটেনি। প্রাথমিক শিক্ষাতেও সামাজিক বিধান ও নিরাপত্তার অভাবে বহু মেয়ে ঝরে পড়ে, পড়ছে। বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ এখনও সীমিত। নারী শিক্ষার বিস্তার ভিন্ন কোন জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

আজকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নানান অংশে বিজ্ঞানমনস্কতার বড় অভাব। নানান গোঁড়ামি সেখানে জেঁকে বসেছে। ফলে, ‘মুক্ত বুদ্ধি’ ও ‘মুক্ত চিন্তার’ অবকাশ বড় কম। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সব কবপমন্ডুকতার অবসান দরকার।

আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষা সংস্কারের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আমাদের বড় প্রয়োজন। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আমরা যাতে তাঁর শিক্ষা-ভাবনার মূল বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষা কাঠামো ও ব্যবস্থায় তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে পারি। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবমুক্তির বহু উপকরণ সেখানেই নিহিত।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি