বেপরোয়া হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাত
প্রকাশিত : ১৯:৪৯, ১৩ নভেম্বর ২০২০
গত কয়েক মাস ধরে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আমরা শুধু স্বাস্থ্য সেবার দুঃসংবাদ পাচ্ছি। একের পর এক। এসব খবরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভায়াবহ ছিল মাইক্রোবাসের ড্রাইভারদের সঙ্গে কারসাজি করে ইচ্ছাকৃতভাবে পথচারীদের আহত করে তাদের আবার হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করা। এ কাজের বিনিময়ে সেই হাসপাতাল থেকে কমিশন পাওয়া। একেবারে সম্প্রতি দেখলাম আরেক ভয়াবহ খবর। চিকিৎসার নামে ৫/৭ জন মিলে রোগীকে মেরে ফেলা। মরেই গেল তরুণ পুলিশ অফিসার এএসপি আনিসুল।
বছর ত্রিশেক আগের কথা বলছি যখন আজকের বেসরকারী হাসপাতালগুলো ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ক্লিনিক থেকে হাসপাতাল হয়ে উঠছিল। সে সময়ে প্রায় সকলেই সরকারী হাসপাতালগুলো থেকে চিকিৎসা সেবা নিতেন। সামান্য কিছু পরিবার তখন বেসরকারী সেবা নিতে শুরু করেছে। সেই তখনই শুনতাম, ডাক্তারেরা অহেতুক টেস্ট করিয়ে রোগীদের খরচ বাড়িয়ে দিয়ে ক্লিনিকের আয় বাড়ায়। আর তার বিনিময়ে তারা ক্লিনিক থেকে কমিশন পায়। ডাক্তারগণ একদিকে সরকারের কাছ থেকে বেতন পান, রোগীদের কাছ থেকে ফিস পান, আরেক দিকে ঔষধ কোম্পানি, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের কাছ থেকে কমিশন পান, বেসরকারী হাসপাতালে অপারেশন করে অনেক অনেক টাকা পান। তাদের অনেক অনেক টাকা।
১৯৮০ দশকে ডাক্তারদের বাসায় কোম্পানির লোকেরা বিভিন্ন রকম প্রেসক্রিপশন লেখার স্লিপ প্যাড আর ছোট ছোট পেপার ওয়েট জাতীয় জিনিসপত্র দিয়ে যেত। এখন ডাক্তারগণ ঔষধ প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে শুধু কমিশনই পান না তাদের বাসার বাজার থেকে শুরু করে, আসবাবপত্র, এসি, টেলিভিশিন – কোন কিছুই না-কি এখন আর নামকরা ডাক্তারদের কেনা লাগে না। বড় ডাক্তারদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ বহন করে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো।
বিগত শতাব্দীর ৮০’র দশকে পত্রিকা, টেলিভিশনসহ সকল গণমাধ্যমে ঔষধের বিজ্ঞাপণ বন্ধ করা হয়েছিল কোম্পানিগুলোর মধ্যে অহেতুক প্রতিযোগিতার প্রতিষেধক হিসেবে। যাতে তাদের উৎপাদন এবং বিপণন খরচ কম থাকে – মানুষ কম দামে ঔষধ কিনতে পারে। একই উদ্দেশ্যে ঔষধের দামও নির্ধারণ করে দেয়ার আইন করা হয়েছে। গণমাধ্যমে ঔষধের বিজ্ঞাপণ না থাকলে কি হবে, ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়। প্রতিটি হাসপাতালের সামনে তাদের মোটর সাইকেলের বিশাল জটলা। একেকজন বড় ডাক্তারের চেম্বারের সামনে আমি ৮/১০ জন পর্যন্ত বিক্রয় প্রতিনিধিকে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এরা ডাক্তারদের উপঢৌকন দেয়, ক্যাশ দেয়। বিনিময়ে তাঁরা রোগীদের চিকিৎসাপত্রে ঐসব কোম্পানির ঔষধ লিখে দেয়। বিজ্ঞাপণের জন্য যা খরচ হতে পারত তা তারা ডাক্তারদের পেছনে খরচ করে। ঔষধের উৎপাদন খরচ কমেনি, বেড়েছে। রোগীদের চিকিৎসা খরচ দিন দিন বেড়েই চলছে।
ঔষধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আইন করে কর্তাদের হাতে দেয়া হয়েছিল যাতে ঔষধ কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে না পারে। সে আইন এখন একদল সরকারী কর্তার ব্যাক্তিগত লাইসেন্সে পরিণত হয়েছে। ঔষধের দাম কত হবে তা এখন নির্ভর করে কোম্পানি কত টাকা ঘুষ হিসেবে খরচ করবে তার উপর। ওষুধের দাম যত বেশি হবে কর্তাদের ঘুসের পরিমাণ আর কোম্পানিদের লাভের পরিমাণ তত বেশি হবে। ঔষধের দাম নিয়ন্ত্রণের আইন জনগণের জন্য বুমেরাং হয়েছে। এই আইনের জন্য নতুন প্রতিশ্রুতিশীল কোম্পানিগুলো দাঁড়াতে পারছে না। কর্তারা বড় বড় কোম্পানির মোটা ঘুসে রক্ষকে পরিণত হয়ে বাচ্চা আর ছোট কোম্পানিদের ভক্ষণ করে থাকেন। চলছে মাৎস্যায়ন।
বেশ কয়েক বছর আগে একজন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড় হয়ে কাছেই একটা ফার্মেসিতে ঢুকেছিলাম ঔষধগুলো কেনার জন্য। ঔষধ কেনা শেষ করা মাত্র একজন কোন কথা না বলে আমার হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই অপ্রস্তুত আমি তার হাত থেকে সেটা আবার ফিরিয়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম কে তিনি? আমার হাত থেকে কেনই বা তিনি প্রেসক্রিপশনটা কেড়ে নিলেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে সেই ব্যাক্তি জানিয়েছিলেন যে তিনি একটা ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি। ডাক্তার সাহেব তার কোম্পানির ঔষধ লিখেছেন কি-না তা দেখার জন্য তিনি আমার প্রেসক্রিপশনটা নিয়েছেন। আমি অবাক হলেও তিনি অবাক ছিলেন না। তিনি প্রতিদিন এই কাজ করতেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। অন্য কেউ তাকে এ কাজে কখনো বাঁধাও দেয়নি।
এই কয়েক দিন আগে একটা বেসরকারী হাসপাতালের অপেক্ষা করার স্থানে ডাক্তারের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেখানে দেখলাম দেয়ালে একটা বিজ্ঞপ্তি টানানো রয়েছে। তাতে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ফটো না তোলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তার মানে এখন কোম্পানিগুলো আর প্রতিনিধিদের কথা বিশ্বাস করে না তাই প্রমাণ দেখতে চায়। প্রেসক্রিপশন একজন রোগীর একান্ত ব্যাক্তিগত দলিল। সভ্য দেশে রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। আমাদের এখানে এই গোপনীয়তার অধিকারের মর্যাদা নেই। রোগীর গোপনীতা রক্ষার জন্য কোন আইন এখানে আছে কি-না – জানি না। আমাদের কেউ রোগী হিসেবে সেবা দেয় না। আমরা শুধুই ডাক্তার, হাসপাতাল, ঔষধ কোম্পানির ক্রেতা। ক্রেতা ঠকানোর মহোৎসব সবখানে।
করোনাকালে শত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও বেশ কিছু ভাল খবর পাওয়া গিয়েছে। এ সময়ে শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, প্রকৃতির প্রতি নির্যাতন কম হয়েছে। ফলে প্রকৃতি সজীব হয়েছে, এই ঢাকা শহরে বাসায় বসে পাখির ডাক শুনেছি, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডলফিন বেড়াতে এসেছে। এ রকম আরেকটি ভাল খবর হচ্ছে এ বছরের এপ্রিল ও মে মাসে স্বাভাবিক ভাবে ৯০ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে। বাকি দশ শতাংশ অস্ত্রপচারের মাধ্যমে। দেশে আজকাল বেশির ভাগ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রপচারের মাধ্যমে। এই খবরটি আমাদের জানিয়ে দেয়, প্রায় বিনা প্রয়োজনে আমাদের দেশে বেশির ভাগ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রপচারের মাধ্যমে। অহেতুক একজন মানুষের পেট কাটা কত বড় অন্যায়? পেট কাঁটার পর তাকে আরও বহুদিন পর্যন্ত সে কাটার কষ্ট ভোগ করতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে পেট কাটার কারনে ঘা হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এই অন্যায়টা আমাদের চোখের সামনে বছরের বছর ঘটে চলছে। কেউ কিছু বলছে না। শুধু সন্তান জন্মদানের জন্যেই নয়, বিনা প্রয়োজনে বছরে হাজার হাজার অস্ত্রপচার হচ্ছে শুধুই কিছু মানুষের টাকা বানানোর উদ্দ্যেশ্যে। লোভ আমাদের অন্ধ করে রেখেছে। কমবেশি প্রতিটি পেশায় চলছে এ রকমের দুর্বৃত্তপনা।
ডাক্তারগণ অনেক রাত জেগে চেম্বারে রোগী দেখেন, অস্ত্রপচার করেন। অনেকের কাছে শুনেছি, কোন কোন ডাক্তার রোগী দেখেন বা অস্ত্রপচার করেন মধ্য রাতের পরেও। আমি নিজেও একটা বেসরকারী হাসপাতালে আমার এক আত্মীয়কে ডাক্তার দেখিয়েছি রাত একটায়। ডাক্তারদের জীবনে বিশ্রাম, শান্তি বলে কিছু নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের দেখা যায় না। তারা সন্তানদেরও সময় দিতে পারেন না। তারা অস্বাভাবিক, অসুস্থ জীবন যাপন করছেন। নিজের অসুস্থ জীবন নিয়ে তারা অন্যদের সুস্থ্য করে তুলবেন কি করে? ডাক্তারগণ টাকার মোহে ঘুমান না পর্যন্ত। ঠিক মত ঘুম না হলে চিন্তা শক্তি লোপ পায়। এ কথা আমি নিজের জীবন থেকেই জানি। ঠিকমত চিন্তা করতে না পারলে রোগীর চিকিৎসা করবেন কি করে? এটা পারেন না বলেই তারা রোগীদের ঠিকমত দেখেন না, রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন না - সকল রোগীর জন্য মুখস্ত চিকিৎসা করেন। ভুল চিকিৎসা হচ্ছে অহরহ। প্রায়ই খবর হয় হাসপাতাল ভাঙচুরের।
সরকারী ডাক্তাররা সরকারী হাসপাতালে রোগী দেখেন না, ওষুধ দেন। রোগীদের ভাল চিকিৎসার জন্য যেতে বলেন নিজের চেম্বারে বা যে বেসরকারী হাসপাতালে তিনি কাজ করেন সেখানে। সরকারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তারা রোগীর চিকিৎসা করেন না। দামী দামী রোগ নির্নয়যন্ত্রে সেখানে মরিচা ধরে। সেখানে যন্ত্রপাতি কেন হয় শুধুই দুর্নীতি করার জন্য। এসব খবর কদাচিৎ গণমাধ্যমে আসে। বেসরকারি হাসপাতালের যন্ত্র ব্যবহার করে তারা রোগীর বিল বাড়ান। বিলও বাড়ালেই কমিশন। সরকারী হাসপাতালে চাকরী করে নিজের চেম্বার বা বেসরকারী হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ নীতিগতভাবে অসঙ্গত, পরস্পর বিরোধী। বিড়ালকে দুধের পাহারায় নিযুক্ত করার সামিল।
স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। এই মোলিক অধিকারটি তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দি হয়ে আছে। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য সেবার ৬৫ শতাংশ যোগান দেয় বেসরকারী খাত। জনগণতো বটেই করোনাকালে দেখলাম সরকারও স্বাস্থ্য সেবার জন্য বেসরকারী খাতের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। চিকিৎসা সেবা এত ব্যাপক পরিসরে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। এখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবার নামে নির্যাতন করা চলবে না। দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাতে সরকারী খরচে প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য সেবা একটা বিরাট ও ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্থ, অসৎ চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখান থেকে এই মৌলিক অধিকারকে বের করে আনতে হবে। তার জন্য প্রথমেই দরকার সরকারের চিকিৎসা সামর্থ বাড়ানো। সরকার রাস্তা-ঘাট, পুল, কালভার্ড, ইত্যদি ক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ করছে। যথেষ্ট বিনিয়োগ হচ্ছে না শিক্ষায় আর চিকিৎসায়। দেশে যত সরকারী হাসপাতাল আছে তার সবগুলোতে কয়কগুন বেশি চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বড় বড় বহুতল ভবন নির্মান করে, উন্নত যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ বাড়াতে হবে। সরকারী হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্যদের ব্যাক্তিগত চেম্বার এবং বেসরকারী হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। সরকারী এবং বেসরকারী উভয় রকমের হাসপাতালে সরকারের নজরদারী বাড়াতে হবে। শাস্তি দিতে হবে অপরাধীদের।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।