মানব পুঁজি গঠনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন
প্রকাশিত : ১৫:২০, ২০ নভেম্বর ২০২০

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অধিক সংখ্যক পাসকৃত ছাত্রছাত্রীর চেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী বের করার দিকে নজর দেয়া হবে। সরকার উন্নতমানের জীবনযাত্রা সুনিশ্চিত করতে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণের পুষ্টি পরিষেবার ব্যবস্থা করতে চেয়েছে। আসলে মানব পুঁজি গঠনে শিক্ষা-প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক হোক, স্বাস্থ্যের মানও উন্নত হতে হবে।
থিওডোর শুল্টজ ছিলেন একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তিনি গ্রামীণ ও কৃষি অর্থনীতিকে মানব উন্নয়ন তত্ত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। ১৯৬০ সালে শুল্টজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মানব উন্নয়নের জন্য মানব পুঁজি গঠনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে তিনটি উপাদানকে তিনি চিহ্নিত করেন- মানব পুঁজি গঠন ব্যতীত অধিকাংশ দেশের পক্ষে ভৌত কাঠামোগত পুঁজি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি তখনই সম্ভব হবে যখন মানব পুঁজি গড়বে এবং ভৌত অবকাঠামোগত পুঁজি একইসঙ্গে কাজ করবে। মানব পুঁজির সঙ্কট হলে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ স্থগিত হতে পারে। শুল্টজ অবশ্য কৃষি ক্ষেত্রে ছদ্মবেশী বেকারত্বের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেছিলেন। এ সমস্ত উপাদানের কৃষি ক্ষেত্রে তার মতে সীমিত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনশীলতা থাকে এবং একে অন্যের পরিপূরক হয় বলে দাবি করেছিলেন।
আসলে এ দেশ যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন অবশ্যই কৃষি ক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্সের ব্যবহার আগামী পাঁচ/ছয় বছরের মধ্যে আমরা দেখতে পাব। এবারের করোনাভাইরাসের সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের কৃষকের ধান কাটতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কৃষি শ্রমিকদের যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তা থেকে উত্তরণের জন্য ফসল কাটার এবং কাটার মেশিনের সাহায্যে সমস্যার সুচারু সমাধান করেছিলেন।
মানব পুঁজি গঠনের ধারণা আঠারো শতকে এ্যাডাম স্মিথ দিয়েছিলেন। তবে গ্যারি স্টেনলি ব্যাকার, যিনি ১৯৯২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, জ্যাকব মিনসর এবং থিওডোর শুল্টজ মানব পুঁজি গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জ্যাকব মিনসর মনে করতেন যে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং অর্জিত ক্ষমতা উভয়ই পৃথক, কিন্তু দেশ এবং সময়সীমার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে থাকে। মানব পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে অধিগ্রহণকৃত দক্ষতাগুলো উৎসারিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ও শ্রমবাজারে প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং গতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমে।
ব্যক্তিগতভাবে মানবীয় মূলধনের বিকাশ ঘটে থাকে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে, যাতে করে সামগ্রিক অর্থে সামষ্টিক বিবেচনায় সামাজিক এবং জাতীয় পর্যায়ে আয়সমূহকে যুক্ত করে থাকে। মিনসরের তত্ত্বের মধ্যে অবশ্যই সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ের আয়, যা কিনা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উৎসারিত হয়, সেজন্য মানব পুঁজি গঠনকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য জাতীয় পর্যায়ে মানব পুঁজির সঙ্গে ভৌত অবকাঠামোগত মূলধনের সমন্বয় সাধনের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, মানব পুঁজি গঠন করলে যে প্রবৃদ্ধি হবে তা কিন্তু ভৌত অবকাঠামোগত মূলধনের চেয়ে অধিক।
আবার মানব পুঁজি গঠন না করা গেলে ভৌত অবকাঠামোগত পুঁজিও সৃষ্টি হবে না। মুঘল সাম্রাজ্যে দেখা যায় যে, তারা মানব পুঁজি গঠন না করে বরং ভোগ-বিলাস, প্রাসাদ নির্মাণসহ নানাবিধ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ইংরেজরা বণিকের বেশে এসে ক্ষমতার দণ্ড কেড়ে নিয়েছিল। আবার যেদিন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলা যতই মীর জাফর ও ঘসেটি বেগমের বিশ্বাসঘাতকতায় হেরে যাক, যদি সুষম বণ্টন ব্যবস্থা থাকত তবে ইংরেজরা ও চক্রান্তকারীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সহজে সাহস পেত না।
আসলে একটি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও কাঠামো এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত যেখানে মানব পুঁজি বৃদ্ধি অর্থনৈতিক অগ্রগতির নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মানব পুঁজি গঠন কেবল পর্যায়ক্রমিকভাবে জ্ঞানের চর্চাকে বিস্তার করে না, বরং নতুন ঘটনার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতার উন্মেষ ঘটায়, যা উদ্ভাবনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের উৎস, যা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সব উপাদানসমূহকে ব্যবহার করে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে মানব পুঁজি গঠন করা উচিত।
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স উদ্যোক্তা অর্থনীতির প্রোগ্রামসমূহের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থান তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করে থাকে। বস্তুত মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তনশীলতা তা স্থানিক এবং স্বল্পকালীন মাত্রায় মানব পুঁজির বিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকে। মানব পুঁজি এমন একটি যোগসূত্র সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গঠন করতে পারে যাতে অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যার পরিবর্তনের কারণ এবং প্রভাব উভয়েই অনুভূত হয়ে থাকে। মানব পুঁজি যদি যথাযথভাবে বিকশিত না হয় তবে কোন সংস্থা তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকবলের অভাব অনুভব করবে। শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং শিল্প নির্ভর ও কর্মোপযোগী শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার।
মানব পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে তিনটি কার্যকারণ কাজ করে থাকে- সময়, প্রতিভা এবং শক্তি। মানুষের মধ্যে রয়েছে অমিত শক্তি। সেই শক্তির সঠিক স্ফূরণ ঘটানো দরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অনেক প্রতিষ্ঠানে আগে থেকে লোক ঠিক করা থাকে। দক্ষ ও যোগ্য লোক দরখাস্ত করলে ডাকে না কিংবা ডাকলেও অদক্ষ লোককে নিয়ে থাকে। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের তরুণ সমাজ বিশেষত কর্মপ্রত্যাশী যুবক-যুবতীদের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার উদ্রেক করে থাকে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাভিত্তিক লাভ হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া, যা কোন দেশের জন্ম ও মৃত্যুর হার হ্রাস এবং জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটতে পারে। এজন্য অবশ্য দরকার হচ্ছে মানব পুঁজি গঠন, যা শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং উন্নত বিশ্বের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমপর্যায়ে তৈরি করা উচিত। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে প্রশিক্ষণ এবং কোচিং ও সেন্টারিং একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
শুল্টজ মানব পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে বেসরকারি ও সামাজিক বিকাশের দিকে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন। গ্যারি বেকার মানব পুঁজি গঠনকল্পে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন- স্বাস্থ্য, চাকরি থাকাকালীন প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা এবং স্থানান্তর। বস্তুত দেশের উন্নয়নে গতিময়তাকে শক্তিশালী করতে অবশ্যই সারা জীবনের জন্য শিক্ষা, সেটি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্র থেকে বিকাশমান করতে হবে। শুল্টজ সব সময় মানব পুঁজি গঠনের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করতেন, যাতে করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় মানব পুঁজি গঠনের প্রয়োজনীয়তা দৃশ্যমান হতে থাকে। গ্যারি বেকার তার তত্ত্বে বেকারত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিশেষত শ্রমবাজারে বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কারের দিকে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং ভাল বেতনের পেশাগুলোর ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা কারণসমূহের ওপর নির্ভর করে থাকে, যেমন- স্বকর্মসংস্থান।
আজ কোভিড-১৯-এ বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে মানুষ তার অবস্থান ও পরিবেশ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড ও উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপ্তি ঘটাতে নিরন্তর অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রায়োগিক কলাকৌশলকে বাজারবহির্ভূত আচরণে প্রসারিত করার ব্যবস্থা মানব পুঁজির মৌলিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে ঘটানো সম্ভব। আয়ের পার্থক্যসমূহ দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আবার ভারসাম্যহীনতার কারণে সম্পদের নিঃখরচায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্পিত বিধিনিষেধ দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। সরকার কিংবা পেশাদার সমিতিসমূহ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করলে কিংবা কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের ফলে অসমভিত্তিক অবস্থার সৃষ্টি হলে তা আয়-রোজগারকে সমতা দিতে দেয় না। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীন পরিবেশের সৃষ্টি করে থাকে। গ্যারি বেকার বস্তুত মানব পুঁজি গঠনকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
করোনাকালে অনেক শ্রমজীবী ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় দেখা যায় যে, অদক্ষ শ্রমিকরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন। বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নির্দিষ্ট নয় কিংবা সাধারণের উপযোগী নয়। বরং গৎবাঁধা প্রশিক্ষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেয়া হয়। এজন্য ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্বাহের জন্য কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যয় ভাগ করে নেয়া যেতে পারে।
আমাদের দেশে গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকাররি প্রতিষ্ঠানে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সে কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তকে ব্যবহার নাও করা হতে পারে। এর ফলে এক ধরনের সংকীর্ণতা এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে। এর কারণ হচ্ছে বহিস্থ ঘটনাপ্রবাহ। বর্তমানে চলমান কোভিড-১৯ মানুষের এবং বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বহিঃস্থ ঘটনাপ্রবাহের ফল।
শুল্টজ মন্তব্য করেছিলেন, অর্থনীতির কোন অংশ তদন্ত করা হচ্ছে তা বিবেচনায় আনা হয় না। বরং লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সচেতনভাবে তাদের সংস্থাসমূহের পুনর্নির্মাণ কর্মকাণ্ডে ব্রতী হয়েছেন। শুল্টজের এ অভিমত বর্তমান নিউ নর্মাল সিচুয়েশনেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সরকার গতিশীল করতে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু যারা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করবেন তাদের মধ্যে এক ধরনের আলস্যভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার দরুন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠী প্রদেয় সাহায্য-সহযোগিতা নির্দিষ্ট সময়ে পাচ্ছে না।
শুল্টজ অবশ্য মনে করতেন যে, অর্থনৈতিক দ্রব্যের মতো উদ্যোক্তাও অত্যন্ত মূল্যবান। মানবী পুঁজি বিকাশের মাধ্যমেই কেবল উদ্যোক্তা তৈরি হতে পারে বলে শুল্টজ মনে করতেন। যেখানে শিক্ষা এবং অন্যান্য মানব পুঁজি বিনিয়োগ প্রযুক্তিগত ও বরাদ্দকৃত দক্ষতা বাস্তবায়নে সহায়তা করে থাকে, সেখানে শুল্টজ যুক্তি দেখান যে, দক্ষতা অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাকে উন্নত করে, বিশেষত কৃষিজীবীদের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশ এবং তা বুঝতে পরিবর্তনসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যগুলো সক্ষমভাবে বিবেচনায় এনে কার্যক্রম করতে হবে এবং সাংগঠনিকভাবে অনুশীলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া অংশটুকুকে সামনের দিকে এগিয়ে দিতে হবে।
উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে নতুন পরিকাঠামো তৈরিকৃত দক্ষ মানবসম্পদ, যারা কর্মঠ এবং যাদের আইসিটি এবং মানবিক জ্ঞান রয়েছে তার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার। নচেৎ কেবল আইসিটি জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু মানবীয় গুণাবলীর অভাববোধ হবে। কৃষি ক্ষেত্রেও উন্নততর প্রযুক্তির বিকাশের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়।
আমাদের দেশে গবাদিপশু লালন-পালনে খরচ বেশি পড়ে থাকে। এটি হ্রাসকল্পে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে: প্রত্যেকটি গবাদিপশুকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা এবং দুগ্ধ খামারের সর্বাধিক কর্মক্ষমতা অর্জন করা ও খামারি যেন তাদের প্রতিদিনের অবস্থা সম্পর্কে নিজে সম্যক জ্ঞাত হয়, গবাদিপশু যেন সর্বোত্তমভাবে উর্বরতা প্রদানে সক্ষম হয় তার ব্যবস্থা করা দরকার। গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সর্বোত্তম করতে হবে। গবাদিপশুর জন্য মানসম্পন্ন অথচ সস্তায় খাদ্য এবং পানীয়ের ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে প্রচুর দুধ দিতে পারে এবং উন্নতমানের মাংসের ব্যবস্থা হয়। এজন্য উন্নতমানের গবাদিপশু লালন-পালন সংক্রান্ত সফটওয়্যার উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও তৈরি করা উচিত।
আইসিটি চর্চাকে প্রাথমিক স্তর থেকে আরও গতিময়তা দিতে হবে। কেননা দেশে যে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার সুফল পেতে গেলে উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা এবং টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। দেশে উচ্চমান সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তির প্রতিরূপ সংস্থান করা যেতে পারে এবং এক্ষেত্রে বেসিস ও এটুআইকে মূল কর্মকাণ্ডের বিবেচনায় রেখে মূলধন ও শ্রম ভিত্তিগুলোর বৃদ্ধি, আইটি শিক্ষা-দক্ষতা এবং সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার মানসম্মত করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, যাতে করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব হয়।
এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটছে বর্তমান সরকারের আমলে। মানুষের গড় আয়ুও বৃদ্ধি ঘটেছে। দেশের উচ্চ শিক্ষা উন্নত মানব পুঁজি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আবার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে সরকার প্রয়াস গ্রহণ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় গ্রামাঞ্চলে মানুষের মাঝে কারিগরি কলা-কৌশল ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা।
পিকেএসএফ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বৃহৎ ও মাঝারি এনজিওসমূহ কারিগরি জ্ঞানের যে বিস্তার ঘটাচ্ছে তা করোনাকালে এবং মধ্যবর্তী সময়ে দীর্ঘ তিন মাসে ১৬ বছর পর সর্বাধিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বানভাসি মানুষের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সংস্থা হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তবে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নত করার বিকল্প নেই। কেননা, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কেবল মুখস্থ বিদ্যানির্ভর হয়ে গেছে এবং শিক্ষার্থীরা অশুভ গ্রেড প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দূর করতে ষণ্ডা-গুণ্ডাদের হাত থেকে অনুমোদনবিহীন হাসপাতালগুলো উদ্ধার করতে হবে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবায় নিয়োগকারীদের রোগীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে শিক্ষা খাতে ব্যয় যাতে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়, বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন সামাজিক সম্মান বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকারি এবং বেসরকারি খাতে ব্যাপক সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে করে একটি অনুকূল পরিবেশ দেশে তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাসমূহ বৃহত্তর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদান করবে, যা দক্ষ ও কার্যকর মানব পুঁজি গঠনের মাধ্যমে সম্ভব।
লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং আইটি এক্সপার্ট
pipulbd@gmail.com
এআই/এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।