ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

কেউ যেন একা না থাকে...

ফখরুল আবেদীন মিলন

প্রকাশিত : ২৩:৩২, ১২ অক্টোবর ২০২০

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

নিজ স্বামীর সঙ্গে আমার দূর-সম্পর্কের এক খালার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বিয়ের ৩-৪ বছর পরেই। এর পরের ৪০ বছর খালা একাই থাকতেন দুইজন গৃহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে। খালার সঙ্গে সঙ্গে সেই দুজনও বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। খালুর জন্য ছিল খালার অপার ভালবাসা। গত বছরের শুরুতে যখন খালা মারা যান, তখনও খালা বিশ্বাস করতেন- খালুকে তার পরিবারের লোকজন জোর জবরদস্তি করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়েছেন। সেই বিশ্বাস নিয়েই খালা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যান্সার হয়েছিল তার।

সুস্থতা থেকে অসুস্থতা পর্যন্ত তার একটাই টেনশন ছিল- উনি অসুস্থ হলে উনাকে কে দেখবে? সত্যি বলতে কি, উনি উনার পুরো যুদ্ধটা একাই করেছিলেন। মনের যত কথা ছিল, সব মনের মধ্যে নিয়েই চলে গেলেন..।

আমার এক বন্ধু দম্পতি ঝুমুর আর আসিফের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। মাঝে পড়ে গেল তাদের ৮ বছরের মেয়েটা। মেয়েটা ঝুমুরের সাথেই থাকে। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। সে নিজেও খানিকটা অসুস্থ। বিপদে পড়ে যায় যখন অসুস্থতা বেড়ে যায়। যে কারণে মেয়েকে রেখে আসতে হয় মায়ের বাড়ি।

এসব পারিবারিক এবং প্রফেশনাল হ্যাজার্ড-এর চাইতে শতগুণ বড় হয়ে গেল তাকে নিয়ে অনলাইনে করা নোংরামি! দুদিন পর পরই তার ছবি কে বা কারা পাত্র-পাত্রী খোঁজার পেজে দিয়ে দেয়। শুধু কি ছবি দেয়? তার ফোন নাম্বারটাও দিয়ে দেয়। সকাল-সন্ধ্যা-রাতে তাকে হয়রানি করা হয়, আজও..!

ফেসবুকে পরিচয় হওয়া ডালিয়া মারা গেল খুব অল্প বয়সেই। শ্বাসকষ্ট ছিল তার। বাবা-মাকে হারিয়ে একা একাই থাকত ঢাকার একটা ভাড়া করা বাসায়। বিয়ে করেনি ডালিয়া। আসলে কেউ চেষ্টাও করেনি তার জন্য। আমাদের সমাজের প্রচলিত অর্থে তেমন সুন্দরী তাকে বলা হতো না বলেই হয়ত নিজে থেকেও আর চেষ্টা করেনি সে।

ডালিয়ার জন্য আমার খুব মন খারাপ হয়। গভীর রাতে যখন তার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তখন হয়ত ব্যাগের মধ্যে থাকা ইনহেলারটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক চাপ দিয়েও এক ফোটা ওষুধ সে বের করতে পারেনি। ডেকে যে কাউকে বলবে ওষুধ আনার কথা, সেটা বলার মতো মানুষও তার পাশে ছিল না। মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিল তার। এক গভীর ঘুমে চলে গেল ডালিয়া। দু’দিন পর বাসার দরজা ভেংগে বের করা হয় ডালিয়ার লাশ!

পাপিয়া নামে আমার এক বোনের স্বামী যখন মারা যায়, তখন তার বয়স ২৮-৩০ বছর হবে। প্রেমের বিয়ে ছিল তাদের। পাপিয়া ঠিক করল ৪ বছরের ছেলেকে নিয়ে বাবা-মা-বড়ভাই-এর সঙ্গে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে। মফস্বল শহরের একটা স্কুলের টিচার হিসেবে মোটামুটিভাবে দিন চলে যাচ্ছিল পাপিয়া আর তার ছেলের। বিপদ হলো তখন, যখন দেখা গেল তার ছেলের চোখে সমস্যা হলো। ছেলের ট্রিটমেন্টের জন্য বাড়ি আর ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে করতে টাকা-পয়সা সব শেষ হয়ে গেল। আরো বড় বিপদ নেমে এলো, যখন দুই বছরের মধ্যে একে একে বাবা-মা আর বড় ভাইটা মারা গেল!

পাপিয়া এখন চোখে অন্ধকার দেখে। দেখতে দেখতে বয়স যে কখন ৪০ ছুঁয়েছে তা সে টেরও পায়নি।
মাঝে মাঝে ভাবি, আমার খালা যদি আরেকটা বিয়ে করতেন! তবে কি উনি ভুল করতেন? না, উনি ভুল করতেন না। ৪০টা বছর একা থাকার যে কী কষ্ট, অন্তত সেটা তাকে ভোগ করতে হতো না। খুব অসুস্থতার সময় বেল বাঁজিয়ে গৃহকর্মীকে ডেকে ওষুধ এনে দিতে বলতে হতো না। হায়, তার মাথায় হাত রেখে কেউ কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি, "এখন কেমন লাগছে তোমার"! না তার স্বামী, না তার ছেলে মেয়ে। কি ভয়াবহ একা একটা জীবন পার করে দিলেন উনি।

এবার উল্টো একটা গল্প করি। বয়স ২০ পেরুতে না পেরুতেই সুমি ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলল তার চেয়ে ৮ বছরের বড় মেহেদিকে। মেহেদি ছিল আমার কলেজের বন্ধু। ১৮ বছরের সুখী জীবনে ঝড় নেমে এলো যখন মেহেদি অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। সুমির সকল চেষ্টা বিফল হলো। পরিণতিতে তাদের ছাড়াছাড়ি। সুমি তার ১৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে শুরু করল ভিন্ন একটা যুদ্ধ। 

ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার সাজানো গোছানো বাসা ছেড়ে নিজের আর মেয়ের জন্য কিছু কাপড় নিয়ে বের হয়ে এলো সুমি। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করল রায়েরবাজারে। স্কুলের টিচার হয়ে কাজ করার পাশাপাশি বুটিকের কাজও শুরু করল সে। ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটা নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করল। চলল মা-মেয়ের যুদ্ধ।

এভাবেই কেটে গেল ৩-৪ বছর। কিছুদিন আগে সুমি বিয়ে করল এক আমেরিকা প্রবাসীকে। পারিবারিভাবেই বিয়েটা হলো। সুমি তার মেয়েসহ নতুন জীবন শুরু করে দিয়েছে প্রবাসে। আমি প্রায়ই তাদের তিনজনের হাসি খুশি ছবি দেখি ফেসবুকে। আমার অনেক ভাল লাগে। আমি মন থেকে দোয়া করি এই তিন জনের জন্য।

আর আমার সেই বন্ধু মেহেদি? সুমির আগেই সে আবার বিয়ে করেছে। সে ভাবতেও পারে নাই সুমি সত্যি সত্যি আবার বিয়ে করবে। সে বিয়ে করে ফেললেও চেয়েছিল সুমি একা থাকুক আর তার জন্য আজীবন বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিক!

আমার বন্ধু মাহি তার স্ত্রীকে হারিয়েছে প্রায় ৮ বছর হলো। একমাত্র ছেলে আর মাকে নিয়ে আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু আমার জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুকে বলি, আবার নতুন করে সংসার করবে কিনা। সাড়া দেয় না সে। প্রয়াত স্ত্রীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা তাকে অন্য কিছু ভাবতেই দেয় না। বন্ধু আমার ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতের উপরই ছেড়ে দিয়েছে।

এমন কতো জন আপনার আমার আশেপাশে আছে। একা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। হয়ত এটাই তাদের পছন্দ! একা থাকতে চাওয়াটা যেমন একজনের অধিকার। ঠিক তেমনি নতুন করে জীবন শুরু করাটাও তাদের অধিকার। আপনার আমার কারো অধিকার নাই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর।

তবে এটা আমাদের মানতেই হবে যে, আমাদের যত বয়স হবে, আমরা ততোই একা হয়ে যাব। বাবা-মা, ভাই-বোন, মামা, চাচা, বন্ধু-বান্ধব সবাই একে একে চলে যাবে। নিজে মরে গেলে তো হিসাব সেখানেই শেষ। আর যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে একা আপনাকে আমাকে থাকতেই হবে।

তবে, আমি একা থাকতে ভয় পাই। আমি বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরেই আমার স্ত্রীকে দেখতে চাই। পাশের রুমের দরজা খুলে মেয়েকে দেখতে চাই। রোজ সকালে পা টিপে টিপে মায়ের রুমে গিয়ে ঘুমন্ত মায়ের বুকের ওঠানামা দেখতে চাই। দরজা খুলেই বাইরে দাঁড়ানো হাতে বাক্স ভর্তি খাবার হাতে আমার বোনদের দেখতে চাই।

আমি চাই, কেউ যেন একা না থাকে। অন্তত ঝগড়া করার জন্যে হলেও পাশে কেউ থাকুক।

লেখক- সাংবাদিক

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি