ভয়ংকর মহামারির নাম ধর্ষণ!
প্রকাশিত : ২০:০৬, ৬ ডিসেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২০:২৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২০
'ধর্ষণ' এবং 'হত্যা' যেন সমাজে মহামারীর মতোই জেঁকে বসেছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে ধর্ষণ এবং হত্যার মতো নৃশংস ও ঘৃণ্য অপরাধ। একটি ঘটনার রেশ কাটকে না কাটতেই আরেকটি ঘটনার জন্ম হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় চোখ রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ শেষে কিংবা ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, কখনও কখনও মেরেও ফেলা হচ্ছে ধর্ষণের শিকারকে। এই জঘন্য বিষয় নিয়ে যত চিন্তা-ভাবনাই করা হোক না কেন, একটি প্রশ্নই মাথায় আসে- মানুষ কীভাবে এমন অমানুষ হয়ে ওঠে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়- ধর্ষণের শিকার নারীরা দরিদ্র, ক্ষমতাহীন আর প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন হয়। বিপরীতে ধর্ষকরা এতো বেশি প্রভাবশালী হয় যে, একের পর এক ধর্ষণের মাধ্যমে দেশের প্রশাসনকে তারা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এখলাশপুরে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টা। এসব ঘটনা সবাইকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনকি এই মহামারীর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি শিশুরাও। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০১ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৪৬২ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন। ধর্ষণের শিকার হওয়াদের মধ্যে ৪০ জনের বয়স ৬ বছর এবং ১০৩ জনের বয়স ১২ বছরের মধ্যে।
এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জন নারীকে। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১২৬ জন নারীর ওপর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চলতি বছরের ছয় মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
গতবছর তথা ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। নারীপক্ষ তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে- ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র ৪ জনের সাজা হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় হাজারে সাজা হচ্ছে মাত্র চার জনের।
মহিলা আইনজীবী সমিতির আরেক জরিপে দেখা যায়- ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। শিশু ও নারী নির্যাতন না কমার কারণ মূলত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়।
অন্যদিকে, বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে নারীকেই। আর ঘটে যাওয়া ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় বাড়ছে অনাকাঙ্খিত এসব ঘটনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটেই চলেছে।
অনেক নারী এবং ভিকটিম শিশুর অভিভাবক তো জানেই না যে কোথায় কিভাবে অভিযোগ জানাতে হয়। আবার অনেক নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু আদালত পর্যন্ত না গিয়ে বাইরেই মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আর যে কোনও ধর্ষণ বা সহিংসতার পিছনেই সমাজের বেশিরভাগের আগ্রহ নারীর দোষ, তার পোশাকের দোষ খোঁজার ক্ষেত্রে, যা ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করে তুলছে।
উন্নত দেশে যে ধর্ষণ হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে সেখানে দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয়। এই শাস্তি দেখে অন্যেরা সচেতন হয়। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন তুলনামূলক কম হয়। সেখানে ধর্ষিতাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় কেউ দাঁড় করায় না।
আর আমাদের দেশে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে বীরের বেশে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্ষিতার স্থান হয় ঘরের কোণে- যদি বেঁচে থাকে সে। যেন ধর্ষিত হওয়া এদেশে নারীরই অপরাধ। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের রাস টেনে ধরার জন্য প্রথম কর্তব্য- এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার করা। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
একটির পর একটি ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটির পর একটি শাস্তির খবরও নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ধর্ষণপ্রবণতা হ্রাস পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখনই সময় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং ধর্ষণ আইন সংশোধন করা। যাতে জামিনে কেউ ছাড়া না পায়। সেইসঙ্গে দ্রুত বিচার আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়।
লেখক- তরুণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।