ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

হৃদয়ে বাংলাদেশ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৯:০৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

চমকে উঠলাম- ভেতরটা নাড়িয়ে দিল দৃশ্যটা। রোববারের অলস মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। সামনের পূর্বী নদী ছাড়িয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম ম্যানহ্যাটেনের সুউচ্চ হর্ম্যরাজির দিকে। কত নানান রঙের আর ঢংয়ের দালান কোঠা- কোনটা উঁচ্চ, কোনটা অত উঁচু নয়, কোনটা লালচে, কোনটা সাদা, কোনটা পেটমোটা, কোনটা চিকন। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায়। ভাবলাম- যে বইটি পড়ছিলাম, সেইটে নিয়ে আসি- শঙ্খ ঘোষের 'দেখার দৃষ্টি'।

ওটা নিয়ে আসার জন্য যেই না পেছন ফিরেছি, তখনই চোখ আটকে গেল নীচের সবুজ মাঠটাতে। কোন একটি শিশু লাল রঙের একটি গোল চাকতি ফেলে গেছে মাঠের কোণে সবুজ ঘাসের ওপর। আর ঐ চাকতিতে একটি তারা থাকা সত্ত্বেও মাঠের ঐ কোণটি কেমন করে যেন হয়ে গেছে বাংলাদেশের পতাকার মতো। ক'বার চোখ ঘষে আবার তাকালাম- না কোনও ভুল নেই। 'এ ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবির' মতো মাঠের কোণে বিছিয়ে আছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার মতো একটা ছবি। মন ও চোখ কেমন করে উঠল। 

এতো নতুন নয় আমার জন্যে। পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় এক টুকরো বাংলাদেশ দেখলেই কেমন যেন হয়ে যাই। তা সে টুকরোটা যে ভাবেই আসুক না কেন- কখনও রাবাতে আমাদের দূতাবাসর ছোট্ট সাদা ভবনের ওপরে বাতাসে আন্দোলিত দ্বিবর্ণের পতাকার হোক, কিংবা রোমে যে বাঙ্গালী তরুণটি রেঁস্তোরায় ঘুরে ঘুরে লাল গোলাপ বিক্রি করছে, সে; কিংবা মস্কোর সরু গলির মধ্যে বাংলাদেশী পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসেছে যে দোকানটি, সে'টি। বড় করে বাংলায় লেখা 'রকমারি, তার নীচে ছোট করে রাশানে তার অনুবাদ সম্ভবত। ঐ বর্ণমালাগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয়, ওখানে উঠে ওগুলোকে জড়িয়ে ধরি। 

বিদেশের নানান শহরে কখনও কখনও বাংলাদেশ আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কার্যোপলক্ষে বার্লিনে বেশ ক'বছর আগে গেলে পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একটি বক্তৃতা দিতে। সব মিলিয়ে মোটে জনা পঞ্চাশেক বাঙালী ছাত্র আছে সেখানে। আমি যাতে হৃতদ্যোম না হয়ে পড়ি, সেটা ভেবেই হয়তো উদ্যোক্তারা আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন আমাকে, 'রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সনে যে ঘরে বলেছিলেন, সেখানেই আয়োজন করার চেষ্টা করছি আমাদের অনুষ্ঠানের'। আমার অবশ্য বিকার ছিল না।

কিন্তু নির্দ্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দেখি, কোথায় পঞ্চাশ! মিলনায়তনের ২০০ আসন ভর্তি বাঙ্গালী ছাত্র-ছাত্রীতে, দাঁড়িয়ে আছে আরও শ' খানেক, বাইরে অপেক্ষমাণ আরও জনা চল্লিশেক। কোথা থেকে এলো এতসব ছেলেপিলে? কোথা থেকে নয়? হামবুর্গ, হাইডেলবার্গ, মিউনিখ, কোলন, বন ঝেঁটিয়ে এসেছে সবাই। উদ্যোক্তাদের মুখ শুকনো। জনস্রোত যদি বাড়ে, কি করবে তারা?

ঘরে ঢুকে দেখি অতশত তরুণ মুখের কলকালিতে কানপাতা দায়। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবুজের ওপরে সুন্দর করে লাল দিয়ে লেখা, 'বাংলাদেশ: অন্তর মম বিকশিত করো' - ঐটেই বক্তব্যের বিষয়বস্তু। চারদিকে চোখ বুলিয়ে মনে হলো- আচ্ছা এই যে তিনশ' ছেলেমেয়ে, তাঁরা কেন এসেছে? তাদের বেশীর ভাগ চেনে না আমাকে, নামও শোনে নি সম্ভবত, তবু এসেছে- শুধু এসেছে কেউ একজন বাংলাদেশ সম্পর্কে বলবেন। ঐ নাড়ীর টানে তারা এসেছে।

এক ডজন ছেলেমেয়ে মঞ্চে উঠল। কি সুন্দর সেজে এসেছে তারা। মেয়েরা সবুজ শাড়ী, লাল পাড়, কপালে লাল টিপ। ছেলেরা সবুজ পাঞ্জাবী, সাদা পা'জামা। খালি গলায় যখন 'আমার সোনার বাংলা' গেয়ে উঠল, তখন সারা ঘর দাঁড়িয়ে গেল, গলা মেলালো। দেখলাম চোখ মুছছে কেউ কেউ। তখন কোথায় বার্লিন, কোথায় কি? মনে হচ্ছিল, এক টুকরো বাংলাদেশ সেখানে জ্বলজ্বল করছে। 

এবার আমার পালা। মঞ্চে উঠতে উঠতে ঠিক করলাম, আজ রবীন্দ্রনাথ থাকবেন পেছনের সারিতে, আজ শুধুই বাংলাদেশ। অন্তরের ভেতর থেকে বলেছিলাম কিছু কথা- একজন সাধারণ মানুষের কথন- যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়েরও সাক্ষী। না, আর কোনও যোগ্যতা নেই তার।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সে বক্তব্যে ঘরে সূঁচ পড়লেও শোনা যেত। বলার শেষে করতালি-ফালির কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে, পুত্র-কন্যাসম ঐ তিনশ ছেলেমেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপরে- তাদের প্রশ্নের বুভুক্ষা নিয়ে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালি তারা- অনেকে বাংলা ভালো বলতেও পারেনা। কিন্তু কি যে তাদের ভালোবাসা ঐ দেশটির প্রতি। 'কোথায় সে দেশ- অতীতে না ভবিষ্যতে?' - বাংলাদেশ তাদের কাছে শুধু একটা দেশ নয়, একটা স্বপ্ন। আমি তাদের স্বপ্নের একটি কণা মাত্র।

কিন্তু এ কথা তো শুধু আমার নয়- আমাদের প্রজন্মের সবার কথা। সেদিন শামীম বলছিল তার কথা। অনেকদিন ধরে দেশের বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশকে সে হৃদয়ে ধারন করে রেখেছে নিরন্তর। এ দেশের শেকড় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে। তাই তার সব কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে বাইরে বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল কম, ধারনা ছিল নেতিবাচক। 

শামীম হৃদয়ে তাগিদ অনুভব করেছে বাইরে বাংলাদেশকে চেনানোর। 'জানো',  বলেছে সে, 'যে কোনও অনুষ্ঠানে গেছি, সবসময়ে চেষ্টা করেছি কিছু একটা বলার, সুযোগ খুঁজেছি কোনও একটি প্রশ্ন করার- শুধু এই কারণে যাতে আমি পরিচয় দেয়ার শুরুতেই বলতে পারি যে, আমি বাংলাদেশের'। তার এ কথার পরে কেমন যেন লেগেছিল আমার কাছে, কেমন একটা নৈকট্য অনুভব করেছিলাম তার কথার সঙ্গে।

আমিও তো যেখানে যাই, নিজের অন্য পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমি বাংলাদেশের- মমতার সঙ্গে বলি, গর্বের সঙ্গে জানাই, প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করি। তবে করেছিলাম বটে বাংলাদেশের জন্য একটা কাজ। বছর পনেরো আগে নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশিয়ার ওপরে এক আলোচনা সভায় বক্তাদের মধ্যে আরও তিনজনের সঙ্গে ছিলাম আমি এবং সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটি যিনি সত্তুর দশকের প্রথমার্ধে নিতান্ত তাচ্ছিল্য ও অনুকম্পার সঙ্গে বাংলাদেশেকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

আমার বক্তব্যে আমি তার সূত্র টেনেছিলাম এবং সেই প্রেক্ষিতে বলেছিলাম যে- সেদিনের সে সব সদম্ভকারীরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশ অহংকারের সঙ্গে বিরাজ করছে এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সভায় গুঞ্জন উঠেছিল, উপর্যুক্ত ব্যক্তিটি সভা শেষে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি অপেক্ষা করিনি, দাঁড়াইনি, সভা শেষে দৃপ্ত পদে মাথা উঁচু করে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি