পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যান ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য চপেটাঘাত
প্রকাশিত : ১৯:২১, ২০ ডিসেম্বর ২০২০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ যখন তার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে উপনীত, ঠিক সেই সময়টায় বিজয়ের আরেকটি মাসে আরেকটি বিজয় বাংলাদেশের। পদ্মা সেতু আমাদের বিজয়ের অহংকার। এক থেকে একচল্লিশ নম্বর স্প্যান বিজয়ের ইতিহাস। গর্বের ইতিহাস। স্প্যানগুলো যেন একেকটি প্রতিশোধের স্পৃহার প্রতীক। একেকটি স্প্যান মাথা উঁচু করে গর্বের সহিত দাঁড়িয়েছে আর ষড়যন্ত্রকারীদের চপেটাঘাত করেছে। জবাব দিয়েছে সকল ষড়যন্ত্রের। ষড়যন্ত্রের নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অহংকারের শেষ স্প্যানটি পতপত করে উড়িয়ে জানান দিল আমরা বিজয়ী জাতি।
দেশের দৃষ্টিনন্দন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো আমাদের পদ্মা সেতু। এই অবকাঠামোটি আর দশটি অবকাঠামো থেকে ভিন্ন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন কেবল, কর্ণফুলী টানেল কিংবা ফোর লেন হাইওয়ে কোনো কিছু এর কাছে ধোপে টেকে না। কারণ এটি ‘পদ্মা সেতু’।
এই সেতু জুড়ে দিয়েছে সেই প্রমত্তা পদ্মাকে, যার একদিন ছিল না কুল, ছিল না কিনারা। পদ্মা আমাদের কাছে অজেয় বিশালত্বের প্রতীক। পদ্মা আমাদের কান্নার আর দুঃখের প্রতীক। পদ্মা বাঙালির আবহমান জনজীবনেরও প্রতীক। পদ্মা জয় করা মানে জয় করা আমাদের সব দুঃখ-কষ্টকে, বশে আনা আমাদের অপ্রাপ্তিগুলোকে আর গৌরবান্নিত করা আমাদের আবহমান বাঙালিত্বকে। পদ্মা জয় তাই নতুন বাংলাদেশের জয়যাত্রার সমার্থক। পদ্মা সেতু তাই নতুন বাংলাদেশের প্রতীক।
২০০১ সালেই পদ্মা সেতুর শুভসূচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে পুরো প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। ষড়যন্ত্রের সকল প্রতিকূল, ধ্বংসাত্মক পথ পেরিয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণে জোর প্রতিশ্রুতি ছিল। সরকার গঠন করেই ২০১১ সালে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে। নিজ ইচ্ছায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
একই বছরের শেষ দিকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত রাখে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ সরকার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। ২০১২ সালে ঋণচুক্তিটি বাতিল করে দেয় বিশ্বব্যাংক। একই পথ অনুসরণ করেছিল অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও।
বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে দেশে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক অভিনব দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। সবাই ‘যার হাতে যা আছে’ তাই নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দেশের এই আত্মমর্যাদার সংকটের কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেই পথ দেখিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন কীভাবে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকন্যার স্পষ্ঠ ঘোষণা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে।
বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি চক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা অসীম সাহসী ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশ পারে। প্রমাণ হয়েছে আমরা পারি। পদ্মা সেতু ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য। কারণ এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত ছিল। এত বড় আর খরস্রোতা একটা নদীর ওপর এত বড় একটা সেতু নির্মাণ করে শেখ হাসিনা বিশ্বের সামনে একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাজনীতি করেন মানুষের জন্য। দিনরাত কাজ করেন মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা যে পারেন তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা উন্নয়নের সর্বোচ্চ উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানুষ এখন আশা দেখে, স্বপ্নে বুকবাঁধে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছুটে চলে। কারও রক্তচক্ষুকে শেখ হাসিনা ভয় পান না। পদ্মা সেতু তৈরি করে ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেন। করোনা মহামারিতে বিশ্ব এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে। লণ্ডভণ্ড জীবন-জীবিকা। এমন পরিস্থিতিতেও দূরদর্শিতার চমক প্রদর্শনে বিশ্বকে তাগ লাগিয়ে উন্নয়নের চাকা রেখেছেন গতিশীল। করোনার কারণে কোনো প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়নি একটুও। মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে রক্ষাকবচের মতো। অসম্ভবকে সম্ভব করা আর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা জাদুর নাম শেখ হাসিনা। নিন্দুকের দৃষ্টি কখনই ভালো কিছু দেখে না।
বাংলাদেশ এখন অনন্য উচ্চতায়। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। বাস্তব। প্রমত্ত পদ্মায় ৬ হাজার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু গড়েছে বাংলাদেশের নতুন এক দিগন্ত। বিজয়ের কেতন উড়ছে উত্তাল পদ্মার বাতাসে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ছিল একটি আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবে রূপদানে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্যই পারে যে কোনো প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাফল্যের শিখরে আরোহণের, তার প্রমাণ দেখিয়েছে বর্তমান সরকার। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা পদ্মার সাথে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ এবং নানামুখী সমালোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে- বাংলাদেশ উঁচু করে কথা বলতে শিখেছে। এই দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ। এই দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান।
এর মধ্যদিয়ে শেষ হলো দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলা। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির উপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর তিন বছরেরও বেশি সময় পর ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সালে মূল সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে ৪১তম শেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু।
এছাড়াও সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের মধ্যে ১ হাজার ৪১টির বেশি রোড স্ল্যাব বসানো হয়েছে। আর ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে এখন পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ৫০০টির বেশি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী এ সেতু হবে দোতলা। পদ্মাসেতুর মূল কাঠামো স্টিলের, যা স্প্যান নামে পরিচিত। এই স্প্যানের ওপর কংক্রিটের প্রলেপ দিয়ে রাস্তার কাঠামো তৈরি করা হবে, যার ওপর দিয়ে যানবহন চলাচল করবে।
দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক বিপুল গতি
তৈরি হবে পদ্মা সেতুর কারণে। এরই মধ্যে সরকারের সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, সেতুটি চালু হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে এক দশমিক চার শতাংশ, ৭ লাখ ৪৩ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ শতাংশ হারে। জাইকার সমীক্ষাতে বলা হয়েছে, জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৫ সালের দিকে এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৪১ হাজার ৬০০।
এসব হিসাবের বাইরে অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সেটি ঘটলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনীতিকে দেখা যাবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। মানুষের জীবনমানে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন। ২০৪১ সালে ১৬ হাজার ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় নিয়ে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন বাংলাদেশের সামনে, সেটা পূরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর কারণে প্রথম বছরে জিডিপি যদি দেড় শতাংশও বাড়ে তাহলেও এর সার্বিক অর্থমূল্য হবে ৪১ হাজার ৯৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর জিডিপি ৩ শতাংশ বাড়লে সার্বিক অর্থনীতিতে ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি স্ফীতি ঘটবে প্রথম বছরেই।
এই সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভারী শিল্পের পাশাপাশি এসএমই খাতে বিপ্লব ঘটবে। বিকশিত হবে পর্যটন খাত। পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাড়বে পণ্য আমদানি-রফতানি। পায়রা ও মোংলা বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে আমূল বদলে যাবে পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি। পদ্মার দুই পারে আধুনিক স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। এরই মধ্যে বদলে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেতু চালু হলে ট্রেন পৌঁছাবে দক্ষিণের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের জন্য সক্ষমতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস তাতে আরেকটি অর্জন এই সেতু। বিজয়ের মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরেকটি বিজয়ের ইতিহাস রচিত হলো বাংলাদেশে।
তারুণ্যের কবি সুকান্তের ভাষায়-
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
….
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়ঃ
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজ, কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।