বিরামহীন ছুটছে অভিভাবকরা, যদি লাইগা যায়...
প্রকাশিত : ২১:২৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
বরিশাল নগরীর ভালো স্কুলগুলো তাদের ভর্তি ফরম বিতরণ করে ডিসেম্বরে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অভিভাবকরাও তাঁদের সন্তানদের পছন্দের স্কুলে ভর্তি করাতে ছোটেন এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে। কিন্তু এবার করোনার কারণে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে লটারি করে মাধ্যমিকের সব ক্লাসে ভর্তি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন নেওয়া শুরু হবে ১৫ ডিসেম্বর থেকে। চলবে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুধু অনলাইনে আবেদন করা যাবে। এরই জেরে বরিশালে এই প্রথমবারের মতো লটারির মাধ্যমে ভর্তি নেয়ার সিদ্ধান্তের ফলে অভিভাবকদের মধ্যে বেড়েছে অস্থিরতা।
অভিভাবকরা বলছেন, করোনায় আমরা চাইনি স্কুল খুলুক। কিন্তু মূল্যায়নের বিষয়টি আরেকটু ভাবা যেতো। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় স্কুলে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তিতে বেশকিছু সমস্যা সৃষ্টি করবে বলেও মনে করছেন তারা।
কেউ কেউ বলছেন- ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি আসলেই শিক্ষার্থীদের মনোজগতে চাপ সৃষ্টি করছে। ভর্তি পরীক্ষা হবে না, লটারির মাধ্যমে ভর্তি হবে জানার পর থেকে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে যেমন অনেকে ভয় পাচ্ছেন, আবার অনেকেই এ সুযোগে যদি লাইগা যায়- এ ভাবনায় সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সকল অভিভাবক তাদের সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়ে সকল আশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প হিসেবে সন্তানকে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন, এ বছর তাদের অনেকে লটারির মাধ্যমে ভর্তির খবর শুনে তাদের সন্তানকে পছন্দসই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন।
এজন্য তারা প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন তৈরী ও সর্বশেষ অধ্যায়নরত বিদ্যালয়ের প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এমন কথাও শোনা যাচ্ছে- যে সময়টাতে অনেকের সন্তান চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার অপেক্ষা করছে কিংবা চলতি শিক্ষাবর্ষে চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যায়ন করছে, তাদেরকেও এ বছর ভালো একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য তাদের অভিভাবকরা উঠেপড়ে লেগেছেন। তারা ‘যদি লাইগা যায় অথবা যদি থাকে নসিবে’-এ মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য লটারি পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছেন। যারা লটারি বা ভাগ্যে বিশ্বাসী তারা ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতিকে সমর্থন করছেন।
এর ভিন্ন চিত্রও যে নাই তা কিন্তু নয়। নগরীর হাসপাতাল রোডের বিপ্লব নামের এক অভিভাবক অনেকটা হতাশার সুরেই বলেন, মেয়ের ভর্তির বিষয়টি ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে কীভাবে স্বস্তিতে থাকা যায়?’
তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছু মেয়ের প্রস্তুতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে কোনও শিক্ষক রাখতে পারিনি। মেয়েকে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বাসায় বসে যতোটুকু সম্ভব সাহায্য করেছি। এখন শুনি লটারির মাধ্যমে ভর্তি নেয়া হবে। আমার মেয়ে যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, সে অনুযায়ী পছন্দের স্কুল পাবে না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আর আমার লটারি ভাগ্য খুবই খারাপ। যা তা অবস্থা। তাই আমি জ্ঞানত কখনও কোনও লটারিতে অংশ নেই না।’
এদিকে বরিশাল নগরীতে ভালো মানের সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। এরমধ্যে বরিশাল জিলা স্কুল, বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও বরিশাল সরকারি মডেল স্কুলে প্রতি বছর তৃতীয় শ্রেণিতে ৬০ জন করে দুই শিফটে মোট ৩৬০ জনকে ভর্তি নেওয়া হয়। এছাড়া শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬০ জন করে মোট ১২০ জন নেয়া হয়।
কয়েকজন অভিভাবক অনেকটা হতাশা নিয়ে বলেন, লটারিতে না উঠলে তাদের ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে যাবে। গত বছরের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যাদের সন্তানেরা উত্তীর্ণ হতে পারেনি সেকল অভিভাবদের অনেকেই লটারিতে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছেন।
কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর তাদের সন্তানরা ভর্তি হতে পারেনি। এরপরই তারা এ বছরের ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাদের সন্তানদের প্রস্তুত করা শুরু করেন। তবে করোনার কারণে প্রস্তুতিতে কিছুটা ভাটা পড়লেও নানাভাবে তারা চেষ্টা চালিয়েছেন, যাতে করে এ বছর তার সন্তানটি একটি ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারে।
অনেক অভিভাবক কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলেন, এবার লটারির কথা শুনে যাদের সন্তান ভর্তির উপযোগী হয়নি, কিংবা যারা বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তারাসহ অনেকে চান্স নেবেন। লটারিতে ভর্তি নেয়ার এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বড় ধাক্কার সামনে ফেললো বলেও অনেকে মনে করেন।
আবার কেউ কেউ সন্তানকে নিয়ে অনেকটা বাজি ধরে মাঠে নেমেছেন। তাদের দাবি, আমরাতো ভাই অন্যায় কিছু করছিনা। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানোর ইচ্ছা কার না থাকে। আমরা শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে ভালো আর নাহলেও তেমন কোনও আফসোস থাকবেনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ভর্তি পরীক্ষায় যে সকল শিক্ষার্থী শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের অভিভাবকদের অনেকেই অটো প্রমোশনের খবরে সন্তানের জন্য চতুর্থ শ্রেণির বই সংগ্রহ করে তা পড়ানো শুরু করে দিয়েছিলো। কিন্তু লটারির খবর শুনে তারাও কিছুটা পিছিয়ে এসেছে। তারা এখন অধ্যায়নরত ওই সন্তানদের অনেককে জিলা ও সদর গার্লস স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা করছেন। ছুটে চলছেন কোনও এক বিদ্যালয় থেকে প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করতে, আবার অনেকেই ছুটছেন জন্ম নিবন্ধনের জন্য।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে এবার বিদ্যালয় থেকে কোনও ভর্তি ফরম বিতরণ করা হবে না। ৩০ ডিসেম্বর অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর গত শুক্রবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির এ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
এছাড়া সারা দেশে আবেদনকারীরা আবেদনের সময় প্রতিষ্ঠান নির্বাচনকালে থানাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পাবে। তখন প্রার্থীরা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পছন্দক্রম অনুযায়ী সর্বোচ্চ পাঁচটি বিদ্যালয় নির্বাচন করতে পারবে।
এর আগে গত ২৫ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে আসন্ন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শ্রেণির মতো সব শ্রেণিতেই লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এত দিন বরিশালে সরকারি স্কুলগুলোয় তৃতীয় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।